ভূমি অধিগ্রহণ

ক্ষতিপূরণের টাকা পরিশোধ না করায় বন্ধ মেগাপ্রকল্প হাইটেক পার্কের 

  এসআর শফিক স্বপন, , মাদারীপুর 

প্রকাশ: ৩ মে ২০২৫, ১০:১১ |  আপডেট  : ৫ মে ২০২৫, ২০:২১

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে বন্ধ রাখা হয়েছে ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা দেয়া। অসহায় ভুক্তভোগীরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এসে বারবার ধর্ণা দিয়ে নিজেদের করুণ অবস্থার কথা জানালেও মন গলাতে পারেনি জেলা প্রশাসকের। প্রতিবারই দেব দিচ্ছি বলে সময়ক্ষেপণ করছেন জেলা প্রশাসক। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ভুক্তভোগীরা বন্ধ করে দিয়েছে সরকারের মেগা প্রকল্প হাইটেক পার্কের নির্মাণ কাজ। কর্মকর্তা নেই তাই বিল দেয়া যাচ্ছে না দাবি জেলা প্রশাসকের। অন্যদিকে একেক সময় একেক অজুহাতে জেলা প্রশাসক তাদের টাকা দিচ্ছে না বলে দাবি ভুক্তভোগীদের।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, জেলার শিবচর উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের কেশবপুরে মেগা প্রকল্প হাইটেক পার্কের কাজ চলছে। সেখানে হাইটেক পার্কের বাউন্ডারি দেয়ালের কাজ চলছিল। এছাড়া মূল ভবনের পাইলিং এর কাজও অনেকদুর এগিয়েছে। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান দ্রæতই কাজ এগিয়ে নিচ্ছিল। কিন্তু হাইটেক পার্কের জন্য অধিগ্রহণ করা জমির ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের টাকা না পাওয়া বেশ কিছুদিন পূর্বে পার্কের কাজ বন্ধ করে দেয় ক্ষতিগ্রস্তরা। পরবর্তীতে জেলা প্রশাসন থেকে টাকা দেয়ার আশ^াসে পুনরায় কাজ করতে দেয় ক্ষতিগ্রস্তরা। কিন্তু আশ^াসের পর একাধিকবার জেলা প্রশাসকের কাছে ক্ষতিপূরণের টাকা নিতে আসলে খুব দ্রæত টাকা দেয়া শুরু করবেন বলে পুনরায় আবারও আশ^াস দেন। কিন্তু আশ^াসের দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার পরও ক্ষতিপূরণের টাকা না পেয়ে আবারও জেলা প্রশাসকের কাছে আসলে এবারও আশ^াস দেন আগামী এক মাসের মধ্যেই টাকা দেয়া শুরু করবেন। এভাবে বার বার আশ^াস দেয়ার পর সর্বশেষ চলতি বছর ফেব্রæয়ারি মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে টাকা দেয়া শুরু করার কথা দিয়েছিলেন জেলা প্রশাসক। কিন্তু তিনি এবারও তার কথা রাখেননি। এতে যেমন জেলা প্রশাসকের উপর ক্ষিপ্ত তেমনি জেলা প্রশাসকের কার্যালয় আসা যাওয়া করতে করতে আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত ও হয়রানীর শিকার হচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, সাবেক জেলা প্রশাসক রহিমা খাতুন থাকাকালীন কয়েক কোটি টাকার দুর্নীতি হয়। সেই দুর্নীতি প্রকাশ পেলে রহিমা খাতুন বন্ধ করে দেন ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা দেয়া। সেই ঘটনায় একজন ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা এবং দুইজন সার্ভেয়ারসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। তবে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) রহস্যজনকভাবে এ দুর্নীতির মামলা থেকে রেহাই পান। এরপর থেকে অনেকদিন বন্ধ থাকে ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা দেয়া। জেলা প্রশাসক রহিমা খাতুনের পর মারুফুর রশিদ জেলা প্রশাসক হিসাবে আসার পর কিছু কিছু টাকা দেয়া শুরু করেন। তবে সে টাকা নিতে গিয়েও অনেক হয়রানি হতে হয়েছে ক্ষতিগ্রস্তদের। বারবার আসতে হয়েছে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর মাদারীপুরে জেলা প্রশাসক হয়ে আসেন মোছা. ইয়াসমিন আক্তার। সে আসার পর রহস্যজনক কারণে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় ক্ষতিপূরণের টাকা দেয়া। এরপর একাধিকবার ক্ষতিগ্রস্তরা বিভিন্ন আন্দোলন এবং জেলা প্রশাসকের কাছে ধর্ণা দিলেও অসহায় ক্ষতিগ্রস্তদের কথায় মন গলেনি বর্তমান জেলা প্রশাসক মোছা. ইয়াসমিন আক্তারের। সবশেষে ক্ষিপ্ত হয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা একত্রিত হয়ে মেগা প্রকল্প হাইটেক পার্কের কাজ বন্ধ করে দেয়।

ভুক্তভোগী নেছার উদ্দিন জানান, আমরা সব কাগজপত্রসহ ফাইল জমা দেওয়ার পরও আমাদের দীর্ঘদিন ঘুরিয়েছে। কিছু বিল পেয়েছি, আরও বিল আছে। আমার বাবা বৃদ্ধ মানুষ। তাকে নিয়ে বারবার ডিসি অফিসে যেতে হয়েছে। যে বিল পেয়েছি তা উঠাতে অনেক হয়রানি হতে হয়েছে। এরপর পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে বিল দেয়া। আমাদের বাকি বিল কবে পাব তাও জানিনা। তাই বাধ্য হয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা হাইটেক পার্কের কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। যতদিন টাকা দেয়া শুরু না করবে ততদিন ক্ষতিগ্রস্তরা কাজ করতে দিবেনা। আমাদের হয়রানি না করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের মাধ্যমে আমাদের বিল সহজে দেয়ার ব্যবস্থা করবে এটাই সরকারের কাছে আমাদের দাবি।
কাইউম মাদবর, রাজা মিয়া, মিজানসহ অনেক ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, এলএ শাখার লোকজন আমাদের অনেক হয়রানি করে। এমনকি আমাদের সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করে। আমরা জমি ভিটা হারালাম, তার ক্ষতিপূরণ আনতে যাই। কিন্তু তাদের হয়রানির শেষ নেই। বর্তমানে আমাদের বিল দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা চাই দ্রæত আমাদের পাওনা টাকা দেয়ার ব্যবস্থা করবে সরকার।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এলএও শাখার বর্তমান অবস্থা

ফাতিমা আজরিন তন্বী অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া তিনি রাজস্ব এবং শিক্ষা ও আইসিটি শাখার দায়িত্ব পালন করছেন। ভূমি অধিগ্রহণ ও অর্পিত সম্পত্তি শাখার দায়িত্ব পালন করছেন সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মো. নূরে আলম সিদ্দিক। এছাড়া কানুনগো, সার্ভেয়ারসহ আরও তিন চারজন কাজ করছে ভূমি অধিগ্রহণ শাখায়। ভূমি অধিগ্রহণ শাখার সহকারী কমিশনারের কক্ষটি বন্ধ থাকে সবসময়। এছাড়া সার্ভেয়ারকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সদর উপজেলা ভূমি অফিসে। অফিসে গিয়ে দেখা গেছে,কয়েকজন কর্মচারি ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় অলস সময় কাটাচ্ছে। অথচ যেই অফিসটি একসময় অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্তদের উপস্থিতি সবসময় সরগরম করে রাখত সেই অফিসটি এখন জনশূন্য।

মাদারীপুর জেলা প্রশাসক বলেন, আমাদের কর্মকর্তাদের অভাব রয়েছে। আমরা উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে কর্মকর্তা চেয়েছি। কর্মকর্তা পদায়ন হলেই আমরা অধিগ্রহণের পাওনা টাকা দিয়ে দিতে পারবো।

ভূমি মন্ত্রণালয়নের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান জানান, আমরা আগে এলএও এবং আরডিসি পোস্টিং দিতাম। কিন্তু অনেকদিন সেই প্র্যাকটিস নেই। জেলা প্রশাসক এখানে তার অফিসার দিয়ে কাজ করাতে পারেন। ভূমি অধিগ্রহণের টাকা দেয়াসহ সব কাজ জেলা প্রশাসকই করেন। এখানে আমাদের কোন ভূমিকা নেই। সে চাইলেই এলএও’র দায়িত্ব তার অফিসার দিয়ে কাজ চালিয়ে নিতে পারেন। টাকা দেয়া না দেয়া আমাদের কোন বিষয় নয়, সম্পূর্ণ দায়িত্ব জেলা প্রশাসকের।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত