অভিযোগ ও প্রতিবাদ করেও মেলেনি প্রতিকার, দেয়া হয় হুমকী ও মামলা
কৃষি খামারের আড়ালে ফসলী জমিতে সোলার পাওয়ার প্লান্ট
প্রকাশ: ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৬:২৬ | আপডেট : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৫১
পঞ্চগড়ের তেতুঁলিয়া উপজেলায় মৌসুমী কৃষি খামারের আড়ালে ফসলি জমিতে সোলার পাওয়ার প্লাট স্থাপনের চেষ্টা করছে ল্যান্ডকো নামে ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠান। সোলার পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের নামে প্রতিষ্ঠানটি কৃষকের চাষাবাদ করা গম, মরিচ, পেয়াঁজ সহ নানা ফসলে ট্রাক্টর দিয়ে হালচাষ করে ফসল ধ্বংস করে ফসলী জমি দখল করছেন বলে অভিযোগ কৃষক সহ স্থানীয়দের। সেই সাথে জমি বিক্রি না করলেও প্রতিষ্ঠানটি কৃষকের ফসলি জমি ও গাছপালা কেটে বাড়িঘর ভেঙ্গে জমি দখলে নেয়ার চেষ্টাও চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এ নিয়ে স্থানীয়রা প্রতিবাদ করলে দেয়া হচ্ছে হুমকি ও মামলা। ফলে আতঙ্কে দিন কাটছে তাদের। ঘটনাটি ঘটেছে পঞ্চগড়ের তেতুঁলিয়া উপজেলার দেবনগড় ইউনিয়নের শেখগছ এলাকায়। ইতিমধ্যে ল্যান্ডকো নামে ওই প্রতিষ্ঠানটি তাদের কেনা সহ প্রায় ৫০ একর জমি তাদের দখলেও নিয়েছে। অবশিষ্ট জমি দখলে নিতে চেষ্টা করছে তারা।
স্থানীয়রা অভিযোগ করে জানান, সোলার পাওয়ার প্লাট স্থাপনের নামে ল্যান্ডকো নামের ওই প্রতিষ্ঠানটি দেবনগড় ইউনিয়নের ওই শেখগছ এলাকায় ২০১৭ সালে জমি কিনতে শুরু করেন। এসময় স্থানীয় অনেকে তাদের জমি কোম্পানীটির কাছে বিক্রিও করেন। তবে দীর্ঘদিন পরে কোম্পানীটি জমি দখলে নিতে এসে কৃষকের অবিক্রিত ফসলী জমির মরিচ, গম, পেয়াজ সহ নানা ফসলের উপর ট্রাক্টর চালিয়ে ফসল হানি করে জমি দখলে নিচ্ছে। এমনকি স্থানীয়দের বসত বাড়ির গাছপালা কেটে বাড়ী উচ্ছেদ করতে ব্যবহার করছে ভাড়াটে সন্ত্রাসীদেরও। এনিয়ে স্থানীয়রা কোম্পানীর লোকজনের সাথে আলোচনায় বসতে চাইলেও কোন সদুত্তর মেলেনি। উপজেলা প্রশাসন সহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পাননি দাবী স্থানীয় লোকজনের। অভিযোগ করলে উল্টো দেয়া হয় হুমকী ও মামলা।
সোমবার (৫ ফেব্রুয়ারী) দুপুরে ৩টি ট্রাক্টর ও বেশ কিছু লোকজন নিয়ে জমি দখলে নিতে আসেন প্রতিষ্ঠানটির স্থানীয় প্রতিনিধি জহিরুল ইসলাম জহির। পরে ৪ শতাধিক কৃষক ও স্থানীয় লোকজন তাদের বাধাঁ প্রদান করেন। এ নিয়ে বাকবিতন্ডা শুরু হলে একপর্যায়ে বিশৃংখল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। পরে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, তেতুঁলিয়া মডেল থানা পুলিশ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। সমস্যা সমাধানে সাথে আলোচনায় বসতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তার দপ্তরে দুইপক্ষকে আহ্বান জানানো হয়েছে।
স্থানীয় কৃষক মোস্তফা কামাল বলেন, প্রতিষ্ঠানটি যদি কারো জমি কিনে থাকে তাহলে তারা দখল করবে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু তারা গণহারে কেন জমি দখল করবে। কেউ জমি বিক্রি না করলেও মানুষের ফসলের উপর ট্রাক্টর চালিয়ে জমি দখল করতেছে। গত কয়েকদিন আগেও তারা আমাদের গম সহ নানা ফসলে চাষ করে নষ্ট করছে। আজকে (সোমবার) আবারো এসেছে। আমরা প্রতিনিয়ত ভয়ে থাকি এই যেন তারা ফসল নষ্ট করে জমি দখলে নিতে এলে। এ যেন মগের মুল্লুক হয়ে দাড়িয়েছে। আমরা কোন বিচার পাচ্ছিনা।
মখলেছা বেগম নামে স্থানীয় এক নারী বলেন, কোম্পানীর লোকজন কিছুদিন আগে আমার বাড়ি ভিটার গাছ কেটে বাড়ির সীমানা বেড়া ভেঙ্গে ফেলছে। আমি জমি বিক্রি করিনি। তবুও তারা বলছে জমি আমাদের লাগবে। আমরা অন্যত্র আপনাকে বদল দিবো। আমি গরীব মানুষ কোথায় যাবো। স্বামী, সন্তান নিয়ে খুব কষ্টে সংসার চালাই।
ল্যান্ডকো নামের প্রতিষ্ঠানটি সূত্রে জানা যায়, পঞ্চগড়ের তেতুঁলিয়া উপজেলার দেবনগড় ইউনিয়নের শেখগছ এলাকায় সোলার পাওয়ার প্লান্ট নির্মাণের জন্য ২০১৭ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২৭৬ একর জমি কেনে প্রতিষ্ঠানটি। তবে সিংহভাগ জমিই তারা এখনো দখলে নিতে পারেনি। এদিকে প্লান্টের কাজ দ্রুতই শুরু করতে প্রতিষ্ঠানটির উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা থাকলেও জমি বিক্রেতা ও তাদের অংশীজনদের নানা অজুহাতে জমি দখলে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
এছাড়া ফসলের আমন ধানের মৌসুম শেষ হলে জমি দখলে নিতে ওই এলাকায় মাইকিং ও ও জমি বিক্রি করা মালিকদের চিঠি দেয়া হলেও তারা কর্ণপাত না করে আবারো রবি মৌসুমের ফসল চাষ করেন।
ল্যান্ডকো নামের প্রতিষ্ঠানটির স্থানীয় প্রতিনিধি জহিরুল ইসলাম জহির বলেন, আমরা প্রথমে আমাদের ২৭৬ একর জমি দখলে নিয়ে সীমানা ঘেরা দিতে চাচ্ছি। তবে এর মধ্যে যদি কারো জমি পড়ে থাকে তাহলে তাকে আমরা প্রথমে বিক্রি করতে অনুরোধ করছি। নতুবা তাকে আমরা অন্যত্র জমি বদল দিবো। তবে এখানো অনেকে ভূয়া দাতা সেজে জমির মালিকানা দাবী করছে। সেই সাথে বিভিন্ন মহলের ইন্ধনে তারা বিশৃংখলা সৃষ্টির চেষ্টাও করছে। আমরা ফসল হানি করলেও এর ক্ষতিপূরণ দিবো। তবে দ্রুতই আমাদের জমি দখলে নিতে নির্দেশনা রয়েছে। তবে কোম্পানীটি কৃষি খামারের নামে সাইনবোর্ড ঝুঁলালেও কেন সোলার পাওয়ার প্লান্ট নির্মাণের কথা বলছে তা নিয়ে কোন সদুত্তর দিতে পারেননি প্রতিষ্ঠানটির এই প্রতিনিধি।
দেবনগড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সলেমান আলী বলেন, স্থানীয় লোকজন সোমবার (৫ ফেব্রুয়ারী) দুপুরে আমাকে ফোন করে জানায়, সোলার কোম্পানির লোকজন তাদের গম, পেয়াজ, মরিচ ফসলের উপর ট্রাক্টর দিয়ে চাষ করে জমি দখলে নিচ্ছে। পরে ঘটনাস্থলে এসে দেখি স্থানীয় লোকজন ও কোম্পানীর লোকজন মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। পরে আমি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে দুই পক্ষকে সড়িয়ে দেই। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ওসি সহ উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে আমি বিষয়টি জানাই। পরে তারা ঘটনাস্থলে ছুঁটে আসেন। বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। আমরা দুই পক্ষকে নিয়ে বসবো। কেউ কারো জমি অন্যায়ভাবে দখলে নিতে পারবেনা।
তেতুঁলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফজলে রাব্বি বলেন, জমি বিক্রি না করলেও স্থানীয়দের ফসলি জমি দখল করে নেয়া হচ্ছে এমন খবর পেয়ে তেতুঁলিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান সহ ঘটনাস্থলে যাই। আমরা স্থানীয়দের ও কোম্পানিটির লোকজনকে তাদের জমির কাগজপত্র নিয়ে আমার কার্যালয়ে আসতে বলেছি। দুই পক্ষের কাগজপত্র যাচাই বাছাই করে দেখা হবে। তবে কৃষকদের কেউ জমি বিক্রি না করলে তাদের জমি কেউ দখলে নিতে পারবেনা। আমরা সার্বিক বিষয়ে খোঁজ রাখছি।
সান
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত