কর্তাদের চর দর্শন সমাচার
প্রকাশ: ৩ জুলাই ২০২২, ১১:৩৭ | আপডেট : ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৬:৫১
ভৌগলিক অবস্থান এবং ভূ-প্রকৃতির গঠনশৈলীর কারণে চর আমাদের দেশে অতি পরিচিত। আমাদের জাতীয় জীবনে চরের প্রভাব এবং ভূমিকাও রয়েছে ব্যাপক। সাধারণত নদীর মাঝখানে পলিমাটি জমে যে নতুন ভূমিখন্ড জেগে ওঠে সেটাই আখ্যায়িত হয় চর হিসেবে। দেশের ছোট বড় প্রায় সব নদীতেই রয়েছে চরের অস্তিত্ব। বলা হয়ে থাকে, যে নদী যত বেশি খরস্রোরতা সে নদীতেই চর পড়ে বেশি। তীব্র বেগে বয়ে চলার সময় নদী তার দু’পাশের যেসব মাটি বয়ে নিয়ে আসে, তা এক সময় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে একটি জায়গায় জমে চরের সৃষ্টি করে। ধীরে ধীরে তা বিস্তৃত ও উঁচু হয়ে মাথা তুলে জানান দেয় নতুন ভূমির। আমাদের প্রধান নদী পদ্মায় রয়েছে অসংখ্য চর। শুধু পদ্মা নয়, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, সুরমাসহ সব নদীতেই কমবেশি চর রয়েছে। নদীর ভাঙা-গড়ার খেলা চিরন্তন। একুল ভাঙে তো ওকুল গড়ে। এক কুল যখন ভেঙে নগর জনপদ ধ্বংস করে দেয়, তখন আপর পাড়ে বা মাঝখানে জেগে উঠতে থাকে নতুন ভূমি বা চর। এসব চরের কোনো কোনোটি স্থায়ী ভুমিতে রূপ নেয়, আবার কোনোটি কয়েক বছর পর বিলীন হয়ে যায়। রাজধানী ঢাকা সংগলগ্ন কামরাঙ্গীর চর তেমনি একটি চর। বুড়িগঙ্গা নদীর মাঝখানে জেগে ওঠা চরটি এখন ঘন জনবসতিপূর্ণ লোকালয়। আমাদের দেশে অনেক জায়গার নামের সাথে চর যুক্ত রয়েছে। কামরাঙ্গীর চরের কথা তো অেেগই বলেছি। এছাড়া চর ভদ্রাসন, ছেঙ্গার চর, পালের চর, চর জানাজাত, চর ফ্যাশন, চর তমুজদ্দিন, উড়ির চর, কুলিয়ার চর, চালাক চর, শেখের চর, ভবের চর, চর বিশ্বনাথ, সাপের চর ইত্যাদি বেশ পরিচিত এলাকা। নদীর মধ্যে জেগে ওঠা চরে মানুষের বসতি স্থাপনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে এসব জনপদ। লক্ষণীয় হলো, নদীতে জেগে ওঠা চরে যারা বসবাস করতে আসেন তারা কোনো পূর্ব প্রশিক্ষণ থাকে না। প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে তারা আলাদা সমাজ গড়ে তোলে। তাদেরকে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয় প্রকৃতির রুদ্র আচরণের বিরুদ্ধে। প্রকৃতির বৈরিতাই তাদেরকে টিকে থাকার কায়দা শিখিয়ে দেয়। এভাবেই চলে আসছে যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী।
এক সময় নদীর মাঝখানে নতুন চর জেগে উঠলে তা দখলের প্রতিযাগিতা শুরু হতো । দাঙ্গা-হাঙ্গামা, খুন-খারাবি হতো। নতুন চরে না থাকে কোনো সামাজিক নিয়ম কানুন, না থাকে রাষ্ট্রীয় আইনের বালাই। অনেকটা জোর যার মুল্লুক তার অবস্থা। যার লাঠির জোর বেশি, সেই বিস্তার করতে পারত আধিপত্য। চরে আধিপত্য বা দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য কত যে খুন-খারাবি হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। নদী ভাঙনে একদা সর্বস্বান্তরা নতুন জেগে ওঠা চরে নতুন করে বসতি স্থাপনের স্বপ্ন দেখলেও জোতদার-মহাজনদের কারণে তাদের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। আগেকার দিনের জমিদার-জোতদাররা লাঠিয়াল বাহিনী পুষত এই জেগে ওঠা চর দখল এবং তাতে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য। এমনই চর দখলের ঘটনাকে উপজীব্য করে প্রয়াত প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার নারায়ন ঘোষ মিতা নির্মাণ করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত ছবি ‘লাঠিয়াল’। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিজয়ী এই ছবিটি বিপুল দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল। প্রখ্যাত সাংবাদিক ও সাহিত্যিক মরহুম সানাউল্লাহ্ নূরী তাঁর উপন্যাস ‘রোহিংগা কন্যা’য় টেকনাফের নাফ নদীর চরে মানুষের জীবনযাত্রাকে অত্যন্ত সূচারুরূপে তুলে ধরেছেন। নদীর বুকে জেগে ওঠা চরে ভূমিহীন মানুষেরা অনেক সময় আশ্রয় নেয়। তারা যে যার মতো ঘরবাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করে, জমি আবাদ করে জীবন ধারণের চেষ্টা করে থাকে। এজন্য তাদেরকে কোনো প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয় না। প্রয়োজনই তাদের শিখিযে দেয় কীভাবে চরের জমিকে ব্যবহার করতে হবে। তবে সাম্প্রতিককালে সরকার এ বিষয়ে নজর দিয়েছে। নতুন জেগে ওঠা চর যাতে কেউ লাঠির জোরে দখল করতে না পারে সেজন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার সরকারী ভূমি অফিস প্রয়োজনীয় তদারকি করে থাকে। যে জায়গায় চর জেগে ওঠে, নদী ভাঙনের আগে সে জায়গার মালিক কারা ছিল, পূর্বের দালিল দস্তাবেজ দেখে তা নিরূপন করে মালিকানা বুৃঝিয়ে দেওয়া হয়। অবশ্য এ সুযোগে ভূমি অফিসসহ সরকারী সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তা কর্মচারিরা টু পাইস কামিয়ে নিতে ভোলেন না। তারপরও কয়েক যুগ আগে নদীতে জেগে ওঠা নতুন চরের মালিকানা নিয়ে যে অরাজক পরিস্থিতি ছিল, এখন তা নেই।
আচ্ছা, বাংলাদেশের বাইরে পৃথিবীর অন্যকোনো দেশে কি চর আছে? হ্যাঁ, ভারতের ভাটি অঞ্চলে চর রয়েছে বলে আমরা মানচিত্রে দেখতে পাই। বিশেষত পশ্চিম বঙ্গে। এর কারণ হলো পশ্চিম বঙ্গ এবং বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অনেকটা একই রকম। সুতরাং কেউ যদি ইচ্ছা পোষণ করেন, পশ্চিম বঙ্গ তথা ভারতের চর দেখবেন, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু অষ্ট্রেলিয়া কিংবা আমেরিকায়? সেখানে কি বাংলাদেশের মতো নদীতে জেগে ওঠা চর আছে? না, এমন কোনো কথা এর আগে শোনা যায় নি। তা শোনা না গেলেও ওইসব দেশে গিয়ে চরের মানুষদের কীভাবে উন্নয়ন করা যায় সে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য আমাদের সরকারী কর্মকর্তাদের ভ্রমণের খবর আমরা শুনলাম। চমকপ্রদ এই খবকরটি বেরিয়েছে গত ২৯ জুন আজকের পত্রিকায়। খবরে বলা হয়েছে, চরের মানুষদের উন্নয়ন কীভাবে করা যায়, সে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ের ২০ জন সরকারী কর্মকর্তাকে পাঠানো হচ্ছে সুদূর অষ্ট্রেলিয়া ও আমেরিকায়। তাদের মধ্যে ইতোমধ্যে ৯জন প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে প্রচুর অভিজ্ঞতা থলেতে ভরে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেছেন। খবরে বলা হয়েছে, যে প্রকল্পের অধীনে কর্তাদের এই অভিজ্ঞতা অর্জন কর্মসূচি, তার নম ‘চর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট প্রজেক্ট ব্রিজিং-সিডিএসপি-বি)। ১১ কোটি টাকা প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা গত ৩০ জুন। তাই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই প্রকল্পের টাকায় কর্মকর্তাদের প্রমোদ ভ্রমণের এই বন্দোবস্ত। সংশ্লিষ্ট সরকারী কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে পত্রিকাটি জানিয়েছে, এই প্রকল্পে সহকারী কমিশনার ভূমি পদের ওপরে কারো অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর সুযোগ নেই। কিন্তু সফর তালিকায় রয়েছেন সচিব, মন্ত্রীর পিএস, সচিবের পিএস, দুই জেলা প্রশাসক, দুই অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন পদ-পদবীর কর্মকর্তা। প্রশ্ন হলো- যুক্তরাষ্ট্র বা অষ্ট্রলিয়ায় কি চর আছে, না ভূমিহীন মানুষ আছে? তাহলে কেন এসব দেশে প্রশিক্ষণের জন্য কর্মকর্তাদের পাঠানো হচ্ছে- পত্রিকাটির সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের কোনো জবাব দেন নি প্রকল্পটির পরিচালক ও নোয়াখালী জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলেছেন, চর উন্নয়ন দেখার জন্য অষ্ট্রেলিয়া যুক্তরাষ্ট্র যেতে হবে? অজুহাতের তো একটা সীমা থাকা দরকার! এ সফরের ফলাফল কোনো কাজে আসবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন। এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান পত্রিকাটিকে বলেছেন, যারা এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত, বিষয়টি খতিয়ে দেখাও উচিত। সবচেয়ে কৌতুককর বিষয় হলো, সফরকারী কর্মকর্তারা তাদের লব্ধ অভিজ্ঞতা চর ও চরবাসীদের উন্নয়নে কাজে লাগাবেন বলা হলেও ইতোমধ্যে তাদের কয়েকজন অবসরে গেছেন, কেউ কেউ বদলী হয়ে গেছেন অন্য মন্ত্রণালয় বা বিভাগে। তাহলে কেন এই রাষ্ট্রীয় অর্থের মচ্ছব? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলেই কেঁচো খুড়তে সাপ বেরিয়ে পড়ার মতো আসল সত্যটি প্রকাশ হয়ে পড়বে। সরকারী কর্মকর্তাদের এ ধরনের বহু সফর হয়ে থাকে যেগুলো দেশ ও জাতির কোনো কাজে লাগে না। তারপরও তারা বিদেশে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য হাওয়াই জাহাজে চড়ে ঘুরে বেড়ান। কাজের কাজ কিছু হলো কি না হলো তাতে কারো ভ্রুক্ষেপ নেই। কর্তাদের মনোরঞ্জন হলো কিনা সেটাই বড় কথা। দেশে তারা এতই ব্যস্ত থাকেন, কাজ করতে করতে এতটাই গলদঘর্ম হন যে, তাদের একটু শ্রান্তি-বিনোদন দরকার। আর সে বিনোদনের জন্য দরকার বিদেশ ভ্রমণ। টাকা? সে তো দেবার জন্য রাষ্ট্র নামের গৌরী সেন আছেই। কথায় আছে ‘সরকার কা মাল দরিয়ামে ঢাল।’ সে মাল ঢেলে দেশ বা জনগণের কোনো উপকার হলো কিনা, কোনা কাজে লাগলো কিনা সেটা দেখার দরকার নেই।
বাংলাদেশের চরের কোনো অভাব নেই। ওই সব চর বা চরবাসীর জীবন-মান উন্নয়নের প্রকল্প গ্রহণের জন্য বিদেশে যেতে হবে কেন? চরে গিয়ে সরাসরি দেখলেই তো বোঝা যেতে পারে কোথায় কী ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু তা না। যেতে হবে বিদেশে। শুধু কি এবারের চর উন্নয়ন? এর আগে আমরা পুকুর কাটার অভিজ্ঞতা অর্জন এবং স্কুল শিক্ষার্থীদের জন্য খিচুড়ি রান্নার ওপর প্রশিক্ষণ নিতে কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের খবর শুনেছিলাম। সে সময় এক ক্ষুব্ধ ভদ্রলোক বলেছিলেন, সারা দেশে লক্ষ লক্ষ পুকুর রয়েছে, এগুলো তো দেশের মজুরেরাই কেটেছে। তাদের কাছে প্রশিক্ষণ নিলেই তো হয়। বিদেশে যেতে হবে কেন? আর আমাদের মায়েরা তাদের শিশু সন্তানদের যে সবজি খিচুড়ি রেঁধে খাওয়ান, তার ট্রেনিং তারা মা বা শাশুড়ির কাছ থেকেই নেন, বিদেশে যেতে হয় না তাদের। আসলে এসব ঠুনকো অজুহাতে সরকারী কর্মকর্তাদের উড়াল দেওয়ার এ প্রবণতা এক ধরনের ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে।
তবে হ্যাঁ, আমাদের সরকারী কর্মকর্তাদের একটি ব্যাপারে বিদেশে প্রশিক্ষণ দরকার বলে আমার মনে হয়। সেটা হলো দায়িত্ব-কর্তব্য কীভাবে নিষ্ঠার সাথে পালন করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য তাদেরকে বিদেশে পাঠানো যেতে পারে। বছর চল্লিশেক আগের কথা। বিশিষ্ট সাংবাদিক আবেদ খান তখন দৈনিক ইত্তেফাকে কর্মরত এবং ‘নিবেদন ইতি’ নামে একটি কলাম লেখেন। এক লেখায় তিনি উল্লেখ করেছিলেন, জাপানের শ্রমিক-কর্মচারিরা সহজে কেউ ছুটি নিতে চায় না। কারণ তিনি ছুটি নিলে তার সহকর্মীর ওপর কাজের বাড়তি চাপ পড়তে পারে। আবেদ খান তাঁর লেখায় প্রস্তাব করেছিলেন, আমাদের দেশের ছুটি কাটাতে অভ্যস্ত কর্মকর্তাদের জাপানে পাঠিয়ে ছুটি না কাটিয়ে কীভাবে দায়িত্ব পালন করতে হয় সে ট্রেনিং দেওয়ার জন্য। পাশাপাশি তিনি এ আশংকাও ব্যক্ত করেছিলেন, হয়তো তাতে হিতে বিপরীতও হতে পারে। দেখা গেল আমাদের কর্মকর্তাদের সংস্পর্শে এসে কাজ না করে অলস সময় কাটনোর রোগটি জাপানিদের দেহে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে।
তেমনি দায়িত্ব ও কর্তব্য নিষ্ঠার সাথে পালনের চাক্ষুস অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য আমাদের কর্মকর্তাদের বিদেশে পাঠালে বিদেশিরাই হয়তো কাজে ফাঁকি, ঘুষ গ্রহণ, সরকারী তহবিল তছরুপ ইত্যাদি সব ‘সদগুণে’র ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে।
লেখকঃ সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত