কন্যাশিশুর সাথে ভ্রুণ হত্যার সম্পর্ক
প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২২, ১৪:৩৭ | আপডেট : ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:২০
কন্যাশিশু হত্যা (অন্য অর্থে ভ্রূণহত্যা ) হল নবজাত শিশুকন্যাকে স্বেচ্ছাকৃত হত্যা। যেসব দেশে কন্যাশিশু হত্যার ইতিহাস আছে সেখানে একটা কুপ্রথা হল আধুনিক বিজ্ঞানের প্রয়োগে লিঙ্গের নির্ধারণ করে অবাঞ্ছিত হলে গর্ভপাত করানোর অভ্যাস। চিন, ভারত এবং পকিস্তানএর মতো বিভিন্ন দেশে এই কন্যাশিশু হত্যা একটা প্রধান উদ্বেগের কারণ। এটা সওয়াল করা হয় যে, পুরুষপ্রধান সমাজে নারীদের সব সময় দাবিয়ে রাখার প্রবণতা থেকেই নারীদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্ব করা হয়।
কন্যা ভ্রূণ হত্যা অনগ্রসর উপমহাদেশীয় সমাজে এখনো এক বড় সমস্যা। বিশ্বের সবচেয়ে অধিক ভ্রূণহত্যায় পাকিস্তান এখনো পর্যন্ত প্রথম,ভারত দ্বিতীয় এবং বাংলাদেশ পঞ্চম অবস্থায় আছে।পাকিস্তান এর আর্থসামাজিক বিপর্যয় ও এই ধরনের সংবেদনশীল সংবাদ প্রাপ্তির অপ্রতুলতা থাকায় ধরা হয় পাকিস্তানে সরকারী হিসেব ৫০/১০০০ হলেও প্রকৃত সংখ্যা প্রতি ১০০০ এ ৬৫ এর অধিক হবে।ভারতে তা প্রতি ১০০০ এ ৪৭ এবং বাংলাদেশে ৩৯।
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয়, তখন তার মুখ অন্ধকার হয়ে যায় এবং অসহ্য মনস্তাপে ক্লিষ্ট হতে থাকে। তাকে শোনানো সুসংবাদের দুঃখে সে লোকদের কাছ থেকে মুখ লুকিয়ে থাকে। সে ভাবে, অপমান সহ্য করে তাকে থাকতে দেবে নাকি তাকে মাটির নিচে পুতে ফেলবে। শুনে রাখো, তাদের ফয়সালা খুবই নিকৃষ্ট। ’ (সুরা আন-নাহল, আয়াত : ৫৮-৫৯)
রাসুল (সা.) মেয়েদের অনেক বেশি ভালোবাসতেন। মেয়েরা ছিল তার আদরের দুলালী। আজীবন তিনি কন্যাদের ভালোবেসেছেন এবং কন্যা সন্তান প্রতিপালনে অন্যদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। কন্যা সন্তান লালন-পালনে অনেক উৎসাহ দিয়েছেন।
পবিত্র বেদ যেখানে কন্যা সন্তান প্রাপ্তিকে বিরাট সৌভাগ্য বলে ঘোষণা করে সেখানে বেদজ্ঞান এর অভাবে ভারত-নেপালের মত জায়গায় প্রচুর কন্যা ভ্রূণহত্যা সংগঠিত হয় যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
পবিত্র ঋগ্বেদ ৮.৩১.৮ বলছে- পুত্রিনা তা কুমারিনা বিশ্বমায়ুর্বৈশ্নুতঃ।
উভা হিরণ্যপেশস।।
অর্থাৎ কন্যা সন্তান প্রাপ্তি জগতে সুখের সাথে বেঁচে থাকার ও কল্যান লাভ করার এক হিরণ্য(সোনালী) উপায়।
আজ থেকে ২৫০০ বছর আগে বৌদ্ধধর্মের জনক মহামানব গৌতম বুদ্ধ কপিলাবস্তু রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন। বুদ্ধের জন্মের আগে প্রাচীন ভারতবর্ষে নারীদের অবস্থান ছিল চার দেয়ালে বন্দী। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীদের জীবন ছিল স্বামী কিংবা পুত্রদের অধীন। নানা সামাজিক কুসংস্কার, বৈষম্য ও অবহেলায় নারীরা ছিল জরাগ্রস্ত। গৌতম বুদ্ধ তিনি সুদীর্ঘ ৪৫ বছর মানবের কল্যাণের জন্য ধর্মপ্রচার করে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন এবং তিনি কোনো বিশেষ সম্প্রদায় কিংবা বিশেষ লিঙ্গের জন্য ধর্মের দেশনা দেননি, তাঁর দৃষ্টিতে নারী-পুরুষ সবাই সমান ছিল।
১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে নৃবিজ্ঞানী লায়লা উইলিয়ামসন তার একত্র করা তথ্যের একটা সংক্ষিপ্তসার থেকে জানতে পারেন শিশুহত্যা কত বিস্তৃত ছিল, দেখা যেত যে, প্রত্যেক মহাদেশেই শিশুহত্যা সংঘটিত হয়েছে এবং এগুলো শিকারি সংগ্রাহকসমূহ থেকে উন্নত সমাজ সকলের দ্বারাই সংগঠিত হোত; এবং এই অভ্যাস একটা ব্যতিক্রম ছিলনা, বরং এটা ছিল খুবই সাধারণ।[২] অস্ট্রেলিয়া, আলাস্কা এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশীয় জনগণের মধ্যে এই অভ্যাস ভালোভাবেই নথিভুক্ত করা ছিল, এবং বারবারা মিলারের মত অনুযায়ী এই অভ্যাস 'প্রায় বৈশ্বিক', এমনকি পশ্চিমেও। মিলার যুক্তি দেন যে, যেখানে মহিলারা কৃষিকাজে নিযুক্ত নেই এবং যেখানে কন্যাপণ একটা প্রথা সেখানে কন্যাশিশু হত্যা একটা প্রচলিত ব্যাপার। ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে চার্লস ডারউইন তার দ্য ডিসেন্ট অফ ম্যান, অ্যান্ড সিলেকশন ইন রিলেশন টু সেক্স বইতে লিখেছেন যে, এই অভ্যাস অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী উপজাতিদের মধ্যে প্রচলিত ছিল।
১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে অমর্ত্য সেন নিউ ইয়র্ক রিভিউ বুকস্এ বর্ণনা করেছেন যে, এশিয়ায় ১০ কোটি কম মহিলা অনুমান করা যায়, এবং যে 'হারিয়ে যাওয়া' সংখ্যাটা "আমাদের নীরবে একটা ভয়ংকর অসমতার গল্প বলে এবং যা মহিলাদের বাড়তি মরণশীলতার কারণ।" প্রাথমিকভাবে অমর্ত্য সেনের লিঙ্গ পক্ষপতিত্বের পরামর্শ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিল এবং এটা বলা হয়েছিল যে, হেপাটাইটিস বি, স্বাভাবিক লিঙ্গ অনুপাতএর পরিবর্তনের কারণ। যাইহোক, এটা বর্তমানে বিস্তারিতভাবে মেনে নেওয়া হয় যে, বিশ্বব্যাপী মহিলার সংখ্যা কম হওয়ার কারণ হল লিঙ্গবিশেষে গর্ভপাত করানো, কন্যাশিশু হত্যা এবং অবহেলা।
সপ্তম শতকের আরবএ, ইসলাম ধর্মীয় সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার আগে কন্যাশিশু হত্যা ব্যাপকভাবে চালু ছিল। এটা পণ্ডিতদের দ্বারা আরোপিত একট প্রথা ছিল যাতে মহিলাদেরকে সমাজের 'সম্পদ' হিসেবে দেখা হোত। অন্যেরা অনুমান করত যে, একটা দারিদ্র্যের জীবন থেকে প্রতিরোধ করার জন্যে মায়েরা কন্যাশিশুকে হত্যা করবে। ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠার পর এই কন্যাশিশু হত্যা বেআইনি হয়ে যায়।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত