একটি মৃত্যু ম্লান করে দিল ঈদ-আনন্দ
প্রকাশ: ১৭ জুলাই ২০২২, ১৫:০২ | আপডেট : ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৭:২১
দীর্ঘ দুই বছর পর এবার ঈদে বাড়ি গিয়েছিলাম। করোনা সংক্রমণজনিত কারণে গত দুই বছর ঈদে বাড়ি যাওয়া হয়নি। রাজধানীর নিকটবর্তী এলাকা হওয়ায় আমার গ্রামের বাড়ি যেতে ঝক্কি-ঝামেলা কমই। মাত্র একত্রিশ কিলোমিটারের পথ। ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পাশেই আমাদের গ্রাম মাশুরগাঁও। মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলায় এর অবস্থান। আগে আমরা ঢাকা জেলার অন্তর্গত ছিলাম। এক সময় ঢাকা-শ্রীনগর যাতায়াতের একমাত্র বাহন ছিল লঞ্চ । তারও আগে আমাদের এলাকার মানুষ গয়নার নৌকায় রাজধানীতে যাতায়াত করত। সেটা অবশ্য বিভাগপূর্ব ব্রিটিশ আমলের কথা। পাকিস্তান হওয়ার পর ঢাকা-শ্রীনগর লঞ্চ সার্ভিস চালু হয়। প্রথম ল টির নাম ছিল ‘এম এল স্বাধীন’। এর মালিক ছিলেন প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী ফেরদৌস ওয়াহিদের পিতা ওয়াহিদ সাহেব। তিনিও শ্রীনগর উপজেলার বাসিন্দা। দক্ষিণপাইকশা তাঁর গ্রামের নাম। ছেলেবেলায় আমরা দেখেছি বড় বড় সব ঝকঝকে লঞ্চ শ্রীনগর বাজারের উত্তর পাশে লঞ্চ ঘাটে বাঁধা থাকত। হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন সেসব লঞ্চে যাতায়াত করত। বর্ষায় লঞ্চ গুলো আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খাল দিয়ে লৌহজং উপজেলার গোয়ালিমান্দ্রা পর্যন্ত যাতায়াত করত। ১৯৮৪ সালে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক চালু হওয়ার পর ঢাকা-শ্রীনগর লঞ্চ সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের গ্রামের পাশের যে খাল দিয়ে লঞ্চ চলাচল করত, এখন তা একটি নালায় পরিণত হয়েছে। শুকনো মওসুমে খালে কোনো পানি থাকে না। খালের দু’ পাড়ের অনেক জায়গা চলে গেছে প্রভাবশালীদের দখলে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সরকারের আমলের পর খালটিতে আর কোদালের কোপ পড়েনি। ফলে এর তলা ভরাট হয়ে নাব্য কমে গেছে। বর্ষাকালে কিছু জোয়ারের পানি পদ্মা থেকে এলেও নাব্য সংকটের কারণে কোনো নৌযান চলাচল করতে পারে না। কচুরিপানায় ভর্তি স্রোতহীন খালটি চলৎশক্তিহীন বৃদ্ধের প্রতিচ্ছবি যেন। অথচ এক সময় খরস্রোতা এ খাল দিয়ে বরিশাল ফরিদপুর থেকে ৫শ-হাজার মণের পণ্যবাহী নৌকা ঢাকায় যাতায়াত করত। বর্ষাকালে বিশাল বিশাল পাল উড়িয়ে চলে যাওয়া নৌকা এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা করত।
ঢাকা মাওয়া মহাসড়ক চালু হওয়ার পর আমাদের যাতায়াতের দুর্ভোগ অনেকাংশেই কমে আসে। দেড় দুই ঘণ্টায় দুুটি ফেরি পেরিয়ে আমরা গন্তব্যে পৌঁছতাম। ধলেশ্বরী নদীর ওপর জোড়াসেতু হওয়ার পর সে সময় আরো কমে আসে। আর এখন ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেস ওয়ে চালু হওয়ায় পোস্তগোলা থেকে আমার গ্রামে যেতে সময় লাগে মাত্র বিশ মিনিট। নিজেকে আমার পরম সৌভাগ্যবান বলেই মনে হয়। এক জনমে এত উন্নতি দেখা সৌভাগ্যই তো বটে।
গত ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেছেন পদ্মা সেতু। এ সেতু চালু হওয়ায় পদ্মার ওপারের ২১ জেলার জনজীবনে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। যাতায়াতের ক্ষেত্রে এতদিন তাদের যে দুর্ভোগ পোহাতে হতো এখন তা নেই। সহজেই তারা ঢাকায় চলে যেতে পারছে। কিন্তু দুর্ভোগ বেড়েছে এপারের, মানে শ্রীনগর-লৌহজংয়ের মানুষদের। যেসব বাস এতদিন মাওয়া-শিমুলিয়া থেকে ঢাকায় যাতায়াত করত, তার সবই চলে গেছে মাদারীপুর, শিবচর কিংবা জাজিরায়। ওইসব বাস মাওয়া বা শ্রীনগর থেকে কোনো যাত্রী তুলছে না। এমনকি ঢাকা থেকেও শ্রীনগর-মাওয়ার কোনো যাত্রী নিতে চায় না। এলাকাবাসী এই দুর্ভোগ থেকে বাঁচার জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে। অনেকের সাথেই আলাপ হয়েছে এ ব্যাপারে। তারা জানালেন, এখন ঢাকা-ভাগ্যকূল রুটের আরাম পরিবহন, মাশুরগাঁও-নয়াবাজার মিনিবাস এবং মাওয়া পরিবহনের (ইলিশ) কুড়িটি বাসই তাদের ভরসা। অথচ এ স্বল্প সংখ্যক বাস প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই নগণ্য। মাওয়া-শ্রীনগর এলাকার বহু মানুষ, যারা ঢাকায় সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন, তারা প্রতিদিন যাওয়া আসা করেন। এই ডেইলি পেসেঞ্জারদের পড়তে হয়েছে সবচেয়ে বড় ঝঞ্ঝাটে। অনেকেই আবার ঢাকায় আবাস গাড়ার কথা ভাবছেন। এ সমস্যার সমাধান খুবই জরুরি। নাহলে ঢাকার ওপর চাপ কমানোর যে স্বপ্ন আমরা দেখি, তা দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে। স্থানীয় জনসাধারণ বলছেন, সরকার যদি বাস মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে এই রুটে নতুন করে বাস সার্ভিস অথবা বিআরটিসির সার্ভিস চালু করে, তাহলেই সমস্যার সহজ সমাধান সম্ভব।
শিমুলিয়া ঘাটের অবস্থা এখন হাটভাঙা মাঠের মতো। কোথাও কেউ নেই। এক সময় যে ঘাটে দিবারাত্রি চব্বিশ ঘণ্টা মানুষ গমগম করত, কোলাহল-চিৎকার-চেঁচামেচি, বাসের হর্ন, হেল্পার-ড্রাইভারদের হাঁকডাক, ল -ফেরির ভেঁপুর আওয়াজ আর হকারদের চিৎকারে যে জমজমাট পরিবেশ ছিল, এখন তার বালাই নেই। শ’ খানেক খাবারের দোকান বা রেঁস্তোরা ছিল শিমুলিয় ঘাটে। সেগুলোর বেশিরভাগই বন্ধ হয়ে গেছে। হিলশা, শখের হাঁড়ির মতো কয়েকটি বিলাসবহুল রেঁস্তোরা এখনও রয়েছে। তবে খদ্দেরের ভিড় কমে গেছে অনেকটাই। শিমুলিয়া ঘাট এখন জনমানবহীন ধু-ধু প্রান্তর ছাড়া আর কিছুই নয়। মাঝে মাঝে পদ্মা থেকে আসা দমকা হাওয়া ধুলো উড়িয়ে যেন জানান দেয়, সবার সব দিন সমান যায় না। অবশ্য ঈদের পরদিন কিছু মানুষ এই ঘাটে এসে আনন্দে মেতে ওঠার চেষ্টা করেছিল। তারা স্পিডবোট ভাড়া করে পদ্মায় আনন্দ ভ্রমণ করেছে। অনেকেই বললেন, সরকার উদ্যোগ নিলে পরিত্যাক্ত শিমুলিয়া ঘাট একটি আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট হতে পারে। অবশ্য এখানে একটি ইকো-পোর্ট গড়ে[ তোলার সরকারি পরিকল্পনার কথা শোনা যাচ্ছে। যদি তা বাস্তবায়িত হয়, তাহলে একটি বড় কাজ হবে, যা এই এলাকার অর্থ-সামাজিক অবস্থাকে অনেকটাই বদলে দিতে সক্ষম হবে।
আমাদের সেই গ্রাম এখন আর অজপাড়াগাঁ নেই। ক্রমেই তা রূপ নিচ্ছে নগরের। ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক ধরে চললে আপনি দু পাশে দেখতে পাবেন হাউজিং ও রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলোর বিশাল বিশাল বিলবোর্ড-সাইনবোর্ড। ফসলি জমিতে গেড়ে রাখা ওইসব সাইনবোর্ড জানান দিচ্ছে অচিরেই সবুজ শ্যামল ধানক্ষেত আর দেখা যাবে না। তার পরিবর্তে এখানে সেখানে গড়ে উঠবে বহতল ইমারত। রড সিমেন্টের কাছে পরাজিত হয়ে ছায়া সুনিবিড় গ্রামগুলো হারিয়ে যাবে। এখনও চাষের মৌসুমে মহাসড়কের দুপাশে আদিগন্ত বিস্তৃত সবুজ প্রান্তর চোখে পড়ে। ধান পেকে এলে তা ধারণ করে অপরূপ সোনালী রং। ক’দিন পরে হয়তো তা আর থাকবে না। ফসলি জমিতে আবাসন প্রকল্প গড়ার ক্ষেত্রে সরকারি নিষেধাজ্ঞা নাকি রয়েছে। তবে সে আইন হয়তো কাজির গরুর মতো খাতায় আছে গোয়ালে নেই। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হাউজিং কোম্পানিগুলো ফসলি জমিতে আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলছে। গ্রামকে যদি তার আবহমান রূপে ধরে রাখতে হয়, তাহলে এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ অতীব জরুরি।
শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি বিজড়িত সেই গ্রামে সবার সঙ্গে ঈদ পালন এক অনির্বচনীয় আনন্দের বিষয়। দেশের অন্যান্য এলাকার মতোই আমাদের এলাকার লোকজনও ঈদ পালনের জন্য ছুটে আসেন গ্রামে। জীবন জীবিকার প্রয়োজনে ঢাকা কিংবা দেশের অন্য কোনো শহর বা স্থানে বসবাস করলেও ঈদের ছুটিতে তারা চেষ্টা করেন নাড়ি পোতা গাঁয়ে এসে নিঃশ্বাস নিতে। এই ছুটে আসার মধ্যে রয়েছে বাঙালির শিকড়ের প্রতি আজন্ম টানের বিষয়। মনে আছে একবার ঈদের আগে একটি টিভি টকশোতে আলোচনা হচ্ছিল ঈদে ঘরমুখো মানুষের দুর্ভোগ নিয়ে। বাংলাদেশে ছাড়া পৃথিবীর অন্যকোনো দেশের মানুষ তাদের উৎসব পার্বনে এভাবে জন্মস্থানের দিকে ছুটে যায় কিনা তা নিয়ে কথা উঠল। আমি বলেছিলাম, যদিও আমি নিশ্চিত করে বলতে পারবো না, এমনটা হয় কিনা। তবে মনে হয় বাংলাদেশের মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয় না। ঈদ-পার্বনে বাংলাদেশের মানুষ যেভাবে দূরদূরান্ত থেকে গ্রামে ছুটে যায়, সেভাবে হয়তো অন্য কনো দেশের মানুষ যায় না। এর প্রধান কারণ, আমাদের দেশের মানুষের আত্মীয়তার বন্ধনের প্রতি প্রগাঢ় অনুভূতি। আমাদের ফ্যামিলী বন্ডিং এতটাই মজবুত যে, যেকোনো উৎসব আমরা একাকী উপভোগ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করিনা। সবাই মিলে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতেই আমরা পছন্দ করি। যেজন্য ঈদ উপলক্ষে গ্রামে ছুটে যাওয়ার এই তীব্র প্রতিযোগিতা। অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণকারী সবাই একমত হয়েছিলেন এ বিষয়ে।
বস্তুত আমরা আধুনিক হলেও এখনও বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার মতো আধুনিক হয়ে যাইনি। যদিও সমাজে ইদানীং আত্মকেন্দ্রিকতার ভাইরাস ছড়াতে শুরু করেছে। তবে গ্রামে এখনও প্রাণের স্পন্দন রয়েছে। গ্রামবাসীরা একে অপরের সুখ-দুঃখের ভাগিদার হয় এখনও। ঈদের পরের দিন সকালে যাচ্ছিলাম শ্রীনগর বাজারে। গ্রামের উত্তর প্রান্তের মোল্লাবাড়ির কাছে যেতেই পেলাম একটি ভয়াবহ দুঃসংবাদ। ওই বাড়ির এক যুবক, যার স্ত্রী এবং দুটি শিশু সন্তান রয়েছে, সে নিহত হয়েছে গাড়ি চাপায়। আলম নামের ওই যুবক চাকরি করত ঢাকায় একটি পোশাক কারখানার কর্মকর্তা পদে। বাবা মার সাথে ঈদ উদযাপন করতে সে ছুটে এসেছিল গ্রামে। বন্ধুর আমন্ত্রণে ঈদের পরদিন সকালে গিয়েছিল তার সঙ্গে দেখা করতে। এক্সপ্রেসওয়ের পাশের লোকাল রোড ধরে সাইকেলে বাড়ি ফিরছিল সে। এমন সময় পেছন থেকে একটি পুলিশভ্যান ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় তাকে। অনিয়ন্ত্রিত ওই গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে আলম ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। হাইওয়ে পুলিশ অবশ্য দায়িত্ব এড়াতে গল্প ফাঁদতে চেয়েছিল। তবে একই দুর্ঘটনায় আহত সিএনজি স্কুটারের ড্রাইভারের সাক্ষ্য তাতে বাঁধ সেধেছে। স্থানীয় সাংবাদিকদের ত্বরিত তৎপরতায় সাথে সাথে সে খবর প্রচার হয়েছে গণমাধ্যমে। তরতাজা এ যুবকটির মৃত্যুতে পুরো গ্রাম মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেল। আলমের মা-বাবা-স্ত্রীর আহাজারিতে বাতাস ভারি উঠল। উপস্থিত সব্রা চোখ ছিল অশ্রুসিক্ত। বলা যায় আলমের মৃত্যু আমাদের গ্রামের মানুষের ঈদ পরবর্তী আনন্দ ম্লান করে দিয়েছে। এভাবে অসর্তকতা, দায়িত্বহীন গাড়ি চালনা কত মানুষের জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিচ্ছে, তার হিসাব কে রাখে।
বছর ঘুরে আবার আসবে ঈদুল আযহা। আমরা সবাই আনন্দে মেতে উঠব। নিহত আলমের কথা হয়তো আমরা ভুলেই যাবো। কিন্তু ওর পরিবারের সদস্যরা কি ভুলতে পারবে এই দিনটি? প্রতি কোরবানির ঈদের পরদিন কি ওর স্ত্রীর বুকটা হাহাকার করে উঠবে না এই দুঃসহ স্মৃতি মনে করে? আর ওর শিশু সন্তান দুটি? বাবার কোনো স্মৃতিই হয়তো ওদের মনে থাকবে না। পিতৃহীন এই শিশু দুটি কীভাবে বেড়ে উঠবে কে জানে?
দুই বছর পরে গ্রামে গিয়েছিলাম ঈদের অনাবিল আনন্দে গা ভাসাতে। কিন্তু আলমের আকস্মিক ও মর্মান্তিক মৃত্যু সে আনন্দকে মলিন করে দিয়েছে। তাই বিষন্ন মনেই আবার ফিরে এসেছি কংক্রিটের খাঁচা এই মহানগরে।
লেখকঃ সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত