একজন পুরোধা ভাষাতত্ত্ববিদ ক্ষুদিরাম দাস
প্রকাশ: ৯ নভেম্বর ২০২২, ১১:১৫ | আপডেট : ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩:২৬
ক্ষুদিরাম দাস (৯ অক্টোবর ১৯১৬ – ২৮ এপ্রিল ২০০২) একজন পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ, সমালোচক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও একজন ভাষাতত্ত্ববিদ ছিলেন।
তিনি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কবিকঙ্কন চণ্ডী সম্পাদনা করেন ১৯৭৬ সালে।ক্ষেত্র-গবেষণা ও ভাষাতাত্ত্বিক অন্তর্দৃষ্টিতে কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলের যথার্থ পাঠ নির্ণয় করেছিলেন, এইটি তার ঐতিহাসিক প্রজ্ঞার পরিচয়। ছন্দবিশারদ প্রবোধ চন্দ্র সেন তাকে এক চিঠিতে লিখেছেন ' আপনার চণ্ডীমঙ্গল সম্পাদন একটি মহৎ কাজ হিসাবে স্মরণীয় হয়ে থাকার যোগ্য। বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবির প্রতি সমস্ত জাতির পক্ষে একটি বৃহৎ কর্তব্য সাধন করেছেন। এতদিনে এই কবির প্রতি আমাদের জাতীয় কর্তব্য নিষ্পন্ন হল। আপনি সমগ্র জাতির আশীর্বাদভাজন হয়েছেন। তবু দুঃখের কথা এই যে, একাজ আপনাকে করতে হয়েছে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায়। সরকার বা কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এবং অর্থ সাহায্যে এই জাতীয় কর্তব্য সম্পন্ন হওয়াই উচিত ছিল। তা হয়নি, এটাই দুঃখ ও দুর্ভাগ্যের বিষয়। কিন্তু তাতে আপনার কৃতিত্বই আরও উজ্জ্বল হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে এইজন্য আমি একক অভিযাত্রী হিসাবে আপনাকে অভিনন্দন জানাই। আর এই দুঃসাধ্য কাজের জন্য উত্তরাধিকারীরা সবাই কৃতজ্ঞচিত্তে আপনাকে আশীর্বাদ জানাবেন ---দেশমাতৃকার আশীর্বাদ। এই বই যদি আমি আরও কিছুদিন আগে পেতাম তাহলে বড় উপকৃত হতাম-বড় কাজে লাগত। আশা করছি এখনও কিছু কাজে লাগতে পারে '। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রবীন্দ্র প্রসঙ্গ (বাংলা ও ইংরেজিতে) তিনি সম্পাদনা করেন। ১৯৮২ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত তিনি প্রধান সম্পাদক ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক বোর্ডের অধীনে বাংলা শব্দের ভাষাতাত্ত্বিক অভিধানের, যার নাম হল "Bengali Linguistic Dictionary for both Bengalis and Non-Bengalis"। ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রামতনু লাহিড়ী চেয়ার প্রফেসর পদ থেকে অবসর নিলেন। শুরু করলেন ভারতীয় ভাষা নিয়ে ভাষাকর্মযজ্ঞ। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাহায্যে অফুরন্ত প্রাণশক্তি নিয়ে, তৎকালীন প্রেসিডেন্সি কলেজের একটি অপরিসর কক্ষে মাত্র দুজন কর্মীকে নিয়ে সুরু করেন ভাষা ভুবনের এক ভিন্ন মহৎ সাধনা। সেই মহৎ সাধনা সুধা আজও প্রকাশিত হয়নি। ভাষাতাত্ত্বিক ক্ষুদিরাম দাসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ভাষাবিজ্ঞানের নতুন তত্ত্ব ও নিরীক্ষার ভিত্তিভূমিতে বাংলা- সাঁওতালি- মুণ্ডা-দ্রাবিড়- হিন্দি- ওড়িয়া- পর্তুগীজ- সংস্কৃত – তামিল – ইংরেজি প্রভৃতি ভাষায় আগমনের তুলনামূলক অভিধানটি প্রকাশিত হলে, তার ভাষা ঐশ্বর্যের ব্যাপক শক্তির প্রকাশ দেখতে পেতাম। আমরা সমৃদ্ধ হতাম। দুর্ভাগ্য কোনো এক রহস্য- ষড়যন্ত্রে লিঙ্গুয়িস্টিক ডিকশনারি ফর বেঙ্গলিস অ্যান্ড নন-বেঙ্গলিস’ অভিধানটি সরকারে ঘর থেকে হারিয়ে গেল। প্রায় অর্ধ শতাব্দীর ওপর তার লেখালেখি। বিরামহীন অক্লান্ত তার লেখনী চালনা। বহুবিচিত্র বিষয়ে কৌতূহলী তিনি। প্রাচীন ভারতীয় রসতত্ত্ব, সংস্কৃত সাহিত্য, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য, উনিশ ও বিশ শতকের বাংলা সাহিত্য, ভাষাতত্ত্ব, ব্যাকরণ, ছন্দ ও অলঙ্কার, সাহিত্যশৈলী, বিজ্ঞান ইত্যাদি নানান ব্যাপারে তার প্রবল অনুসন্ধিৎসা। সর্বোপরি রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্র-সাহিত্যের আলোচনায় তার অপরিমিত উৎসাহ, রবীন্দ্র-সাহিত্যের মর্মরহস্য উদ্ঘাটনে তিনি নিয়ত তৎপর, প্রায়শই আবিষ্কারকের ভূমিকায়। বাংলা মননশীল প্রবন্ধ সাহিত্যের ধারাটি তার লেখনী সঞ্চালনে পুষ্ট ও সমৃদ্ধ। এক হিসাবে উনিশ শতকীয় প্রবন্ধ সাহিত্যের নৈয়ায়িক ঐতিহ্যের তিনি অনুসারী। ভাষাতত্ত্ব এবং ছন্দতত্ত্ব নিয়েও তিনি মৌলিক চিন্তা করেছিলেন। ভাষাতত্ত্বের কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুকুমার সেনেরও বিরোধী হয়েছেন; ছন্দতত্ত্বের কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রবোধচন্দ্র সেনের প্রতিবাদ করেছেন।প্রবোধচন্দ্র সেন এক চিঠিতে তাকে লিখেছেন 'আমি তো কখনও নিজেকে অভ্রান্ত মনে করি না। সারা জীবনে কত ভুল করেছি (ছন্দের ব্যাপারেও) তা আমি ভুলি না। অন্য সবাই ভুল করছে কিংবা সকলেই আমার মত গ্রহণ করুক, এমন মনোভাব আমার নয়। এরকম মনোভাব তো মূঢ়তার লক্ষণ। সবাই কোনো বিষয়ে একমত হলে দুনিয়ার অগ্রগতির তো রুদ্ধ হয়ে যাবে। নানাজনের নানামতের আলোতেই তো সত্যের রূপ প্রকাশিত হয়। আপনার মতামতও আমি শ্রদ্ধাসহকারেই বিবেচনা করব এবং প্রয়োজন মতো তার আলোতে নিজের চিন্তাশোধন করব। এই কাজ আমি সারাজীবনই করে আসছি। বিনা বিচারে অন্য কারও মতকে আগ্রাহ্য করা চরম মূর্খতা বলেই মনে করি। আপনার মতো প্রবীণ অভিজ্ঞ ব্যক্তির মতামত সম্পর্কে কি উদাসীন থাকতে পারি ? -আপনার বই পাবার অপেক্ষা রইলাম '। শেষের দিকে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত নির্বাচিত সাঁওতালি শব্দের অভিধান রচনা করেছিলেন। বাংলা ভাষায় এ-ধরনের কাজ প্রথম। এই কাজ কেন তিনি হাত দিলেন তার ব্যাখ্যা করে তিনি জানালেন " সংস্কৃত প্রাকৃত থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত বাঙলা ভাষার বিকাশের মূল সূত্রগুলি অভ্রান্তভাবে নির্ণয় করে মদ্গুরু সুনীতিকুমার জাতির কৃতজ্ঞতাভাজন হয়ে রয়েছেন। কিন্তু কেবল সূত্র নির্ণয়ই নয়, উপাদান সংগ্রহও তার আশ্চর্য অধ্যবসায়ের সাক্ষ্য দিচ্ছে। প্রসঙ্গক্রমে তার আলোচনার নানান্ ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তস্বরূপ এমন বহু শব্দই তাঁকে সঞ্চয়ন করতে হয়েছে, আর্যভাষায় অথবা আরবী ফারসীতে যেগুলির হদিস তিনি পান নি। এরকম শব্দগুলিকে সম্ভাব্য অনার্য বলে তিনি চিহ্নিত করেছিলেন। তার গবেষণা ও গ্রন্থরচনার কালে সাঁওতালি ভাষা নিয়ে তেমন চর্চা হয়নি এবং উল্লেখ্য সাঁওতালি অভিধানও প্রণীত হয়নি। অবশ্য পরবর্তী জীবনে তিনি এবিষয়ে জানাশোনার পর লিখনে ও ভাষণে বাঙলার উপর সাঁওতালির প্রভাবের বিষয় স্বীকার করেছেন। প্রকাশিত মদীয় অভিধানে আমি তার অপূর্ণ অভিলাষ কিছুটা পূর্ণ করায় প্রয়াস করেছি মাত্র।" যে ভাষার প্রাচীন লিপি নেই। যে ভাষার কোনো অভিধান রচিত হয়নি। সেই সাঁওতালি ভাষার সঙ্গে তুলনামূলক পর্যালোচনায় বাংলাকে মিলিয়ে দেওয়া- সত্যিকারের এক দুরূহ পরিশ্রমসাধ্য কাজ। বহুক্ষেত্রে শুধু সাঁওতাল-বাংলা নয়, হিন্দি, ফারসি, প্রাকৃত, সংস্কৃত শব্দের নমুনা দিয়ে, ভারতীয় ভাষা পরিবারের এক সুদৃঢ় ঐক্য দেখিয়েছেন। বাংলাভাষা তথা ভারতীয় ভাষা মানচিত্র দেশি-বিদেশি ভাষাবিদদের চর্চার ইতিবৃত্ত ‘সাঁওতালি –বাংলা সমশব্দ অভিধান’ গ্রন্থটি এক দুঃসাহসী পদক্ষেপ। লোকসাহিত্যের গবেষণা কর্মের মতো প্রাগাধুনিক সাহিত্যের গবেষণায় ক্ষেত্রেও তিনি প্রমাণ সংগ্রহের জন্য অক্লান্তভাবে ছুটে গেছেন গ্রামে গামান্তরে মাঠে মন্দিরে, খ্যাত-অখ্যাত প্রান্তে ও প্রান্তরে। বড়ু চণ্ডীদাসের ইতিহাস সন্ধানে ছুটে গেছেন বাঁকুড়া শালতোড়া গ্রামে, মুকুন্দের দেশ ত্যাগের মানচিত্র রচনার জন্য ধাবিত হয়েছেন দামিন্যা থেকে মেদিনীপুর আরঢা গ্রামের দিকে, আবার শ্রীচৈতন্যের জন্মভূমি-পুরাতন নবদ্বীপের সন্ধানে গঙ্গা ও জলঙ্গী নদীর তীর ধরে অনুসন্ধান করে সুনিশ্চিত সিদ্ধান্ত উপনীত হয়েছেন।তার পাণ্ডিত্য কেবল গ্রন্থার্জিত নয়, কষ্টার্জিত ক্ষেত্র সমীক্ষণের পাণ্ডিত্য। অনায়াস স্বাচ্ছন্দের তিনি বিচরণ করতে পারেন ধ্রুপদি সাহিত্যলোক থেকে লোকায়ত বঙ্গ-সাহিত্য ও সংস্কৃতির অন্তরে ও অন্দরমহলে।
তার ১০০ বছরের জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষে 'মনীষয়া দীপ্যতি' নামক গ্রন্থটি দে'জ প্রকাশকের দ্বারা ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয়। এই স্মারক গ্রন্থটি আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইব্রেরীতে আছে (Stand ford University, University of Chicago, University of California, U C Berkeley Libraries )। তার বিখ্যাত বইগুলো Digitized করেছে ২০০৬ ও ২০০৯ সালে Michigan University, and California University।
জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ৯ অক্টোবর, ২০১৮-তে কৃষ্ণনগর পৌরসভার সহায়তায় তার আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা হয় কৃষ্ণনগর রবীন্দ্র ভবনের কাছে। তার জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের অঙ্গরূপে একটি আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা হয় ১লা মে ২০১৬ সালে তার বসত বাড়ি চৌধুরী পাড়া কৃষ্ণনগরে। আর কলকাতায় মহাবোধি সোসাইটি হলে ১৭ ডিসেম্বর ২০১৬ সালে শতবর্ষ স্মারক গ্রন্থ 'মনীষয়া দীপ্যতি' ও তিনটি ই-বই প্রকাশ করেন তারই ছাত্র কবি শঙ্খ ঘোঘ। আর অবনীন্দ্র সভাগৃহে ৫ অক্টোবর ২০১৬ সালে ওয়েবসাইট উদ্বোধন করেন চণ্ডী লাহিড়ী।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত