এই মন্দিরটি "জাতিকে এক করবে"- নরেন্দ্র মোদী

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি ২০২৪, ১৪:১৫ |  আপডেট  : ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৭:৪৫

এক হাড় কাঁপানো শীতের সকালে যোগেন্দ্র গুরু এত জনস্রোতের মধ্যে দিয়ে ফিরছিলেন কড়া নিরাপত্তায় ঘেরা একটা অস্থায়ী মন্দির দেখে। হিন্দুরা মনে করেন ঠিক ওই জায়গাতেই জন্মেছিলেন ভগবান রামচন্দ্র।

উত্তর ভারতীয় শহর অযোধ্যায় তখন নির্মাণ কাজের চরম ব্যস্ততা। সেখানেই যে গোলাপি বেলেপাথরের সিংহদরজা পার করে এক বিশাল প্রাঙ্গণে ১৮০০ কোটি ভারতীয় টাকারও বেশী খরচ করে হিন্দু দেবতা রামচন্দ্রের মন্দির গড়ে উঠছে।

কয়েকজন হিন্দুত্ববাদী নেতারা যে শহরকে বলছেন, 'হিন্দুদের ভ্যাটিকান', সেই শহরকে সম্পূর্ণভাবে সাজিয়ে তুলতে বুলডোজার চালিয়ে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে অনেক এলাকা, আর যে কর্মকাণ্ডে খরচ হচ্ছে কয়েক হাজার কোটি ভারতীয় টাকা।

হিন্দুত্ববাদীরা যে মন্দির স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছেন কয়েক দশক ধরে, আগামী সপ্তাহে সেটারই উদ্বোধন করবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

মন্দিরটি যেখানে তৈরি হয়েছে, সেটা ভারতের সবথেকে বিতর্কিত ধর্মীয় স্থানগুলির অন্যতম। ওখানেই একসময়ে ছিল ষোড়শ শতাব্দীতে তৈরি বাবরি মসজিদ।

রাম মন্দির ধ্বংস করে ওই মসজিদ গড়া হয়েছিল, এই দাবি তুলে উন্মত্ত হিন্দু জনতা ১৯৯২ সালে মসজিদটি ভেঙ্গে দিয়েছিল। তারপরে সারা দেশে শুরু হয়েছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, মারা গিয়েছিলেন প্রায় দুই হাজার মানুষ।

বহু বছর ধরে হিন্দু আর মুসলমানদের মধ্যে যে জমি নিয়ে বিবাদ চলে আসছিল, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০১৯ সালে দেওয়া এক রায়ে তার মালিকানা হিন্দুদের দিয়ে দেয়। যদিও সর্বোচ্চ আদালত এটাও স্পষ্ট করে বলেছিল যে মসজিদ ধ্বংস করাটা ছিল "আইনের শাসনের জঘন্য লঙ্ঘন"।

মসজিদ বানানোর জন্য মুসলমানদের অযোধ্যাতেই অন্য একটি জমিও দেয় আদালত।

মি. মোদী এমন একটা সময়ে এই মন্দিরের উদ্বোধন করতে চলেছেন, যখন লোকসভা ভোটের আর কয়েক মাস বাকি আছে। ওই নির্বাচনে তৃতীয় বার জয়ের দিকে তাকিয়ে আছে তার দল ভারতীয় জনতা পার্টি। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, এই মন্দিরটি "জাতিকে এক করবে"। বর্ষীয়ান মন্ত্রী রাজনাথ সিং মনে করেন রামমন্দির "ভারতের সাংস্কৃতিক পুণর্জাগরণ ঘটাবে আর জাতীয় গর্ব ফিরিয়ে আনবে"।

সমালোচকরা অবশ্য বলছেন যে মন্দির উদ্বোধনের সময় বাছার ক্ষেত্রে ধর্মীয় রীতি মানার থেকেও রাজনৈতিক কৌশলের ওপরে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ভোটের আগে হিন্দুত্ববাদের হাওয়া তুলতেই এই কৌশল নেওয়া হয়েছে বলে তারা মনে করেন। তাদের কথায়, ভারতের রাজনীতিতে বিজেপি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে উঠে এসেছিল এই মন্দিরের দাবী তুলেই।

"সারা জীবন একটা তাঁবুতে কাটানো পরে অবশেষে ভগবান রাম এখন একটি পাকাপাকি আবাস পেতে চলেছেন। এটা আমাদের সকলের জন্য ধৈর্যের পরীক্ষা ছিল," বলছিলেন অস্থায়ী মন্দিরটির ৮৬ বছর বয়স্ক প্রধান পুরোহিত সত্যেন্দ্র দাস। ওই অস্থায়ী মন্দিরে গত তিন দশক ধরে রামের একটি ছোট মূর্তি প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।

নতুন মন্দিরটি এক কথায়, বিশাল বড়। এর প্রাঙ্গণটি ৭০ একর জুড়ে বিস্তৃত, মূল মন্দির রয়েছে ৭.২ একর জায়গা জুড়ে। মনোরম তিন তলা মন্দির গড়া হয়েছে গোলাপি বেলেপাথর দিয়ে, নীচের দিকে রয়েছে কালো গ্রানাইট পাথর। প্রায় ৭০ হাজার স্কোয়ার ফুট জুড়ে ধবধবে সাদা মার্বেল পাথর পাতা হয়েছে। মার্বেল পাথরের বেদিতে বসানো হবে ৫১ ইঞ্চি উঁচু রামের মূর্তি।

আপাতত মি. মোদী ২২শে জানুয়ারির একতলার উদ্বোধন করবেন। এবছরের শেষ নাগাদ মন্দিরটি সম্পূর্ণ হয়ে গেলে দৈনিক দেড় লাখ ভক্ত হয়ত মন্দিরে দর্শন করতে আসবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা বর্তমানের ভক্ত সংখ্যার প্রায় সাতগুণ।

আর এই সব কিছুর জন্য মি. মোদীর সরকার কোনও ত্রুটি রাখছে না। গঙ্গার উপনদী সরযূর তীরে শান্ত তীর্থযাত্রীদের শহর অযোধ্যাকে পুরোপুরি বদলিয়ে দিচ্ছে। কর্মকর্তারা যে রূপান্তরিত শহরটিকে অভিহিত করছেন "বিশ্বমানের এক নগরী, যেখানে তীর্থযাত্রী আর পর্যটক" উভয়ই আসবেন।

শহরের ভোল বদলিয়ে দেওয়ার জন্য কয়েক হাজার কোটি ভারতীয় টাকার যে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে রাস্তাঘাটের সম্প্রসারণ, একটি ঝাঁ চকচকে নতুন বিমানবন্দর, একটি বিশাল রেলস্টেশন এবং একটি বহুতলীয় গাড়ি পার্কিং রয়েছে। এর জন্য তিন হাজারেরও বেশি বাড়ি, দোকান এবং "ধর্মীয় কাঠামো" সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ভেঙে ফেলা হয়েছে। চারটি প্রধান রাস্তা প্রশস্ত করে ১৩ কিলোমিটার লম্বা 'রাম পথ' বানানোও এই সৌন্দর্যায়ন প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত। সব বাড়িগুলিকে একই রকম হালকা হলুদ রঙ করা হয়েছে।

র‍্যাডিসন এবং তাজের মতো হোটেল চেইনগুলি ছাড়াও আরও ৫০টি নতুন হোটেল আর হোমস্টে তৈরির পরিকল্পনা হচ্ছে। বহু পুরণো অপরিচ্ছন্ন অতিথিশালাগুলিকে নতুন করে সাজানো হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই জমির দাম ইতিমধ্যে তিনগুণ বেড়ে গেছে।

'অযোধ্যা: সিটি অফ ফেইথ, সিটি অফ ডিসকর্ড' বইটির লেখক ভ্যালে সিং ২০১৬ সাল থেকে অযোধ্যায় যান। তিনি বলছেন, "আপনি জায়গাটি চিনতেই পারবেন না, এতটাই বদলিয়ে গেছে জায়গাটি। দেখে তো চমকিয়ে গেছি।"

"আমরা বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর শহর তৈরি করতে চাই," বলছিলেন অযোধ্যার সবথেকে সিনিয়র কর্মকর্তা গৌরব দয়াল৷

অযোধ্যার প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধর্মবিশ্বাস জড়িয়ে থাকে। শহর জুড়ে মন্দিরের ছড়াছড়ি, রাস্তায় সাধু সন্তদের চলাফেরা দেখা যায়। হাজার হাজার ভক্ত বছরে অন্তত দুবার গোট শহর প্রদক্ষিণ করেন। আর শহর জুড়ে হনুমানদের দাপাদাপি তো আছেই।

সেটা আরও স্পষ্ট হয় শহরে ট্যাটু পার্লার আর খাবার বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার টেক অ্যাওয়ে কাউন্টারগুলো দেখলে। সন্ধ্যা হলেই শহরের আকাশে লেজার শো দেখা যায়। আবার ইউটিউবার - ইনস্টাগ্রামের রিলমেকারা-ও রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ান শহরটাকে আরও 'ট্রেন্ডি' করে তুলতে।

শহরটাকে নতুন করে সাজাতে গিয়ে, রাস্তাঘাট চওড়া করতে বহু মানুষের বাড়ি, দোকান ভাঙ্গা পড়েছে বুলডোজারের ধাক্কায়।

স্থানীয় দোকানদারদের একটি সমিতির প্রধান আনন্দ কুমার গুপ্তা বলছেন, তাদের মধ্যে প্রায় ১৬০০ জন "বাস্তুচ্যুত হয়েছেন এবং তাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই"।

তিনি আরও বলছিলেন, যদিও সবাইকে গড়ে এক লক্ষ ভারতীয় টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে।

"এই নতুন নির্মাণকাজ আমাদের জীবনে ছন্দপতন ঘটিয়েছে," বলছিলেন মি. গুপ্তা।

তীর্থযাত্রী পথ প্রশস্ত করার জন্য শহরের মন্দিরগুলিতেই কাজ করেন এমন প্রায় তিরিশেরও বেশি মানুষের বাড়ি আংশিকভাবে ভাঙা পড়েছে।

ফেটে যাওয়া পাইপ দিয়ে নিকাশি বর্জ্য উপচে পড়ছে রাস্তায়। নড়বড়ে বাঁশের মাচা দিয়ে কাদা ভরা নর্দমার ওপর দিয়ে বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছতে হয়। যাদের বাড়ি পুরোটাই ভাঙ্গা পড়েছে, তাদের অন্য জায়গায় জমি দেওয়া হয়েছে।

ভিশাল পাণ্ডের পুরনো পৈত্রিক বাড়িতে ছয়টি ঘর ছিল। তার অর্ধেকটাই ভাঙ্গা পড়েছে রাস্তা চওড়া করার সময়ে।

ক্ষতিগ্রস্ত অংশের জন্য প্রায় সাত লক্ষ ভারতীয় টাকা পেলেও আট সদস্যরে পরিবারের বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

তিনি বলছিলেন, "স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।"

"কিন্তু আমরাও খুশি যে রামচন্দ্র অবশেষে একটি স্থায়ী মন্দির পাচ্ছেন। তিনি এতদিন অস্থায়ী তাঁবুতে কষ্ট করে অবস্থান করছিলেন, এবার আমাদের কষ্টের পালা," বলছিলেন মি. পাণ্ডে।

কান্তি দেবী অবশ্য আরও খোলাখুলি নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করলেন।

তিনি বলছিলেন, "আমরা মোটেও খুশি নই। কর্মকর্তারা বারবার এসে ক্ষমা চেয়ে গেছেনে যে আমাদের কষ্ট দিচ্ছেন তারা। মন্দির হল, ভালই হয়েছে, কিন্তু আমাদের তাতে কী উপকার হবে?"

স্থানীয় প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা গৌরব দয়াল অবশ্য জানিয়েছেন, "প্রত্যেককে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়ে গেছে। পারিবারিক মামলা মোকদ্দমা চলার কারণে কিছু ক্ষেত্রে হয়তো দেরি হয়েছে। এখন সব কিছুই মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে।"

অযোধ্যার ভবিতব্য নানাভাবে শহরটির বাইরে থেকে আসা মানুষদের হাতেই নির্ধারিত হয়েছে। এই শহরে হিন্দু আর মুসলমানরা একই সঙ্গে, একই পাড়ায় থেকে এসেছেন দীর্ঘ সময় ধরে।

সেই ট্র্যাডিশন বজায় থেকেছে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার পরে ১৯৯২-র ডিসেম্বরে শহরের মুসলমানদের ওপরে আক্রমণ, অন্তত ১৮ জন মুসলমান নিহত হওয়া, তাদের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও।

সমাজ কল্যাণ কর্মকর্তা খালেক আহমেদ খান বলছিলেন, "যদিও ওইসব ঘটনা এখনও পীড়া দেয়, তবে আমরা সেসব পিছনে ফেলে এসেছি।"

তিনি মনে করেন অযোধ্যায় কয়েক শতাব্দী ধরে হিন্দু আর মুসলমানরা একে অপরের ওপরে নির্ভরশীল হয়ে থেকেছে, তাদের মধ্যে হৃদ্যতা বজায় থেকেছে।

তার কথায়, "হিন্দুদের রামের প্রতি ভক্তিতেও মুসলমানদের সহায়তা জড়িয়ে আছে, বিশেষত মন্দিরকে ঘিরে যে অর্থনীতি চলে, সেই ক্ষেত্রে। সেখানে দুই সম্প্রদায়কে আলাদা করা সম্ভব নয়।"

একই বিশ্বাস স্থানীয় কলেজের অধ্যাপক রঘুবংশ মণির।

"সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাটা বাইরে থেকে তৈরি করা হয়েছিল। স্থানীয় মানুষ খুব একটা জড়িত ছিলেন না তাতে," বলছিলেন তিনি।

শহরের আরও কয়েকজন বাসিন্দারাও একই মতামত: বিশ্বের দরবারে নতুন মন্দির উপস্থাপন করার ব্যাপারেও বাইরের মানুষরাই অযোধ্যার, সেখানকার মানুষের ভবিতব্য ঠিক করে দিচ্ছেন।(বিবিসি বাংলা)

 

সান

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত