উস্কানিদায়ক, ভুয়া তথ্য ছড়াতে সাংবাদিকদেরকে যেভাবে বিশেষ গোষ্ঠী ব্যবহার করছে

  হাসান শান্তনু

প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০২২, ১২:০৩ |  আপডেট  : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৫৬

সাংবাদিকদের ‘অসতর্কতায়’ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ধর্মীয় উস্কানিদায়ক ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে। যা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের পাশাপাশি কখনো কখনো সাম্প্রদায়িক হামলায় রূপ নিচ্ছে। এতে ফায়দা লুটছে বিশেষ গোষ্ঠী। গতি পাচ্ছে গুজব। বিভ্রান্ত হচ্ছেন পাঠক, দর্শকরা। সমাজে তথ্যবিভ্রাট বাড়ছে। মানুষের আস্থা কমছে সংবাদমাধ্যমের প্রতি। কখনো কখনো প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে সাংবাদিকতা। উস্কানিদায়ক ভুয়া তথ্য, গুজব ছড়িয়ে দিতে সাংবাদিকদের ‘অজান্তে’ তাদেরকে মতলববাজ বিভিন্ন গোষ্ঠী এভাবে ব্যবহার করছে।

মত ও পথের পর্যালোচনা বলছে, সাংবাদিকরা কখনো কখনো ‘চাঞ্চল্যকর’ তথ্য যাচাই ছাড়া ফেসবুকে পোস্ট, ইউটিউবে ভিডিও দেন ‘বেশি লাইক, কমেন্টস, ভিউজের’ আশায়। কেউ কেউ নিজের পছন্দের রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠীর সুবিধা বিবেচনায়ও দেন। বিশেষ গোষ্ঠীর সদস্য, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেকে ফেসবুকে সাংবাদিকদের ‘বন্ধু তালিকায়’ (ফ্রেন্ড লিস্ট) থাকেন। তাদের কাছ থেকে ফেসবুকের ম্যাসেজের মাধ্যমে পাওয়া মিথ্যা তথ্য ঢাকার বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের মধ্যে অনেকে যাচাই-বাছাই ছাড়া নিজের ওয়ালে পোস্ট হিসেবে দেন। যা পরে ভুয়া প্রমাণিত হয়।

কথিত তথ্য কখনো হয় ধর্মীয় উস্কানিমূলক, কখনো সরকার, বা কোনো রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে চরম মিথ্যাচার, কখনো হয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির চরিত্রহননের গুজব। পেশাগত কারণে সাংবাদিকদের প্রচার করা তথ্যের প্রতি মানুষের আস্থা বেশি থাকে বলে তাদের মাধ্যমে গুজববাজরা তা ছড়ানোর বিশেষ লক্ষ্য রাখেন।

জানা যায়, গত ৬ এপ্রিল ফেসবুকে গুজব ছড়ায়, নওগাঁর মহাদেবপুরের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষিকা আমোদিনী পাল দুই শিক্ষার্থীকে হিজাব পরায় ‘মারধর’ করেন। এ বিষয়ে ওই জেলার কয়েক সংবাদকর্মীর দেওয়া স্ট্যাটাসকে ভিত্তি করে ঢাকায় কর্মরত কয়েক সাংবাদিক ফেসবুকে পোস্ট দেন। এরপর নানা শ্রেণিপেশার মুসলমানের উস্কানিমূলক মন্তব্য চলতে থাকে। অল্প সময়ের মধ্যেই বিষয়টি ‘ভাইরাল’ হয়। পরে জানা যায়, হিজাব পরায় ‘মারধরের’ কথিত তথ্য একেবারেই ভুয়া। ফেসবুকভিত্তিক ওই গুজব যাচাই না করে এ বিষয়ে ‘প্রতিবেদনও’ প্রচার করে ‘দায়িত্বহীন’ কয়েকটি সংবাদ পোর্টাল।

নেক্সাস টিভির কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, কলামিস্ট আমীন আল রশীদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘নওগাঁয় হিজাব পরায় ছাত্রীদের পেটানোর খবরটা নাকি সঠিক নয়। যদি তা-ই হয়, যারা সঠিকভাবে খোঁজ-খবর না নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করলেন, তারা ক্ষমা চান। সাংবাদিকদের ব্যাপারে মানুষের আস্থা এমনিতেই তলানিতে। গণমাধ্যম এখন মূলত একটি জনবিচ্ছিন্ন মাধ্যম। এর মধ্যে লাইক বাড়ানোর জন্য অর্ধসত্য খবর প্রকাশ করে সেই বিচ্ছিন্নতা আরো বাড়ানোয় যারা ভূমিকা রাখছেন, তাদেরকে চিহ্নিত করা জরুরি। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’

তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকতা আর ফেসবুকিং যে এক নয়, সেটা বোঝা দরকার। মূলধারার গণমাধ্যমের রেফারেন্স দিয়েই আমাদের মধ্যে যারা এই ঘটনার প্রতিবাদ জানালাম, ওই মিথ্যা খবর প্রচারের দায় আমাদেরও। কিন্তু ফেসবুকে আমি কী লিখলাম, তার চেয়ে অনেক বড় বিষয় গণমাধ্যম কী লিখেছে? কারণ, গণমাধ্যমের খবরকে ভিত্তি করেই আমরা লিখি।’

বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউটিউবে ভিডিও দেওয়া, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের অন্যান্য মাধ্যমে লেখালেখি করা, বা স্ট্যাটাস দেওয়া কিছুতেই সাংবাদিকতা বিষয়ক কাজ (জার্নালিস্টিক ওয়ার্ক) নয়। সেটা সাংবাদিকতার অংশ নয় কিছুতেই। সাধারণ পাঠক, দর্শকরা তা বুঝতে পারেন না। তাই কোনো সাংবাদিকের ফেসবুকে দেওয়া পোস্ট ভুয়া প্রমাণিত হলে সংবাদপ্রতিষ্ঠানের প্রতি এর নেতিবাচক প্রভাব কিছুটা হলেও পড়ে। সাধারণ পাঠক, দর্শকের কাছে সাংবাদিকদের প্রতি আস্থা কমে।

২০২০ সালে দেশে করোনাভাইরাসের বিস্তারের পর জামায়াতপন্থি জ্যেষ্ঠ এক সাংবাদিক নেতা ফেসবুক লেখেন, ‘সাংবাদিকদেরকে ত্রাণ হিসেবে দশকেজি করে চাল দেবে সরকার’। তাঁর ‘স্ট্যাটাস’ ভিত্তি করে আরো কয়েক সাংবাদিক নিজের ওয়ালে তা লেখেন। সাংবাদিকদের মধ্যে এ বিষয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়। বিষয়টি যে সম্পূর্ণ অসত্য, তা ওই সময় তথ্য মন্ত্রণালয় সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিশ্চিত করে। সরকার সম্পর্কে সাংবাদিকদের মধ্যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি জন্ম দেওয়ার উদ্দেশ্যে ওই ‘তথ্য’ ছড়ানো হয়।

মিথ্যা ছড়ানোর দায়ে তথ্য মন্ত্রণালয় তখন ওই পোস্ট যাঁরা দেন, তাঁদেরকে জবাবদিহির আওতার আনার উদ্যোগ নেয়। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সদ্য সাবেক সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদের মধ্যস্থতায় তথ্য মন্ত্রণালয় তখন আইনি প্রক্রিয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। সহকর্মীদের রক্ষা করতে সাংবাদিক নেতা কুদ্দুস আফ্রাদকে তখন অনুরোধ করেন ডিইউজের ওই সময়ের নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও বর্তমান কল্যাণ সম্পাদক জুবায়ের রহমান চৌধুরী।

২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালে একপর্যায়ে ভয়াল গুজব ছড়ায়, ঢাকার গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে চারজন শিক্ষার্থীর লাশ পাওয়া গেছে। ঢাকার গণমাধ্যমে দায়িত্বশীল পদে কর্মরত অন্তত পাঁচজন সাংবাদিক ওই গুজবের ভিত্তিতে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। তাঁদের স্ট্যাটাসে সাংবাদিক, ‘প্রেস ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশের’ (পিআইবি) মহাপরিচালক জাফর ওয়াজেদ জবাবও দেন। অবশ্য ওই পাঁচজনই পরে তাঁদের পোস্ট ফেসবুক থেকে মুছে দেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ফেসবুক, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যম সংবাদের অন্যতম উৎস হয়ে উঠেছে পৃথিবীজুড়ে। বিভিন্ন দেশের, এমনকি পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাবশালী পত্রিকা, টিভি চ্যানেল, সংবাদ পোর্টালে কর্মরত অনেক সাংবাদিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে তথ্য পেয়ে প্রতিবেদন করে থাকেন। তবে তথ্যের সত্যতা, বস্তুনিষ্ঠতা তারা যাচাই-বাছাই ও সাংবাদিকতার নীতিমালা অনুসরণ করেই প্রতিবেদন তৈরি করেন। যথাযথ যাচাই ছাড়া ‘সবার আগে সর্বশেষ সংবাদ’ প্রচারণার প্রবণতা থেকে প্রতিবেদন প্রচার করা আর তা পরে মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার ঘটনাও আছে। এতে সেসব সংবাদমাধ্যম সমালোচনার কবলে পড়ে।

বিশেষ গোষ্ঠীর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গুজব, ভুয়া তথ্যকে ভিত্তি করে ‘প্রতিবেদন’ প্রচারের প্রবণতা দেশের বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে কম-বেশি দেখা যাচ্ছে অনেকদিন ধরে। গুজব, বা অসত্য তথ্য মিথ্যা প্রমাণিত হলে তারা সেসব প্রতিবেদন ওয়েবসাইট থেকে মুছে দেয়। অনেক সংবাদমাধ্যম পরে এ বিষয়ে কোনো সংশোধনী প্রচার করে না। যা সাংবাদিকতার নীতিমালার বিরোধী। তারা মিথ্যা প্রতিবেদনটি মুছে দিলেও সংশোধনী না থাকায় এ বিষয়ে ছড়িয়ে পড়া বিভ্রান্তি রয়ে যায়।

কৃতজ্ঞতায় :
মত ও পথ

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত