"ঈদের চাঁদ "

  ওমর ফারুক 

প্রকাশ: ১৩ মার্চ ২০২৫, ১২:২৬ |  আপডেট  : ১৩ মার্চ ২০২৫, ১৬:৪২

ইসলামি সাহিত্য -সংস্কৃতি, শিল্পকলা, ইবাদত -বন্দেগীতে চন্দ্র মাসের গুরুত্ব সর্বাধিক। মুসলিমদের ইবাদতগুলো মূলত চাঁদের উপস্থিতি দেখে শুরু হয়। চাঁদের উপস্থিতি দেখে ইবাদত শুরু হওয়াতে গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকার সাথে সময় আটকে থাকে না। বছরের সব সময় ইবাদতের সময় আবর্তন ঘটে। আর এ জন্য প্রচণ্ড গ্রীষ্মে যেমন সাওম ফিরে আসে আবার সেটা হাড়কাঁপানো শীতেও ফিরে আসে। একটা লোক তার জীবনে বছরের সবগুলো সময় রোজা, ঈদ, মোহররম, ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী, হজ্বের স্বাদ গ্রহণ করতে পারেন। গ্রীষ্মের সময় রোজা অনেকটা কঠিন। সময়ের পরিধি থাকে বেশি। প্রকৃতি থাকে রুক্ষমূর্তি। বাতাসে প্রচণ্ড তাপের ফুল্কি। প্রখর রোদ। পুকুরের জল শুকিয়ে কাঠ। তেষ্টায়, পিপাসায় জিভ শুকিয়ে আসে। আবার হাড়কাঁপানো শীতে যখন রোজার আগমন হয় প্রকৃতি তখন শুষ্ক। ভীষণ ঠাণ্ডা চারদিকে। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। বিষ্ময়কর দর্শন। মুসলিমরা পর্যায়ক্রমে সারাবছর রোজা পালনের প্রাকৃতিক অনুভূতি আস্বাদন করে। 

চাঁদ কেন্দ্রিক ইবাদত হওয়ার কারণে এখানে চাঁদ দেখাটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চাঁদ আগে পরে দেখার কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে একই সাথে রোজা কিংবা ঈদ অনুষ্ঠিত হয়না। এ ক্ষেত্রে আবহাওয়া একটা বিবেচিত বিষয়। আবহাওয়ার বাড়াবাড়ির কারণে অনেক সময় চাঁদ যথাসময়ে দৃশ্যমান হয়না। তখন যন্ত্রের উপর নির্ভর করে থাকতে হয়। যার কারণে এমন হয়েছে যে লোকেরা তারাবিহ পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন কিন্তু মাঝরাতে চাঁদ দেখা কমিটি ঘোষণা দেয় আগামীকাল ঈদ। চাঁদ দেখার জন্য এ যুগে কমিটি করা হয়েছে। তাদের কাজ চাঁদ সনাক্ত করা। কিন্তু এ বিধিব্যবস্থা কিন্তু আগে ছিলো না। মানুষ গুণে রাখতো আরবি মাসের হিসাব। আরবি মাসে ২৮ কিংবা ৩১ তারিখ নেই। তাই শাবান মাসের ২৯ তারিখ শেষ হলে সন্ধ্যার আকাশে চাঁদ খোঁজা শুরু হতো। রীতিমতো গরু খোঁজা। ছাকনি দিয়ে বের করার মতো। মানুষ ছুটে যেত খোলা ময়দানে। কেউ উঠে পড়তো গাছের মগডালে। আবার কেউ ব ঘরের চালে কিংবা পাহাড়ের উপর। নতুন চাঁদ দেখার প্রতিযোগিতা। কে আগে চাঁদ দেখবে তার জন্য সুবিধাজনক স্থানে চলে যেত। এই চাঁদ দেখা সংঘবদ্ধভাবে সংগঠিত হতো। চাঁদ দেখার জন্য একজন আরেকজনকে ডেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে যেত আকাশপানে মুখ করে। যেই একজন চাঁদ দেখেছে বলে জোরে চিৎকার করে উঠতো অমনি শুরু হয়ে যেত চাঁদ দেখার ভীড়। যে প্রথম দেখেছে সে সবাইকে দেখাচ্ছে আর নিজের অবস্থান জাহির করছে। আর এভাবে নতুন চাঁদের খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়তো। 

চাঁদ দেখার জন্য ছেলে, বুড়ো, মহিলা-পুরুষ সবাই ঘর ছেড়ে বাইরে জড়ো হতো। এ অবস্থা এখন অবশ্য তেমন দেখা যায় না। এখন আবহাওয়া খারাপ হলেও সৌদি আরবের একদিন পরে আমাদের চাঁদ দেখা কমিটি ঘোষণা দিয়ে দেয় বাংলাদেশের আকাশে চাঁদ দেখা গিয়েছে। আর মিডিয়াগুলো সে খবর দ্রুত প্রচার করে দেয়। এতে করে চাঁদ দেখার আসল মজাটা হারিয়ে যায়। যা-ই হোক ছোট বাচ্চারা কিন্তু চাঁদের সাথে এখনো মাতে। তারা চাঁদের উপস্থিতি দেখে এদিকে সেদিকে দৌড়াতে থাকে। আনন্দে আতশ পোড়ায়। চাঁদকে সঙ্গী করে দৌঁড়ানো শিশুদের স্বভাব। শিশুদের ধারণা চাঁদ ওদের সাথে হাঁটে। এ বলে আমার সাথে হাঁটে, ও বলে আমার সাথে হাঁটে। এ নিয়ে বেঁধে যায় গোল। গোল করতে করতে কেউ ব ছড়া কাটে-

চাঁদ হাঁটে যেদিকে 
খুকু হাঁটে সেদিকে। 
চাঁদ হাসে খিলখিল
দুই চাঁদে ভারি মিল।

নতুন চাঁদ আকারে অত্যন্ত আর স্নিগ্ধ। রুপোলী চাঁদ, মায়াবী চাঁদ। আলোর বিচ্ছুরণ তৈরি হচ্ছে মাত্র। এরই মধ্যে বড়দের উপস্থিতি বাড়াতে থাকে।  তারা জামার আস্তিনে, গামছায়, ওড়নায় চাঁদ দেখার চেষ্টা করে। কেউবা জামায় চাঁদ দেখে চাঁদের দাগ সংখ্যা গুণে বলতে থাকে চাঁদ আজকের নাকি গতকালের। বড়রা এ নিয়ে রীতিমতো গবেষণা, তর্ক-বিতর্ক করে। আবার কেউবা পঞ্জিকা ঘটে চাঁদের তিথি, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, দশা, রাহুমুক্তি নিয়ে জ্যোতিষী জ্ঞান প্রকাশ করে। এরই মধ্যে বয়সে প্রবীণ লোকটি জানার চেষ্টা করে চাঁদের অবস্থান। চাঁদটা সোজা হয়ে উঠেছে নাকি কোনো দিকে হেলে-দুলে আছে। দক্ষিণে হেলে থাকলে এ বছর ধানে-দুর্বায় যাবে। আর যদি উত্তরে হেলে থাকে তাহলে চালের বাজার বাড়বে। মানুষের কষ্টের ব্যাপার। মানুষজন দুর্গতি লাঘবের জন্য দোয়া করবে হাত তুলে। 

অটোমান শাসনামলে নতুন চাঁদ দেখার প্রতিযোগিতা হতো। তাতে শিশুরাও অংশ নিত। যে শিশু আগে চাঁদ দেখতে পেত সে তার স্বাক্ষী  নিয়ে প্রধান কাজীর দরবারে হাজির হতো। প্রধান কাজী শিশুদের কথার সত্যতা নিরীক্ষা করে তাদের পুরস্কৃত করতো। এতে শিশুদের আনন্দ আরও বেড়ে যেত। আমাদের সময় আমরা নতুন চাঁদের উপস্থিতি দেখে মোনাজাত করতাম। অনেকটা সময় আতশ পোড়াতাম। তারপর নামাজের জন্য মসজিদে ছুটতাম। দিন যতো যেত সে চাঁদ আস্তে আস্তে বড় হতে থাকতো পূর্ণিমা রাতে সবটা আলো বিচ্ছুরণ করার জন্য। আর এভাবে একটা চাঁদের ক্ষয় নতুন চাঁদের আগমনের পথ প্রশস্ত করে দেয়। মুসলিমরা ইবাদতের মাধ্যমে মহান রবের সান্নিধ্য পাবার চেষ্টা করে। সহজেই বান্দা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারে সঠিকভাবে ইবাদত -বন্দেগীর মাধ্যমে। 

চাঁদের উপর নির্ভর করে শুরু হয়ে যায় রজব, শাবান, রমজান মাস। রমজান হলো মুসলমানদের নিকট সর্বশ্রেষ্ঠ মাস। এ মাস কুরআন নাজিলের মাস। এ মাস ইবাদতের জন্য সর্বোত্তম। আর এ মাসে ইবাদতের সওয়াব ৭০ গুণ বেড়ে যায়। কবরের আজাব বন্ধ করে রাখা হয়। শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়। মানুষের দানের হাত খুলে যায়।চারদিকে কেনাকাটার ধুম। চারদিকে বেসুমার ইফতার পার্টি। রাজনীতির জন্যও উত্তম সময়। দলগুলো সুযোগ বুঝে বিনিয়োগ করে ইফতার পার্টিতে। ইফতার বিতরণ ব্যানারে ছেয়ে যায় পাড়া-মহল্লা, অলি-গলি। বিশাল আকৃতির বিলবোর্ডগুলো ঝুলে থাকে ছাদে-গাছে। কৃত্রিম ব্যানার, বিলবোর্ডের কারণে গরীবের ঈদ উদযাপনের  তৃষ্ণা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। ঢাকা পড়ে যায় নতুন চাঁদের আবেদন। রমজানের চাঁদ ক্ষয় হয়, উঁকি মারে আকাশে শাওয়াল মাসের চাঁদ। মিডিয়া কভার দেয়- 

ও মন রমজানেরই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত