পুরাণ থেকে বর্তমান
ইতিহাসের পাতায় দুর্গাপূজা
প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০২১, ১১:২০ | আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৫০
শাশ্বত স্বপন
-----------
৪র্থ পর্ব
কোন কোন গবেষক মনে করেন, বাংলার মাটিতে দুর্গা দেবীর প্রবর্তন হয় সেন আমলে। সবচেয়ে প্রাচীন দুর্গামূর্তি পাওয়া যায় কর্ণাটকে। সেখান থেকে বাংলার মাটিতে প্রাচীন সংস্কৃতি বিনষ্ট করে ব্রাক্ষণ্যবাদের প্রবর্তন করেন সেনরা।
দূর্গাপূজার একটি বিশেষ অধ্যায় হল সন্ধিপূজা। দূর্গাপূজার অষ্টমীর দিন হয় এই বিশেষ পূজা, এই পূজার সময়কাল ৪৮ মিনিট। অষ্টমী তিথির শেষ ২৪ মিনিট ও নবমী তিথির প্রথম ২৪ মিনিট মোট ৪৮ মিনিটের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় এই পূজা। যেহেতু অষ্টমী ও নবমী তিথির সংযোগ স্থলে এই পূজা হয় তাই এই পূজার নাম সন্ধিপূজা অর্থ্যাৎ সন্ধি-কালিন পূজা। এই পূজা দূর্গাপূজার একটি বিশেষ অঙ্গ, এই সময় দেবী দূর্গাকে চামুন্ডা রূপে পূজা করা হয়ে থাকে।
অপরাজিতা পূজা দুর্গাপূজার একটি অঙ্গ। দুর্গার অপর নাম অপরাজিতা। তবে এই দেবীর মূর্তি অন্যরকম। ইনি চতুর্ভূজা, দেবীর হাতে শঙ্খ, চক্র, বর ও অভয়মুদ্রা থাকে এবং গায়ের রং নীল, দেবী ত্রিনয়না ও মাথায় চন্দ্রকলা। বিজয়া দশমীর দিন বিসর্জনের পর পূজামণ্ডপের ঈশানকোণে অষ্টদল পদ্ম এঁকে অপরাজিতার লতা রেখে এই দেবীর পূজা করা হয়। শক্তিপুরাণ ও মার্কেণ্ডপুরাণ মতে, ইনি বৈষ্ণবী শক্তি বিষ্ণুমায়া ও শিবশক্তি শিবানীর মিশ্রণে কল্পিতা।
পূজামণ্ডপে নবপত্রিকা প্রবেশের মাধ্যমে দুর্গাপূজার মূল অনুষ্ঠানটির প্রথাগত সূচনা হয়। নবপত্রিকা প্রবেশের পর দর্পণে দেবীকে মহাস্নান করানো হয়। এরপর বাকি দিনগুলিতে নবপত্রিকা প্রতিমাস্থ দেবদেবীদের সঙ্গেই পূজিত হতে থাকে। বিশেষভাবে লক্ষণীয় হল, নবপত্রিকা প্রবেশের পূর্বে পত্রিকার সম্মুখে দেবী চামুণ্ডার আবাহন ও পূজা করা হয়। পত্রিকাস্থ অপর কোনো দেবীকে পৃথকভাবে পূজা করা হয় না।
শ্রীশ্রীদেবীমাহাত্ম্য সম্পর্কে চণ্ডী-তে দেবী নিজেই বলেছেন, পূজা-মহোৎসব উপলক্ষে আমার সমগ্র মাহাত্ম্য পাঠ ও শোনা অবশ্যই কর্তব্য। দুর্গাপূজা যেহেতু মহাপূজা, তাই এই পুজোয় চণ্ডীপাঠ অবশ্য প্রয়োজন। কারণ চণ্ডীপাঠে দুর্গাপুজোর সকল ত্রুটি দূর হয়। সকল পূর্ণতা লাভ হয়। ‘পদ্মপুরাণ’-এটাও বলা হয়েছে, দুর্গার্পূজায় চণ্ডীপাঠ অবশ্যই কর্তব্য। এই পুরাণে মহাদেব পার্বতীকে বলেছেন, দুর্গাপূজায় সাধক একাগ্রচিত্তে সপ্তশতী চণ্ডীমন্ত্র জপ করবে। দেবী গীতায় বলা হয়েছে, ভগবতীর পুজোয় দেবীর সহস্রনাম, দেবীকবচ, দেবীসূক্ত, দেবী উপনিষদ পাঠে দেবীর পরিতুষ্টি হয়। চণ্ডীর তত্ত্বপ্রকাশিকা টীকায় বলা হয়েছে, দেবী দুর্গার পুজো হতেও চণ্ডীপাঠ দেবীর অধিকতর প্রীতিজনক। দুর্গাপুজোয় শ্রীশ্রী চণ্ডী পাঠে গ্রহাধিষ্ঠাত্রী দেবদেবীগণ প্রসন্ন হন এবং তার ফলে গ্রহপীড়াও প্রশমিত হয়ে যায়। রূদ্রচণ্ডী-র তূর্যখণ্ডে মহাদেব চণ্ডীকে বলছেন, হে দেবি ! যে ব্যক্তি ভক্তিপূর্বক একাগ্রচিত্তে মধুকৈটভ বধ, মহিষাসুর, চন্ডমুন্ড, শুম্ভ নিশুম্ভ বধরূপ তোমার মাহাত্ম্য নিত্য পাঠ করে বা শুনে থাকে, তাঁর কোনরূপ পাপ, দারিদ্র ও বিপদ উপস্থিত হয় না। তত্ত্ব প্রকাশিকা টীকায় বলা হয়েছে, এই দেবীমাহাত্ন ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ— চতুর্বিধ পুরুষার্থ লাভের সাধন স্বরূপ। বারাহী তন্ত্র গ্রন্থে বলা হয়েছে— যজ্ঞের মধ্যে যেমন অশ্বমেধ, দেবতাদের মধ্যে হরি সর্বপ্রধান, সেই রূপ সপ্তশতীস্তব অর্থাৎ দেবী মাহাত্ম্য সকল স্তবের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।তাই মহামায়ার মহাপুজোয় দেবীমাহাত্ম্য পাঠ অবশ্যকর্তব্য। কারণ চণ্ডীর মহামায়াই দেবী দুর্গা।
গোয়া রাজ্যের শান্তাদুর্গা। কোঙ্কন উপকূলে গোয়া অঞ্চলে বাঙালিদের একটা মাইগ্রেশন হয়েছিল পালযুগে। আর্পোরা নামে একটা জায়গায় যোগীপাল চৌরঙ্গীনাথের মন্দির আছে। ধর্মপাল দেবপালের সময়েই বাংলা থেকে অভিবাসন হয়ে থাকবে। ওঁরা শান্তাদুর্গার উপাসনা করেন। শীতলার সঙ্গে সম্পর্ক আছে মনে হয়েছে, আমাদের ল আর দক্ষিণ ভারতের র পরস্পর স্থান পরিবর্তন করে। তাছাড়াও মুম্বাইতে শান্তাদুর্গা মন্দিরকে শীতলা মন্দির বলা হয়। শান্তাদূর্গা বা শান্তেরী নাম হলেও আমাদের মত দুর্গাদেবী নয়। এই অঞ্চলে গৌড়ীয়দের উপনিবেশ ঘটে পাল যুগে এই সিদ্ধান্ত করতে পারি আমরা, অনেক শতাব্দী আগে যেমন ঘটেছিল শ্রীলঙ্কায়। বাঙালি একটি মহাজাতি এবং উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে বাঙালির উপনিবেশ যুগে যুগে ঘটেছে। বাঙালী যেখানে থাকবে সেখানেই দুর্গারুপে না হোক মাতৃদেবীকার অন্য রুপে পূজা হবেই।
মধ্য যুগে বাংলা সাহিত্যে দুর্গাপূজার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ঢাকেশ্বরী মন্দির চত্বরে আছে দুই ধরনের স্থাপত্যরীতি মন্দির। প্রাচীনতমটি পঞ্চরত্ন দেবী দূর্গার--যা সংস্কারের ফলে মূল চেহেরা হারিয়েছে। মন্দিরের প্রাচীন গঠনশৈলী বৌদ্ধ মন্দিরের মত। দশম শতকে এখানে বৌদ্ধ মন্দির ছিল--পরবর্তীতে কিভাবে সেন আমলে হিন্দু মন্দির হয়েছিল--তা ইতিহাসে লিখা নাই। ১১শ বা ১২শ শতক থেকে এখানে কালী পূজার সাথে দূর্গা পূজাও হত। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের ইতিহাস সম্পর্কে নানা কাহিনী প্রচলিত আছে। ধারণা করা হয় যে, সেন রাজবংশের রাজা বল্লাল সেন ১২শ শতাব্দীতে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। তবে সেই সময়কার নির্মাণ শৈলীর সাথে এর স্থাপত্যকলার মিল পাওয়া যায় না বলে অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন। তবে বিভিন্ন সময়ে এই মন্দিরের গঠন ও স্থাপনার নানা ধরনের পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে। ইতিহাসবিদ দানীর মতে, প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগে রমনায় কালী মন্দির নির্মিত হয়েছিল এবং এখানেও কালী পূজার সাথে দুর্গা পূজা হত।
শতকে অভিনির্ণয়-এ, মৈথিলী কবি বিদ্যাপতির দূর্গাভক্তিতরঙ্গিনীতে দূর্গা বন্দনা পাওয়া যায়। বঙ্গে ১৪শ শতকে দুর্গা পূজার প্রচলন ছিল কিনা ভালভাবে জানা যায় না। ঘটা করে দুর্গাপূজা চালুর আগে কিছু কিছু উচ্চ বর্ণ হিন্দুদের গৃহকোণে অত্যন্ত সাদামাঠা ভাবে ঘরোয়া পরিবেশে এই পূজা চালু ছিল। আর ঘটা করে দূর্গা পূজার ইতিহাস, খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। তবে কখন থেকে ঘটা করে এই পূজা চালু হল--তা নিয়ে পরিষ্কার বিশ্বাসযোগ্য ঐতিহাসিক কোন প্রমান পাওয়া যায় না। যতটুকু জানা যায় তা হল, কারো মতে, ১৫০০ খ্রীষ্টাব্দের শেষের দিকে দিনাজপুরের জমিদার প্রথম দূর্গা পূজা করেন।
কারো কারো মতে, ষোড়শ শতকে রাজশাহী তাহেরপুর এলাকার রাজা কংশ নারায়ন প্রথম দূর্গা পূজা করেন। তাহিরপুর রাজবংশ বাংলাদেশের প্রাচীন রাজবংশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই রাজবংশের আদিপুরুষ ছিলেন মৌনভট্ট। আর বংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সামন্ত রাজা ছিলেন ইতিহাসখ্যাত কংস নারায়ণ রায়। সমসাময়িক বাংলার হিন্দু সমাজে তিনি চিরভাস্বর হয়ে থাকার মানসে এক মহাযজ্ঞ সাধন করতে আগ্রহী হলেন। এই লক্ষ্যে তাঁর পরগণার সব শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের দরবারে আহ্বান করে তাঁদের মত চাইলেন। তাঁর মনোবাসনার কথা শুনে পণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রী বললেন, ‘বিশ্বজিৎ, রাজসুয়, অশ্বমেধ ও গোমেধ—এই চারটি মহাযজ্ঞ নামে কথিত। প্রথম দুটি কেবল সার্বভৌম সম্রাটেরা করতে পারেন আর পরের দুটি কলিতে নিষিদ্ধ। তোমার পক্ষে দুর্গোৎসব ভিন্ন অন্য কোনো মহাযজ্ঞ উপযুক্ত নাই। এই যজ্ঞ সকল যুগে সকল জাতীয় লোকেই করতে পারে এবং এক যজ্ঞেই সব যজ্ঞের ফল লাভ হয়।’সমাগত সব পণ্ডিত রমেশ শান্ত্রীর এই মতে সমর্থন দিলেন।
মোগল সম্রাট আকবর (১৫৫৬-১৬০৫)-এর রাজত্বকালে রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার তাহেরপুরের রাজা কংস নারায়ণ ৮৮৭ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৫৮০ সালে বাংলায় প্রথম শারদীয় দুর্গাপূজার প্রচলন করেছিলেন বলে ইতিহাসে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়। রাজা কংস নারায়ণ সাড়ে আট লাখ টাকা ব্যয়ে আধুনিক শারদীয় দুর্গোৎসবের আয়োজন করেছিলেন।। উৎসবটি হয়েছিল বারনই নদের পূর্ব তীরে রামরামা গ্রামের দুর্গামন্দিরে। আজও বাঙালির সর্বজনীন দুর্গোৎসবে সেই পদ্ধতিই অনুসৃত হচ্ছে। তবে কংস নারায়ণের পরবর্তী চতুর্থ পুরুষ লক্ষ্মী নারায়ণের সময় সম্রাট আওরঙ্গজেবের ছোট ভাই বাংলার সুবেদার শাহ সুজা বারনই নদের পূর্ব তীরে অবস্থিত রাজা কংসের প্রাসাদ ধ্বংস করে দিয়ে যান। পরে অবশ্য লক্ষ্মী নারায়ণ আওরঙ্গজেবের অনুকম্পায় নদীর পশ্চিম তীরে একটি পরগনা লাভ করেন। সেখানেই রাজবাড়ি নির্মাণ করে রাজত্ব করেন। ১৮৬২ সালে রাজা বীরেশ্বর রায়ের স্ত্রী রানী জয় সুন্দরী রাজবাড়ির সঙ্গে একটি দুর্গামন্দির নির্মাণ করেন। মন্দিরের নামফলকটি বর্তমানে রাজশাহীতে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।
রাজবংশের শেষ রাজা ছিলেন শিবশেখরেশ্বর। তাঁর বাবা শশী শেখরেশ্বরের সময় থেকে রাজারা কলকাতায় গিয়ে থাকতেন। শুধু পূজার সময় আসতেন। ১৯২৭ সালে শেষবারের মতো তিনি তাহেরপুরে এসেছিলেন। এরপর তিনি মারা গেছেন বলে ধারণা করা হয়। একপর্যায়ে রাজবাড়ির এই মন্দিরটি প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে যায়। ১৯৬৭ সালে রাজবাড়িতে কলেজ স্থাপন করা হয়। রাজবাড়ির ভেতর থেকে মন্দিরে যাওয়ার ফটকটিও একসময় বন্ধ করে দেওয়া হয়। মন্দিরটি জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে যায়। বর্তমান মন্দির কমিটির সভাপতি নিশিত কুমার সাহা জানান, গত কয়েক বছর থেকে তাঁরা নতুন করে এই মন্দিরটিতে দুর্গাপূজা শুরু করেছেন।
১৫১০ সালে কুচ বংশের রাজা বিশ্ব সিংহ কুচবিহারে দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন। অনেকে মনে করেন, ১৬০৬ সালে নদিয়ার ভবনানন্দ মজুমদার দূর্গা পূজার প্রবর্তক। ১৬১০ সালে কলকাতার বারিশার রায় চৌধুরী পরিবার প্রথম দূর্গা পূজার আয়োজন করেছিল বলে ধারণা করা হয়। তারাই প্রথম দুর্গার ছেলে-মেয়ে সহ সপরিবারে পূজা চালু করেন । এই পূজা আজো চলছে শুরুর সময়কার আচার পদ্ধতি অনুসারেই। পূজার বোধন হয় কৃষ্ণপক্ষের নবমী তিথিতে, অর্থাৎ মহানবমীর ১৫ দিন আগের তিথিতে। দেবী মূর্তির রূপ ও রংয়ের কোনো পরিবর্তন নেই। মণ্ডপে মূর্তিও তৈরি হয় সেই পুরনো আমলের কাঠামোর ওপর। আটচালা মণ্ডপেই হয় কুমারী পূজা।
চলবে
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত