পুরাণ থেকে বর্তমান
ইতিহাসের পাতায় দুর্গাপূজা
প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২১, ১০:৩৮ | আপডেট : ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮:০০
শাশ্বত স্বপন
----------
৩য় পর্ব
সম্রাট গোপাল স্বয়ং মা চুন্দা/চুন্দির উপাসক ছিলেন, চুন্ডাকে চণ্ডীর আরেকরূপ ধরা হয়। চুন্দা/চুন্দি/চন্দ্রা/চন্দ্রী/চণ্ডী/ এরা কথিত শব্দের বহুরূপ। শরৎকালে চুন্দার উপাসনার কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। গবেষক নীহাররন্জন মত দিয়েছেন যে, আজকের দুর্গা রূপ বিবর্তনে পাল-সেন যুগের চণ্ডী এক গুরুতব্পূর্ণ মাইলফলক ছিল।
রাজা নয়পালের প্রধান উপাস্য মাতৃকা ছিল চর্চিকা। পালযুগে সম্ভবত সব থেকে জনপ্রিয় যোদ্ধা মাতৃকা মা চামুণ্ডা। সম্ভবত নয়পালের সময় পালসেনার রণধ্বনিই ছিল জয় চামুণ্ডা বা জয় চর্চিকা। নয়পালের পিতা মহীপালের সময় বাংলায় প্রথম দশভুজা দুর্গার উপাসনা শুরু হয়েছিল। সুকুমার সেন বলছেন, দশভূজার উপাসনা হত শরৎকালে। কাজেই শরৎকালে মাতৃকা উপাসনা অন্তত পালযুগ থেকে চলছে।
অনেকেই মনে করেন, এই হিসাবে বাঙালীরা ১২/১৩ শত বছর ধরে দুর্গাদেবীর পূজা করে। গবেষক তমাল দাসগুপ্ত মনে করেন, আমাদের আদিযুগের ইতিহাসটা বেশির ভাগই বিধ্বস্ত হয়ে গেছে মধ্যযুগে, ফলে তারও আগে থেকে প্রচলিত থাকার সম্ভাবনা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। তিনি মনে করেন, শরৎকালে মাতৃকা উপাসনা হরপ্পা সভ্যতার সময় থেকে প্রচলিত এবং পালযুগের সূচনাতেও এই শারদীয়া মাতৃকা উপাসনা ছিল, নামটা হয়ত দুর্গা ছিল না, কিন্তু নাম তো বদলায়।
দশম-একাদশ শতকে সম্রাট মহীপালের সময় পালরাষ্ট্রের উপাস্য মাতৃকা ছিলেন মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা। মহীপাল মাতৃকা উপাসক ছিলেন তার আর একটা প্রমাণ এই যে মহীপালের মুদ্রায় স্ফীতোদর জগজ্জননী মাতৃকার মূর্তি থাকত কেবল, সেখানে এমনকি সম্রাটেরও প্রতিকৃতি নেই। পালরা ধর্মে হিন্দু নন, তারা বৌদ্ধ, তারা থেরবাদ নয়, তাঁরা মাতৃকা উপাসক বজ্রযানের অনুসারী ছিলেন। বাঙালির পূর্বজ হরপ্পা সভ্যতার সময় থেকেই মাতৃকা উপাসক। পৌত্তলিকতার হাজার বছরের ধারাবাহিকতায় দুর্গাসহ নানান মাতৃকামূর্তি গড়ে উঠে।
পালযুগে মহীপালের সময় দুর্গাপুজো পালরাষ্ট্রের উদ্যোগে শুরু হওয়ার বেশ কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে। পালযুগের আগের দুর্গামূর্তির তুলনায় এই ষড়ভুজা মূর্তির গঠনশৈলী বেশি প্রাচীন, দশম শতকে পালদের সাথে দাক্ষিণাত্যের ভালো সম্পর্ক থাকায় এই দুর্গামূর্তি দেখতে বেশ প্রাচীন, আর দক্ষিণা প্রভাব আছে।
বিষ্ণুপুরে মহিষাসুরমর্দিনীর পটচিত্রের পুজোর প্রথা প্রচলিত আছে। মল্লরাজাদের মৃণ্ময়ী মা মূলত পটচিত্রে পূজিতা হন, যদিও তাঁর মন্দিরে চিরাচরিত মূর্তিও আছে। পটের চিত্রে ষোলো দিন ধরে মল্লরাজাদের এই দুর্গাপুজো করা হয়, বড়ঠাকুরাণী, মেজোঠাকুরাণী এবং ছোটঠাকুরাণী -- এই তিনজনের পূজা হয় ক্রমান্বয়ে। বিষ্ণুপুরে মা মৃণ্ময়ী উপাসনারও দীর্ঘ ইতিহাস আছে। মল্ল রাজাদের উপাস্য মা দুর্গা এই নামে পূজিতা হন। কথিত আছে, এই পুজো ৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে চলে আসছে, রাজা জগৎ মল্লের সিংহাসনারোহণের বছর থেকে। বর্তমানে সেই মূর্তি নেই।
শারদীয়া দুর্গাপুজা কি রামচন্দ্র শুরু করেছিলেন? মোটেও না। বাল্মিকী রামায়ণে এমন কোনও উল্লেখ নেই। কৃত্তিবাস যখন রামায়ণ লিখছেন, তখন রামকে আপামর বাঙালির কাছে জনপ্রিয় করে তুলতে এই বিষয়টা কল্পনা করেন, এবং তাঁর রামায়ণে সংযোজন করেন। এই অকালবোধন কথাটাও বিভ্রান্তিকর। শরৎকালে মাতৃকা উপাসনা অন্তত গোপালের সময় থেকেই গৌড়বাংলায় প্রচলিত আছে। ধর্মপালের সময়েও রাম আলাদা করে ভগবান রুপে আর্বিভূত হননি। সমসাময়িক পাল ইন্সক্রিপশনে ধর্মপাল সম্পর্কে এমন বলা হয়েছে যে রাজা নল, রাজা পৃথু ও রাজা রামচন্দ্র বহুদিন বিগত, কিন্তু ধর্মপালকে দর্শন করলে তাদের তিনজনকে একত্রে দর্শন করার সুফল হত। এখানে রাম আরও অনেকগুলো মাইথোলজিক্যাল চরিত্রের মধ্যে একজন মানে এই রাম সেই রাম নয়।
বাঙ্গালীর শিকড়ের গবেষক তমাল দাসগুপ্ত বলেন, পালযুগে প্রচুর দুর্গা মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি পাওয়া গেছে, বাঙালির দুর্গাপুজা পালযুগে শুরু। কিন্তু রামকে কোথাও সেই সব মূর্তিতে পাওয়া যায় না, মা দুর্গার উপাসক হিসেবে, সেন যুগেও না। অবশ্য সেনরা শৈব্য ছিলেন। বাঙালির দশভুজা দুর্গাপূজার আদি উৎস চন্দ্রকেতুগড়ের মাতৃকা উপাসনার দশায়ুধা রূপ বলে মনে করা যায়। সেখানে রাম বা অযোধ্যা কেউ নেই।
কংসনারায়ণের অন্তত আটশো বছর আগে থেকেই শারদীয়া চুন্দা/চণ্ডীপুজা বাংলায় প্রচলিত। কিন্তু যেহেতু আদিযুগের ইতিহাস ও শেকড় মধ্যযুগের হানাদারিতে বিধ্বস্ত হয়েছিল, ফলে অনেক ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতার ঐতিহ্য চলমান না হয়ে, লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায়, ফলে নতুন কাহিনী লোকমুখে প্রচলিত হয়।
দুর্গা ও মনসা দুজনেই পালযুগে প্রথমবারের জন্য উপাস্য ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। বলা হয়ে থাকে, দুর্গাপূজার আগেই মনসা পূজা শুরু হয়েছিল। দুই মাতৃকার সম্পর্কেই দাক্ষিণাত্য সংযোগের তত্ত্ব এবং ফলে সেনদের ভূমিকার একটা সম্ভাব্য আভাস কিছু ইতিহাসবিদ দিয়ে থাকেন। কিন্তু পালদের দাক্ষিণাত্য সংযোগ ভুলে গেলে চলবে না। আমাদের ধর্মপাল রাষ্ট্রকূট জামাই, দেবপালের মামাবাড়ি দাক্ষিণাত্য। রামপালের প্রধান সহায়ক ছিলেন তাঁর রাষ্ট্রকূট মাতুল মথন।
সেনরা কর্ণাটকের কোঙ্কণ উপকূলের কাছে ধারওয়াড় থেকে এসেছিলেন, কোঙ্কণ উপকূলে গৌড় সারস্বত ব্রাহ্মণ ও গৌড় সারস্বত বণিক এই পালযুগে বসবাস শুরু করেন। বাংলা থেকে গৌড় সারস্বত অভিবাসনে শুধু ব্রাহ্মণ যাননি, বণিকও গেছিলেন, তারাও কোঙ্কণ অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপন করেন।
ভবিষ্যপুরাণে যে নবদুর্গা মূর্তির কথা বলা হয়েছে, দিনাজপুরে সে রকম নবদুর্গা পাওয়া গেছে বলে জানাচ্ছেন নীহাররঞ্জন। এই নবদুর্গা মূর্তিসমূহের মধ্যস্থলে একটি অষ্টাদশভুজা মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা এবং চারপাশে আটটি অনুরূপ মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি, যাদের প্রত্যেকের ষোলোটি হাত।
সে রকমই একটি মূর্তি দেখছেন এখানে। মায়ের পদদ্বয় প্রত্যালীঢ় ভঙ্গিতে - ডান পা সিংহের ওপর, আর বাঁ পা মহিষের ওপর। একটি পা প্রসারিত, একটি সংকুচিত। যুদ্ধকালে শরসন্ধান করার সময়ে এমনভাবেই পদদ্বয় থাকার নিয়ম। মা চিরকাল এভাবেই বাঙালির ঘরশত্রু ও বহিঃশত্রুদের বিনাশ করুন। রমেশ মজুমদার সম্পাদিত হিস্ট্রি অভ বেঙ্গল হিন্দু পিরিয়ড গ্রন্থে জিতেন্দ্র নাথ ব্যানার্জিকে অনুসরণ করে, নীহাররন্জনের একটি চমৎকার আলোচনা আছে পাল সেন যুগের মূর্তি নিয়ে।
বীরভূমের বক্রেশ্বরেও ষোলো হাতযুক্ত মহিষাসুরমর্দিনীমূর্তি পাওয়া গেছে, নীহাররঞ্জন বলছেন, এই নবদুর্গা পরিকল্পনায় মহাযানীর শাখার বজ্রযানী প্রতিমা বিন্যাসের প্রভাব আছে। কিন্তু তার থেকেও বেশি ছিল ও আছে ইতিহাসের ইঙ্গিতঃ আমাদের মাতৃকা যুগে যুগে বিভিন্ন রূপ ধারণ করেছেন। পুরোহিত দর্পণে দেখা যায় বৃহন্নন্দিকেশ্বর পুরাণে দুর্গাপুজোর বর্ণনায় মূল দুর্গামূর্তিকে ঘিরে থাকা এই অষ্টশক্তির নাম এভাবে দেওয়া হয়েছেঃ উগ্রচণ্ডা, প্রচণ্ডা, চণ্ডোগ্রা, চণ্ডনায়িকা, চণ্ডা, চণ্ডবতী, চণ্ডরূপা ও অতিচণ্ডিকা। নীহাররঞ্জন এই নবদুর্গার মধ্যিখানে থাকা আঠেরো হাতবিশিষ্ট মূর্তিটিকে উগ্রচণ্ডী বলেছেন, আসলে ভবিষ্যপুরাণে উগ্রচণ্ডা আছে। অষ্টাদশভুজা উগ্রচণ্ডীর উপাসনা মূর্তি বাঙালি বণিকরা শ্যাম, কম্বোজ, সুমাত্রা, জাভা, বোর্নিও, বালি, ফিলিপাইন্স প্রভৃতি দেশে নিয়ে যান, ১৯৩১ সালে ডঃ আর এন সাহার লিখিত একটি প্ৰবন্ধ থেকে নোট করে বৃহৎবঙ্গ গ্রন্থে দীনেশচন্দ্র সেন এ তথ্য লিখেছেন। দুর্গার আদি রুপ হয়তো চন্ডী ছিল। দীনেশ চন্দ্র সেন আরো বলেছেন, চণ্ডীকে হাড়িঝি বলা হয়, হাড়িকাঠে বলি হয়। হাড়ির বাড়িতে বাদ্য না বাজলে দুর্গাপূজা শুরু করার নিয়ম নেই অনেক জায়গায়, হাড়ি একটি সুপ্রাচীন বাঙালি কাস্ট, বৈদিক বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার বহির্গত।
চলবে
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত