ইতিহাসের পাতায় দুর্গাপূজা

  সাহিত্য ও সংস্কৃতি ডেস্ক

প্রকাশ: ৩ অক্টোবর ২০২২, ১৪:২৯ |  আপডেট  : ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১২

শাশ্বত স্বপন
-------------------

 

বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্থান তথা ভারতবর্ষ অথবা পৃথিবীতে দুর্গোৎসবের কালক্রমিক ইতিহাস   তৈরি করা এখনো সম্ভব হয়নি। এ কাজের উপযোগী সুস্পষ্ট ও অনুপুঙ্খ ধারাবাহিক তথ্য-উপাত্তও পাওয়া যায়নি। কোনো ইতিহাসবিদ বা সমাজবিজ্ঞানী ভারতবর্ষ তথা পৃথিবীতে দুর্গোৎসব উদ্ভবের ইতিহাস ও আনুষঙ্গিক ঘটনাপঞ্জি নির্ভরযোগ্য দলিলপত্র ঘেঁটে পরিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হননি। ফলে কখন, কীভাবে দুর্গোৎসব শুরু হলো--তা এখনো নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। তবে পুরাণ, মহাভারত, রামায়ন, ধর্মীয় কাব্য, নানা ঐতিহাসিক গ্রন্থ ও সূত্র থেকে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। বাঙালী, ওড়িয়া, মৈথিলী ও অসমীয়া, ত্রিপুরা জাতি ছাড়াও আরো কিছু জাতি নানান রূপ চেতনায়, নানা উপাচারে শরতে বা বসন্তে দুর্গাদেবীর উপাসনার আয়োজন করে থাকে।

(চন্দ্রকেতুগড় থেকে প্রাপ্ত এই ভাস্কর্যটি ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা বারবারা মিউজিয়াম অভ আর্ট-এ আছে। সময়কাল আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক। গঙ্গাল সভ্যতার রণহস্তীর বৃংহণ এবং মাতৃকাদের সাবলীল উল্লাস ভাস্কর্যটিকে মহিমান্বিত করেছে।)
  
দুর্গাপূজা কবে, কখন, কোথায় প্রথম শুরু হয়েছিল--তা নিয়ে ভারতীয় ঐতিহাসিকদের মধ্যে নানা মতভেদ আছে। ভারতের দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃতান্ত্রিক দ্রাবিড় জাতির মধ্যে মাতৃদেবীর পূজার প্রচলন  ছিল। আর্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবতাদের। অনার্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবীদের, তারা পূজিত হতেন আদ্যাশক্তির প্রতীক রূপে। মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের গঠন, দায়িত্ববোধ ও উর্বরতা শক্তির সমন্বয়ের কথা বিবেচনা করে অনার্য সমাজে গড়ে উঠে মাতৃপ্রধান দেবী সংস্কৃতির ধারনা। 
 
ভারতে অবশ্য মাতৃরূপে দেবী সংস্কৃতির ধারনা অতি প্রাচীন। ইতিহাস থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, প্রায় ২২,০০০ বছর পূর্ব ভারতে প্যালিওলিথিক জনগোষ্ঠি থেকেই দেবী পূজা প্রচলিত শুরু হয়েছিল। হরপ্পা ও মহেন্জোদারো সভ্যতা তথা সিন্ধু সভ্যতায় এসে তা আরো গ্রহণযোগ্য, আধুনিক ও বিস্তৃত হয়। মাতৃপ্রধান পরিবারের মা-ই প্রধান শক্তি, তার নেতৃত্বে সংসার পরিচালিত হয়, তার নেতৃত্বে শত্রু নাশ হয়, আর তাই মাকে সামনে রেখে দেবী বিশ্বাসে গড়ে উঠে, গড়ে ওঠে শাক্ত সম্প্রদায় মত। এই মত অনুসারে দেবী হলেন, শক্তির রূপ, তিনি পরমব্রহ্ম। শাক্ত মতে, কালী বিশ্বসৃষ্টির আদি কারণ। অন্যান্য দেব দেবী মানুষের মঙ্গলার্থে তাঁর বিভিন্ন রূপে প্রকাশ মাত্র। মহাভারত অনুসারে, দূর্গা বিবেচিত হন কালী শক্তির আরেক রূপে। নানা অমিল ও বৈচিত্র থাকা সত্বেও কিভাবে কালী দূর্গার রূপের সাথে মিশে এক হয়ে গেল, সে রহস্য আজও অজানা। কেউ কেউ ধারনা করেন, সিন্ধু সভ্যতায় (হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতা) দেবীমাতার, ত্রিমস্তক দেবতা, পশুপতি শিবের পূজার প্রচলন ছিল।  যদিও কোন কোন গবেষক মনে করেন, কালী ও দুর্গাদেবীর সাথে কোন এক সময় শিবকে জুড়ে  দেওয়া হয়েছে।
 
পুরাণ মতে, দূর্গাপূজার ইতিহাস আছে কিন্ত ভক্তদের কাছে সেই ইতিহাস প্রামানিক নয়, বিশ্বাসের। উপমহাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে সিন্ধু ও বেলুচিস্তানে শিবকে দিয়ে যে হিন্দুধর্মের যাত্রা শুরু হয়েছিল, পূর্বাঞ্চলে, বিশেষ করে বাংলায় দুর্গা ও কালীকে দিয়ে সে ধর্মযাত্রার সমাপ্ত হয়...। এরপর সম্ভবত আর কোন অলৌকিক দেবতার জন্ম হয়নি।
 
অস্ট্রিকভাষী নিষাদেরা প্রাচীন বাংলার গভীর অরণ্যে ‘বোঙ্গা’ দেবতার পূজা করত । কোনও কোনও পন্ডিতের ধারণা ওই ‘বোঙ্গা’ থেকেই বঙ্গ, বাংলা শব্দের উদ্ভব। পৌরাণিক আর্যদের ব্যাখ্যায়, দুর্গা ব্রহ্মা, শিব ও বিষ্ণুকর্তৃক সৃষ্ট দেবী এবং দুর্গা কিছুটা উগ্র, স্বাধীন ও কারও স্ত্রী নন। বাংলার হিন্দুধর্মটি হল তান্ত্রিক হিন্দুধর্ম। তন্ত্র হল বেদবিরোধী এবং সাধনার বিষয়। যে কারণে বাঙালি তান্ত্রিকেরা দুর্গাকে পরমা প্রকৃতি, বিশ্বের আদি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
  
প্রাচীন বাংঙ্গালীরা ছিল অবৈদিক আর অনার্য। তারা সুপ্রাচীন কাল থেকেই বহু লোকিক-অলৌলিক দেবদেবীর পূর্জা-অর্চনা করত । প্রাচীনকালে দুর্গাপূজা শস্য পূজারূপে বিরাজমান ছিল। পার্বতী-উমা ছিল শস্যপূজার দেবী। পার্বতী-উমা দুর্গারই ভিন্ন ভি্ন্ন নাম। উমাকে বলা হয় হিমালয়-দুহিতা। যার বাহন সিংহ। সিংহবাহিনী পর্বতকন্যা উমা-পার্বতীই ভারতবর্ষের শক্তি দেবীর প্রাচীন রূপ। এই সিংহবাহিনী পর্বতকন্যা উমা-পার্বতীর সঙ্গে শস্য  পূজার ধারা মিশে এক মহাদেবীর সৃষ্টি হয়েছে, ইনিই দুর্গা।
  
হরপ্পা সভ্যতার ঊষা নামে এক মাতৃকাদেবীর নাম উল্লেখ করেছেন বলেছেন গবেষক ডি ডি কোসাম্বি। গবেষক সুকুমার সেন মনে করেন, ঊষা দেবীর উপাসনা শরৎকালে হত। সেক্ষেত্রে এই শারদীয়া মাতৃকা উপাসনা উপমহাদেশে অন্তত সাড়ে চার হাজার বছর ধরে প্রচলিত বলা যায়।  তবে এটাও সত্য, হাজার হাজার বছর ধরে মাতৃকা দেবীপ্রধান এই ভারতে শরৎকালে অনেক দেবীর পূজা হত।
  
প্রথমে পূজিতা সা চ কৃষ্ণেন পরমাত্মনা।
বৃন্দাবনে চ সৃষ্ট্যাদ্যৌ গোলকে রাগমণ্ডলে।
মধুকৈটভভীতেন ব্রহ্মণা সা দ্বিতীয়তঃ।
ত্রিপুরপ্রেষিতেনৈব তৃতীয়ে ত্রিপুরারিণা।।
ভ্রষ্টশ্রিয়া মহেন্দ্রেন শাপাদ্দুর্বাসসঃ পুরা। চ
তুর্থে পূজিতা দেবী ভক্ত্যা ভগবতী সতী।।
তদা মুনীন্দ্রৈঃ সিদ্ধেন্দ্রৈর্দেবৈশ্চ মুনিমানবৈঃ।
পূজিতা সর্ববিশ্বেষু বভূব সর্ব্বতঃ সদা। (ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ)

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে, দুর্গাপূজার প্রথম প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ, তিনি বৈকুন্ঠের আদি বৃন্দাবনের মহারাস মণ্ডলে প্রথম পূজা করেন, এরপর মধু ও কৈটভ নামে দুই অসুরের ভয়ে দ্বিতীয় বার দুর্গাপূজা করেন স্বয়ং ব্রহ্মা আর ত্রিপুর নামে এক অসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে  তৃতীয়বার দুর্গা পূজার আয়োজন করেন মহাদেব। দুর্বাসা মুনির অভিশাপে লক্ষ্মীকে হারিয়ে ইন্দ্র যে পূজার আয়োজন করেছিলেন, সেটি ছিল চতুর্থ দুর্গাপূজা। এরপর থেকেই পৃথিবীতে মুনিঋষি, সিদ্ধপুরুষ, দেবতা ও মানুষেরা নানা দেশে নানা সময়ে দুর্গাপূজা করে আসছে।

(বৈষ্ণবী ও বারাহী দেবী শুম্ভ-নিশুম্ভের অসুরসৈন্যের সঙ্গে যুদ্ধরতা, সপ্তদশ শতাব্দীর পুঁথিচিত্রণ)

আবার দেবী ভাগবত পুরান অনুসারে জানতে পারি, ব্রহ্মার মানস পুত্র মনু ক্ষীরোধ সাগরের তীরে দুর্গার আরাধনা করে বর লাভে সফল হন। দুর্গা তার রাজ্যশাসনের পথ নিষ্কণ্টক করেন এবং মনুকে পুত্রলাভের বরও দেন। [প্রবন্ধঃ শব্দাঞ্জলিতে দুর্গাপূজা, হরিপদ ভৌমিক, নতুন বাংলার মুখ পত্রিকা, আশ্বিন ১৪১৪, অক্টোবর ২০০৭, পৃ. ১৬৩-৬৪ দ্রঃ]।

দুর্গা ও দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে যতগুলি পৌরাণিক গল্প প্রচলিত আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্পটি পাওয়া যায়  শ্রীশ্রীচণ্ডী বা দেবীমাহাত্মম-এ । এই গল্পটি হিন্দুরা এতটাই মান্য করে যে  শ্রীশ্রীচণ্ডীর পাঠ দুর্গাপূজার একটি অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে গিয়েছে। দেবীমাহাত্মম  আসলে মার্কণ্ডেয় পুরান-এর একটি নির্বাচিত অংশ। এতে তেরোটি অধ্যায়ে মোট সাতশোটি শ্লোক আছে। এই বইতে দুর্গাকে নিয়ে প্রচলিত তিনটি গল্প ও দুর্গাপূজা প্রচলনের একটি গল্প রয়েছে। 

পুরাণ মতে, দুর্গা পর্ণশবরী ৷ তিনি শবরদের দেবী। পর্ণশবরী ৷ দেবী ভাগবতে হলেন ‘সর্বশবরানাং ভগবতী’৷ ঝাড়খণ্ডের বনবাসী শবর মেয়েরা এখনও দুর্গা মূর্তি বিসর্জনের শোভাযাত্রায় আকণ্ঠ মদ্যপানের পর উর্ধাঙ্গ অনাবৃত রেখেই নাচতে নাচতে বিসর্জনে যান৷ মহাভারতের পরিশিষ্ট ‘হরিবংশ’-এর ‘আর্যাস্তব’-এ বলা হয়েছে, ‘শিখীপিচ্ছধ্বজাধরা’ ও ‘ময়ূরপিচ্ছধ্বজিনী’ এই বিন্ধ্যবাসিনী দেবীর মদ্য ও মাংসে ছিল অপরিসীম আসক্তি। সপ্তম ও অষ্টম শতকের কবি বাণদেব ভট্ট ও বাকপতিও এই মতেই বিন্ধ্যবাসিনী দেবীর পুজোর উল্লেখ করে বলেছেন, দেবী পশু ও নররক্তের পিপাসু ছিলেন। কথাসরিৎসাগর-এর ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’ অংশে একাদশ শতকের পণ্ডিত সোমদেব ভট্ট বলেছেন, রাজা যশকেতুর রাজ্যে মহিষের কাটা মুণ্ড-র উপর নৃত্যরতা আঠারো হাত বিশিষ্ট এক দেবীর কথা, দস্যু ও ডাকাতরা যার কাছে নরবলি দিত। শাস্ত্র মতে এই দেবীর নাম ‘পাতালভৈরবী’। আসলে দূর্গা-কালী-চন্ডী-পাতালভৈরবী সহ আরো নানা দেবীকে দুর্গার সাথে গুলিয়ে ফেলে নানা কথা বলা হয়েছে। হয়তো সুপ্রাচীন কালে দুর্গাকে এরূপেই পূজা করা হত এবং এগুলোই ছিল দুর্গার আদিরূপ।

 মূল বাল্মীকির রামায়ণে, দুর্গাপুজার কোন অস্থিত্বই নাই। কিন্তু কৃত্তিবাসী রামায়নে দুর্গাপুজার অস্থিত্ব আছে। কৃত্তিবাসী রামায়ণ-এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, এটি মূল রামায়ণের আক্ষরিক অনুবাদ নয়। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী কবি কৃত্তিবাস ওঝা সংস্কৃত রামায়ণ বাংলা করার সময় মূল রামায়ণের বাইরের তৎলালীন সমাজে প্রচলিত বাংলার সামাজিক রীতিনীতি ও লৌকিক জীবনের নানা অনুষঙ্গ, অনেক মিথ, গল্প বাংলা রামায়ণে  সংযোগ করে বাংলা রামায়ণ আরো অধিক সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেন। অন্যভাবে বলা যেতে পারে, তিনি সংস্কৃত রামায়ণ উপাখ্যানের এমনভাবে বঙ্গীকরণ বা বাংগালীকরন করেন যা পড়লে মনে হবে, রামায়নের ঘটনা তার সমাজের আদি কাহিনী।  [রামায়ণ কৃত্তিবাস বিরচিত, হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ও ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখিত ভূমিকা সম্বলিত, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ১৯৫৭ সংস্করণ]

তাঁর এই অনুবাদকৃত রামায়ণ পরিচিত পায় কৃত্তিবাসী রামায়ণ নামে--যা বাংলাভাষী হিন্দু সমাজে বেশ জনপ্রিয়তা পায়, সেখানে তিনি কালিকা পুরাণের ঘটনা অনুসরণে ব্রহ্মার পরামর্শে রামের দূর্গা পূজা করার কথা উল্লেখ করেছেন। শক্তিশালী রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বিজয় নিশ্চিত করতে শরৎকালে শ্রী রামচন্দ্র কালিদহ সাগর থেকে ১০১ টি নীল পদ্ম সংগ্রহ করে প্রাক্ প্রস্তুতি হিসাবে দুর্গাপূজা করে দুর্গার কৃপা লাভ করেন বলে কৃত্তিবাস ওঝা বর্ণনা করেছেন। তবে দুর্গা পূজার সব চাইতে বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায় মার্কন্ডুয়ে পুরানে। যেখানে মহির্ষী জৈমিনি ও মহির্ষী মার্কন্ডুয়ের কথোপকথনের ভিত্তিতে পুরাণটি রচিত হয়। এই পুরাণের মধ্যে তেরটি অধ্যায় দেবীমহাত্মম নামে পরিচিত। বাংলায় শ্রীশ্রীচন্ডি নামে সাতশত শ্লোক বিশিষ্ট দেবী মহাত্মম পাঠ আছে--যা দুর্গা পূজার প্রধান ও অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে পূজার আসরে স্থায়ী হয়ে গেছে ।

চন্দ্রকেতুগড় গঙ্গাল সভ্যতায় একজন মাতৃকার উপাসনা প্রচলিত ছিল যাঁর মাথার চুলের দশটি কাঁটা ছিল, দশটি আয়ুধ, এবং বেশিরভাগ মূর্তিতে তার সঙ্গে থাকে চারজন সহচর।  নিচের ছবিতে সঙ্গী একজন বাচ্চা দেখা যাচ্ছে।  ছাঁচটা  অবতল হলেও উত্তলও মনে হয়। এঁকে যক্ষী বা পঞ্চচূড়া অপ্সরা বলেন কেউ কেউ, যদিও উপাস্য মাতৃকা বলে স্বীকার করেছেন অনেকে।  গবেষক তমাল দাসগুপ্ত একে মা দশায়ুধা বলেন। হতে পারে,  এই মাতৃকা রূপই দেবী দূর্গার আদি রূপ।

সনাতন ধর্মের আর্য ঋষিরা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের প্রতীক হিসাবে দেবী দুর্গার আশীর্বাদ লাভের জন্য আরাধনা করতেন। মার্কন্ডুয়ে পুরান [Markandeya Purana ] মতে, চেদী রাজবংশের রাজা সুরাথা(Suratha) খ্রীষ্ঠের জন্মের ৩০০ বছর আগে কলিঙ্গে (বর্তমানে ওড়িষ্যা) Duseehera নামে দুর্গাপূজা প্রচলন করেছিল এবং  রাজা সুরাথা মহাষ্টমীর সন্ধিপূজার পর পাঠা বলির প্রথা চালু করেন।  নেপালে Duseehera বা Dashain নামেই পুজা হয়। যদিও প্রাচীন ওরিষ্যার সাথে নেপালের পূজার যোগসূত্র আছে কিনা সে তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। পুরাণ মতে, দুর্গাপূজার ইতিহাস আছে কিন্ত ভক্তদের কাছে সেই ইতিহাস প্রামানিক নয়, বিশ্বাসের।

ভারত বর্ষের ইতিহাসে মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ ও তার সংলগ্ন কিচু এলাকাকে দাক্ষিণত্য বলে ধরা হয়ে থাকে। মৌর্য পরবর্তী যুগে  এই এলাকায় সর্বপ্রথম ও সর্ববৃহৎ রাজবংশ সাতবাহনদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, সেই সাথে সমসাময়িক কলিঙ্গে চেদী বংশের খ্যাতিও শুনা যায়। এই চেদী বংশের এক রাজা নাম সুরথ[sutratha]। প্রচলিত মিথ যে, এই রাজা সুরাথা প্রথম দুর্গাপূজা শুরু করেছিলেন। 

পরিব্রাজক, বৌদ্ধ পন্ডিত হিউয়েন সাংকে নিয়ে দুর্গাপূজার একটি কাহিনী প্রচলিত আছে। চীনা ভাষায় রচিত বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাখায় বিভ্রান্ত হয়ে তিনি বৌদ্ধধর্মের মূল পান্ডুলিপি সংগ্রহে  আনুমানিক ৬৩০ সালে ভারত সফরে আসেন। ভারত বর্ষের নানা বিহারে বিদ্যা অর্জন করেন। ৬৩৫-৬৪৩ পর্যন্ত দীর্ঘ আট বছর তিনি হর্ষবর্ধনের রাজ সভায় ছিলেন। তবে তার কাহিনী দুর্গা, কালী, কালীর আরেক রূপ চন্ডি নাকি অন্য কোনো  বন দেবীকে নিয়ে-তা নিয়ে মতবেধ আছে। তবে তার রচনায় উল্লেখ করেছেন, হর্ষবর্ধন এর সময়ে দস্যু তস্কর এর উপদ্রব খুব বেশি ছিল এবং তিনি নিজেও একাধিক বার দস্যুর হাতে নিগৃহিত হয়েছিলেন। তার প্রবাস জীবনের কোন এক সময়ে গঙ্গাপথে [প্রাচীন গঙ্গারিডি] এই পরিব্রাজক কোন বৌদ্ধ বিহারে যাচ্ছিলেন। পথে দস্যুর কবলে পড়লেন। দস্যুরা তাকে দেবী দূর্গার সামনে বলি দেওয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছে। কেউ মনে করেন, বন দেবী, কেউ মনে করেন কালী, কারণ প্রাচীনকালে নরমুন্ড ভোগ দেবার বিষয়টি বনদেবীদের বা কালী দেবীর জন্য প্রযোজ্য ছিল--যা এখন পাঠা  দিয়ে পূরণ করা হয়। দুর্গা মাকে খুশী করার জন্য নরমুণ্ড ভোগ দেবার বিষয়টি ইতিহাস থেকে জানা যায় না। যাই হোক, বলির পূর্ব প্রস্ততি প্রায় শেষ, এমন সময় প্রচন্ড বেগে ঝড় ছুটে এল। সব আয়োজন ঝড়ের কবলে লন্ডবন্ড হয়ে গেল। ডাকাতরা জান বাঁচাতে পালাতে লাগল। সেই সুযোগে হিউয়েন সাংও পালিয়ে যান।

অষ্টম শতাব্দিতে  রাস্ট্রকূট রাজাদের আমলে কর্ণাটকে প্রকৃতিমাতা বন সংকরী দেবীর পূজা হতো। সময়টা ধরা হয়ে থাকে যে, এ মন্দির  অষ্টম শতাব্দির বা তারও আগের। বর্তমানে ভক্তরা বন সংকরী দেবীকে দূর্গা, সরস্বতী ও লক্ষীর মিলিত রূপ মনে করে। এই মন্দিরের উল্টোদিকে  শাকম্ভরী নামে একটা দিঘী আছে। আবার শাকম্ভরী দূর্গার আরেক নাম।

ভারতের পূর্বপ্রান্তে পশ্চিম বঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বনবিষ্ণুপুরে (বর্তমানে বিষ্ণুপুর)মল্ল রাজবাড়ির অবস্থান। দশম শতাব্দির শেষদিকে  মল্লরাজ জগৎমল্ল তাঁদের কুলদেবী মৃন্ময়ীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে মন্দির তৈরি করেন। এখন বিষ্ণুপুর পৌরসভা এই পূজার দায়িত্ব পালন করেন। এই বিষ্ণুপুরই পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীনতম দুর্গাপুজার স্থান। অনেকে মনে করেন, তখন সপরিবারে দুর্গাপুজা শুরু হয়নি, হয়েছে মৃন্ময়ী দেবীর নামে যা দুর্গার আরেক নাম। 
  
দ্বাদশ শতাব্দির প্রথম ভাগে রচিত  রাজা রামপালের রাজকবি সন্ধাকর নন্দি রচিত ‘ রামচরিত’ কাব্য থেকে জানা যায়,  উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্রভুমিতে[প্রাচীন কট্রলী] বিশাল আয়োজনে উমাপূজা হত (দুর্গার আরেক নাম)। প্রায় একই সময়ে বাঙ্গালী পণ্ডিত শূলপাণি রচনা করছেন, দুর্গোসব, বাসন্তি বিবেক, দুর্গোৎসব প্রয়োগ নামে তিনটি লেখা।  তিনি লেখার তথ্যগুলো সংগ্রহ করেছিলেন প্রাচীন স্মার্ত পণ্ডিত জীকন ও বালকের লেখা থেকে। শূলপাণির সমসাময়িক জীমূতবাহন দুর্গোসব নির্ণয় নামে গ্রন্থে মাটির প্রতিমার দুর্গাপুজার বিষয়ে উল্লেখ করেছেন। প্রাচীনকালে শুধু খড় মাটি নয়, কাঠ, ধাতু বা পাথরের প্রতিমাতেও দুর্গাপূজা হত   এবং এখনো পশ্চিমবঙ্গের কিছু জায়গায় তা হয়।  লেখক অর্ণব বলেন, বৌদ্ধ পাল রাজাদের রাজত্বকালের শেষভাগে বাংলার দুর্গাপুজা উৎসবে পরিণত হয়। লেখক অর্ণবের সাথে গবেষক তমাল দাসগুপ্ত একমত পোষণ করেন না। তমাল দাসগুপ্ত  মনে করেন, সেন আমলে দেবী গৌণ করে দেবতাদের মূখ্য করা হয়েছে।

লেখক অর্ণব বলেন, চৈতন্যপার্ষদ নিত্যানন্দ প্রভুও [১৪৭৪-১৫৩২] অধুনা উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার খড়দহে স্বগৃহে প্রতিমায় দুর্গোৎসব করতেন। তাঁর বংশধরেরা আজও বেঁচে আছেন এবং তাঁরাও সেই দুর্গোৎসবের ধারা বজায় রেখেছেন। মনে রাখা দরকার, দুর্গাপূজা সাধারণত জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হলেও, দুর্গাপূজার প্রাচীন বিধানগুলিতে সাধারণ পঞ্চোপচারে এবং তার অভাবে শুধুমাত্র গঙ্গাজলে দুর্গাপূজারও বিধান পাওয়া যায়। দার্জিলিং জেলার একটি বৌদ্ধ পরিবারে এমন এক সরল দুর্গাপূজা দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম।[বাঙালির দুর্গাপূজা–এক সুপ্রাচীন মহোৎসব, লেখক অর্ণব Arnab]

[গঙ্গাল সভ্যতার দশায়ুধা মূর্তি, যাঁর সঙ্গে চারজন সহচর, গঙ্গারিডাই যুগের দশায়ুধা পরবর্তী পালযুগে দশভুজা হয়ে ফিরে এসেছেন]
সম্রাট গোপাল স্বয়ং মা চুন্দা/চুন্দির উপাসক ছিলেন, চুন্ডাকে চণ্ডীর আরেকরূপ ধরা হয়। চুন্দা/চুন্দি/চন্দ্রা/চন্দ্রী/চণ্ডী/ এরা কথিত শব্দের বহুরূপ। শরৎকালে চুন্দার উপাসনার কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। গবেষক নীহাররন্জন মত দিয়েছেন যে, আজকের দুর্গা রূপ  বিবর্তনে পাল-সেন যুগের চণ্ডী এক গুরুতব্পূর্ণ মাইলফলক ছিল।
 
 রাজা নয়পালের প্রধান উপাস্য মাতৃকা ছিল চর্চিকা। পালযুগে সম্ভবত সব থেকে জনপ্রিয় যোদ্ধা মাতৃকা মা চামুণ্ডা। সম্ভবত নয়পালের সময় পালসেনার রণধ্বনিই ছিল জয় চামুণ্ডা বা জয় চর্চিকা। নয়পালের পিতা মহীপালের সময় বাংলায় প্রথম দশভুজা দুর্গার উপাসনা শুরু হয়েছিল। সুকুমার সেন বলছেন, দশভূজার উপাসনা হত শরৎকালে। কাজেই শরৎকালে মাতৃকা উপাসনা অন্তত পালযুগ থেকে চলছে।
 
অনেকেই মনে করেন, এই হিসাবে বাঙালীরা ১২/১৩ শত বছর ধরে দুর্গাদেবীর পূজা করে। গবেষক তমাল দাসগুপ্ত মনে করেন, আমাদের আদিযুগের ইতিহাসটা বেশির ভাগই বিধ্বস্ত হয়ে গেছে মধ্যযুগে, ফলে তারও আগে থেকে প্রচলিত থাকার সম্ভাবনা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। তিনি মনে করেন, শরৎকালে মাতৃকা উপাসনা হরপ্পা সভ্যতার সময় থেকে প্রচলিত এবং পালযুগের সূচনাতেও এই শারদীয়া মাতৃকা উপাসনা ছিল, নামটা হয়ত দুর্গা ছিল না, কিন্তু নাম তো বদলায়।
  
দশম-একাদশ শতকে সম্রাট মহীপালের সময় পালরাষ্ট্রের উপাস্য মাতৃকা ছিলেন মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা। মহীপাল মাতৃকা উপাসক ছিলেন তার আর একটা প্রমাণ এই যে মহীপালের মুদ্রায় স্ফীতোদর জগজ্জননী মাতৃকার মূর্তি থাকত কেবল, সেখানে এমনকি সম্রাটেরও প্রতিকৃতি নেই। পালরা ধর্মে হিন্দু নন, তারা বৌদ্ধ, তারা  থেরবাদ নয়, তাঁরা মাতৃকা উপাসক বজ্রযানের অনুসারী ছিলেন। বাঙালির পূর্বজ হরপ্পা সভ্যতার সময় থেকেই মাতৃকা উপাসক। পৌত্তলিকতার হাজার বছরের ধারাবাহিকতায়  দুর্গাসহ নানান মাতৃকামূর্তি গড়ে উঠে।
 
পালযুগে মহীপালের সময় দুর্গাপুজো পালরাষ্ট্রের উদ্যোগে শুরু হওয়ার বেশ কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে। পালযুগের  আগের দুর্গামূর্তির তুলনায় এই ষড়ভুজা মূর্তির গঠনশৈলী বেশি প্রাচীন,  দশম শতকে পালদের সাথে দাক্ষিণাত্যের ভালো সম্পর্ক থাকায় এই দুর্গামূর্তি দেখতে বেশ প্রাচীন, আর দক্ষিণা প্রভাব আছে।


 
( পালযুগের দশভুজা মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা মূর্তি, একাদশ শতক। এটির বর্তমান অবস্থান ডালাস মিউজিয়াম অভ আর্ট)

বিষ্ণুপুরে মহিষাসুরমর্দিনীর পটচিত্রের পুজোর প্রথা প্রচলিত আছে। মল্লরাজাদের মৃণ্ময়ী মা মূলত পটচিত্রে পূজিতা হন, যদিও তাঁর মন্দিরে চিরাচরিত মূর্তিও আছে। পটের চিত্রে ষোলো দিন ধরে মল্লরাজাদের এই দুর্গাপুজো করা হয়, বড়ঠাকুরাণী, মেজোঠাকুরাণী এবং ছোটঠাকুরাণী - এই তিনজনের পূজা হয় ক্রমান্বয়ে। বিষ্ণুপুরে মা মৃণ্ময়ী উপাসনারও দীর্ঘ ইতিহাস আছে। মল্ল রাজাদের উপাস্য মা দুর্গা এই নামে পূজিতা হন, কথিত আছে এই পুজো ৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে চলে আসছে, রাজা জগৎ মল্লের সিংহাসনারোহণের বছর থেকে। বর্তমানে সেই মূর্তি নেই।

(পাল যুগের মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা  (ক্রিস্টিজ এই মূর্তিটি (গঠন: black stone stele, দৈর্ঘ্য: 49.5 cm) পঁচিশ হাজার মার্কিন ডলারে নিলাম করেছে)

শারদীয়া দুর্গাপুজা কি রামচন্দ্র শুরু করেছিলেন? মোটেও না। বাল্মিকী রামায়ণে এমন কোনও উল্লেখ নেই। কৃত্তিবাস যখন রামায়ণ লিখছেন, তখন রামকে আপামর বাঙালির কাছে জনপ্রিয় করে তুলতে এই বিষয়টা কল্পনা করেন, এবং তাঁর রামায়ণে সংযোজন করেন। এই অকালবোধন কথাটাও বিভ্রান্তিকর।  শরৎকালে মাতৃকা উপাসনা অন্তত গোপালের সময় থেকেই গৌড়বাংলায় প্রচলিত আছে। ধর্মপালের সময়েও রাম আলাদা করে  ভগবান রুপে আর্বিভূত হননি। সমসাময়িক পাল ইন্সক্রিপশনে  ধর্মপাল সম্পর্কে এমন বলা হয়েছে যে রাজা নল, রাজা পৃথু ও রাজা রামচন্দ্র বহুদিন বিগত, কিন্তু ধর্মপালকে দর্শন করলে তাদের তিনজনকে একত্রে দর্শন করার সুফল হত।  এখানে রাম আরও অনেকগুলো মাইথোলজিক্যাল চরিত্রের মধ্যে একজন মানে এই রাম সেই রাম নয়।

বাঙ্গালীর শিকড়ের গবেষক তমাল দাসগুপ্ত বলেন, পালযুগে প্রচুর দুর্গা মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি পাওয়া গেছে, বাঙালির দুর্গাপুজা পালযুগে শুরু। কিন্তু রামকে কোথাও সেই সব মূর্তিতে পাওয়া যায় না, মা দুর্গার উপাসক হিসেবে, সেন যুগেও না। অবশ্য সেনরা শৈব্য ছিলেন। বাঙালির দশভুজা দুর্গাপুজার আদি উৎস চন্দ্রকেতুগড়ের মাতৃকা উপাসনার দশায়ুধা রূপ বলে মনে করা যায়। সেখানে রাম বা অযোধ্যা কেউ নেই।

 

(ক্রিস্টিজ পালযুগের এই অষ্টভুজা মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গামূর্তিটি ১৪১০০ মার্কিন ডলারে নিলাম করেছিল ২০শে মার্চ ২০০২ সালে। এই অতিক্ষুদ্র (৩ ইঞ্চি) প্রস্তর মূর্তিটিতে কিঞ্চিৎ বৌদ্ধ আইকোনোগ্রাফির প্রভাব আমি লক্ষ্য করা যায়। ক্রিস্টিজ সাইটের বিবরণ থেকে জানছি যে মূর্তির ওপরে একদা সোনার আস্তরণ ছিল, তার যৎসামান্য অবশেষ এখনও লেগে আছে)
 
কংসনারায়ণের অন্তত আটশো বছর আগে থেকেই শারদীয়া চুন্দা/চণ্ডীপুজা বাংলায় প্রচলিত। কিন্তু যেহেতু আদিযুগের ইতিহাস ও শেকড় মধ্যযুগের হানাদারিতে বিধ্বস্ত হয়েছিল, ফলে অনেক ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতার ঐতিহ্য চলমান না হয়ে, লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায়, ফলে নতুন কাহিনী লোকমুখে প্রচলিত হয়।

পাল যুগের মা মনসা

দুর্গা ও মনসা দুজনেই পালযুগে প্রথমবারের জন্য উপাস্য ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। বলা হয়ে থাকে, দুর্গাপূজার আগেই মনসা পূজা শুরু হয়েছিল।  দুই মাতৃকার সম্পর্কেই দাক্ষিণাত্য সংযোগের তত্ত্ব এবং ফলে সেনদের ভূমিকার একটা সম্ভাব্য আভাস কিছু ইতিহাসবিদ দিয়ে থাকেন। কিন্তু পালদের দাক্ষিণাত্য সংযোগ ভুলে গেলে চলবে না। আমাদের ধর্মপাল রাষ্ট্রকূট জামাই, দেবপালের মামাবাড়ি দাক্ষিণাত্য। রামপালের প্রধান সহায়ক ছিলেন তাঁর রাষ্ট্রকূট মাতুল মথন। 
 
সেনরা কর্ণাটকের কোঙ্কণ উপকূলের কাছে ধারওয়াড় থেকে এসেছিলেন, কোঙ্কণ উপকূলে গৌড় সারস্বত ব্রাহ্মণ ও গৌড় সারস্বত বণিক এই পালযুগে বসবাস শুরু করেন।  বাংলা থেকে গৌড় সারস্বত অভিবাসনে শুধু ব্রাহ্মণ যাননি, বণিকও গেছিলেন, তারাও কোঙ্কণ অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপন করেন। 

ভবিষ্যপুরাণে যে নবদুর্গা মূর্তির কথা বলা হয়েছে, দিনাজপুরে সে রকম নবদুর্গা পাওয়া গেছে বলে জানাচ্ছেন নীহাররঞ্জন। এই নবদুর্গা মূর্তিসমূহের মধ্যস্থলে একটি অষ্টাদশভুজা মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা এবং চারপাশে আটটি অনুরূপ মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি, যাদের প্রত্যেকের ষোলোটি হাত। 
সে রকমই একটি মূর্তি দেখছেন এখানে। মায়ের পদদ্বয় প্রত্যালীঢ় ভঙ্গিতে - ডান পা সিংহের ওপর, আর বাঁ পা মহিষের ওপর। একটি পা প্রসারিত, একটি সংকুচিত। যুদ্ধকালে শরসন্ধান করার সময়ে এমনভাবেই পদদ্বয় থাকার নিয়ম। মা চিরকাল এভাবেই বাঙালির ঘরশত্রু ও বহিঃশত্রুদের বিনাশ করুন। (রমেশ মজুমদার সম্পাদিত হিস্ট্রি অভ বেঙ্গল হিন্দু পিরিয়ড গ্রন্থে   জিতেন্দ্র নাথ ব্যানার্জিকে অনুসরণ করে, নীহাররন্জনের  একটি চমৎকার আলোচনা আছে পাল সেন যুগের মূর্তি নিয়ে)

(ষোড়শভুজা মহিষাসুরমর্দিনী। দ্বাদশ শতক, সেনযুগ। পাথরের মূর্তি (আর্জিলাইট)। মূর্তিটির বর্তমান স্থান মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম অভ আর্ট, নিউ ইয়র্ক)

বীরভূমের বক্রেশ্বরেও ষোলো হাতযুক্ত মহিষাসুরমর্দিনীমূর্তি পাওয়া গেছে, নীহাররঞ্জন বলছেন, এই নবদুর্গা পরিকল্পনায় মহাযানীর শাখার বজ্রযানী প্রতিমা বিন্যাসের প্রভাব আছে। 

কিন্তু তার থেকেও বেশি ছিল ও আছে ইতিহাসের ইঙ্গিতঃ আমাদের মাতৃকা যুগে যুগে বিভিন্ন রূপ ধারণ করেছেন। পুরোহিত দর্পণে দেখা যায় বৃহন্নন্দিকেশ্বর পুরাণে দুর্গাপুজোর বর্ণনায় মূল দুর্গামূর্তিকে ঘিরে থাকা এই অষ্টশক্তির নাম এভাবে দেওয়া হয়েছেঃ উগ্রচণ্ডা, প্রচণ্ডা, চণ্ডোগ্রা, চণ্ডনায়িকা, চণ্ডা, চণ্ডবতী, চণ্ডরূপা, অতিচণ্ডিকা। নীহাররঞ্জন এই নবদুর্গার মধ্যিখানে থাকা আঠেরো হাতবিশিষ্ট মূর্তিটিকে উগ্রচণ্ডী বলেছেন, আসলে ভবিষ্যপুরাণে উগ্রচণ্ডা আছে। অষ্টাদশভুজা উগ্রচণ্ডীর উপাসনা মূর্তি বাঙালি বণিকরা শ্যাম, কম্বোজ, সুমাত্রা, জাভা, বোর্নিও, বালি, ফিলিপাইন্স প্রভৃতি দেশে নিয়ে যান, ১৯৩১ সালে ডঃ আর এন সাহার লিখিত একটি প্ৰবন্ধ থেকে নোট করে বৃহৎবঙ্গ গ্রন্থে দীনেশচন্দ্র সেন এ তথ্য লিখেছেন। দুর্গার আদি রুপ হয়তো চন্ডী ছিল। দীনেশ চন্দ্র সেন আরো বলেছেন, চণ্ডীকে হাড়িঝি বলা হয়, হাড়িকাঠে বলি হয়। হাড়ির বাড়িতে বাদ্য না বাজলে দুর্গাপূজা শুরু করার নিয়ম নেই অনেক জায়গায়, হাড়ি একটি সুপ্রাচীন বাঙালি কাস্ট, বৈদিক বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার বহির্গত।
 
কোন কোন গবেষক মনে করেন,  বাংলার মাটিতে দুর্গা দেবীর প্রবর্তন হয় সেন আমলে। সবচেয়ে প্রাচীন দুর্গামূর্তি পাওয়া যায় কর্ণাটকে। সেখান থেকে বাংলার মাটিতে প্রাচীন সংস্কৃতি বিনষ্ট করে ব্রাক্ষণ্যবাদের প্রবর্তন করেন সেনরা।

(ধর্মপালের সময় নেপাল পালসাম্রাজ্যে অংশীভূত হয়েছিল। নেপালের একটি চামুণ্ডা মূর্তি দেখছেন, তামার তৈরি (সময়কাল অবশ্য পালযুগের বেশ খানিকটা পরে, চতুর্দশ শতক), এটির বর্তমান অবস্থান লস এঞ্জেলস কাউন্টি মিউজিয়াম অভ আর্ট)

পাল যুগের ভারতীয় চামুন্ডা
 
দূর্গাপূজার একটি বিশেষ অধ্যায় হল সন্ধিপূজা। দূর্গাপূজার অষ্টমীর দিন হয় এই বিশেষ পূজা, এই পূজার সময়কাল ৪৮ মিনিট। অষ্টমী তিথির শেষ ২৪ মিনিট ও নবমী তিথির প্রথম ২৪ মিনিট মোট ৪৮ মিনিটের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় এই পূজা। যেহেতু অষ্টমী ও নবমী তিথির সংযোগ স্থলে এই পূজা হয় তাই এই পূজার নাম সন্ধিপূজা অর্থ্যাৎ সন্ধি-কালিন পূজা। এই পূজা দূর্গাপূজার একটি বিশেষ অঙ্গ, এই সময় দেবী দূর্গাকে চামুন্ডা রূপে পূজা করা হয়ে থাকে।
 
অপরাজিতা পূজা দুর্গাপূজার একটি অঙ্গ। দুর্গার অপর নাম অপরাজিতা। তবে এই দেবীর মূর্তি অন্যরকম। ইনি চতুর্ভূজা, দেবীর হাতে শঙ্খ, চক্র, বর ও অভয়মুদ্রা থাকে এবং গায়ের রং নীল, দেবী ত্রিনয়না ও মাথায় চন্দ্রকলা। বিজয়া দশমীর দিন বিসর্জনের পর পূজামণ্ডপের ঈশানকোণে অষ্টদল পদ্ম এঁকে অপরাজিতার লতা রেখে এই দেবীর পূজা করা হয়। শক্তিপুরাণ ও মার্কেণ্ডপুরাণ মতে, ইনি বৈষ্ণবী শক্তি বিষ্ণুমায়া ও শিবশক্তি শিবানীর মিশ্রণে কল্পিতা।
 
পূজামণ্ডপে নবপত্রিকা প্রবেশের মাধ্যমে দুর্গাপূজার মূল অনুষ্ঠানটির প্রথাগত সূচনা হয়। নবপত্রিকা প্রবেশের পর দর্পণে দেবীকে মহাস্নান করানো হয়। এরপর বাকি দিনগুলিতে নবপত্রিকা প্রতিমাস্থ দেবদেবীদের সঙ্গেই পূজিত হতে থাকে। বিশেষভাবে লক্ষণীয় হল, নবপত্রিকা প্রবেশের পূর্বে পত্রিকার সম্মুখে দেবী চামুণ্ডার আবাহন ও পূজা করা হয়। পত্রিকাস্থ অপর কোনো দেবীকে পৃথকভাবে পূজা করা হয় না।
  
শ্রীশ্রীদেবীমাহাত্ম্য সম্পর্কে‘চণ্ডী’-তে দেবী নিজেই বলেছেন, পূজা-মহোৎসব উপলক্ষে আমার সমগ্র মাহাত্ম্য পাঠ ও শোনা অবশ্যই কর্তব্য। দুর্গাপূজা যেহেতু মহাপূজা, তাই এই পুজোয় চণ্ডীপাঠ অবশ্য প্রয়োজন। কারণ চণ্ডীপাঠে দুর্গাপুজোর সকল ত্রুটি দূর হয়। সকল পূর্ণতা লাভ হয়। ‘পদ্মপুরাণ’-এটাও বলা হয়েছে, দুর্গার্পূজায় চণ্ডীপাঠ অবশ্যই কর্তব্য। এই পুরাণে মহাদেব পার্বতীকে বলেছেন, দুর্গাপূজায় সাধক একাগ্রচিত্তে সপ্তশতী চণ্ডীমন্ত্র জপ করবে। ‘দেবী গীতা’-য় বলা হয়েছে, ভগবতীর পুজোয় দেবীর সহস্রনাম, দেবীকবচ, দেবীসূক্ত, দেবী উপনিষদ পাঠে দেবীর পরিতুষ্টি হয়। ‘চণ্ডী’-র তত্ত্বপ্রকাশিকা টীকায় বলা হয়েছে, দেবী দুর্গার পুজো হতেও চণ্ডীপাঠ দেবীর অধিকতর প্রীতিজনক। দুর্গাপুজোয় ‘শ্রীশ্রী চণ্ডী’ পাঠে গ্রহাধিষ্ঠাত্রী দেবদেবীগণ প্রসন্ন হন এবং তার ফলে গ্রহপীড়াও প্রশমিত হয়ে যায়। ‘রূদ্রচণ্ডী’-র তূর্যখণ্ডে মহাদেব চণ্ডীকে বলছেন, ‘‘হে দেবি ! যে ব্যক্তি ভক্তিপূর্বক একাগ্রচিত্তে মধুকৈটভ বধ, মহিষাসুর, চন্ডমুন্ড, শুম্ভ নিশুম্ভ বধরূপ তোমার মাহাত্ম্য নিত্য পাঠ করে বা শুনে থাকে, তাঁর কোনরূপ পাপ, দারিদ্র ও বিপদ উপস্থিত হয় না।’’ তত্ত্ব প্রকাশিকা টীকায় বলা হয়েছে, এই দেবীমাহাত্ন ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ— চতুর্বিধ পুরুষার্থ লাভের সাধন স্বরূপ। ‘বারাহী তন্ত্র’ গ্রন্থে বলা হয়েছে— যজ্ঞের মধ্যে যেমন অশ্বমেধ, দেবতাদের মধ্যে হরি সর্বপ্রধান, সেই রূপ সপ্তশতীস্তব অর্থাৎ দেবী মাহাত্ম্য সকল স্তবের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।তাই মহামায়ার মহাপুজোয় দেবীমাহাত্ম্য পাঠ অবশ্যকর্তব্য। কারণ চণ্ডীর মহামায়াই দেবী দুর্গা।

দেখছেন
(কলকাতার ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে অবস্থিত দশভুজা মহিষাসুরমর্দিনী মা দুর্গার মূর্তি, এবং মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ এটিকে দ্বাদশ শতকের মূর্তি বলেছেন)

(অষ্টভুজা মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার এই মূর্তির বর্তমান অবস্থান মেট মিউজিয়াম, মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম অভ আর্ট, নিউ ইয়র্ক। মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ একে নবম শতাব্দীর শেষের দিকে উৎকীর্ণ মনে করেন। প্রাপ্তিস্থান বৃহৎ বঙ্গের গয়া)

গোয়া রাজ্যের শান্তাদুর্গা।  কোঙ্কন উপকূলে গোয়া অঞ্চলে বাঙালিদের একটা মাইগ্রেশন হয়েছিল পালযুগে। আর্পোরা নামে একটা জায়গায় যোগীপাল চৌরঙ্গীনাথের মন্দির আছে। ধর্মপাল দেবপালের সময়েই বাংলা থেকে অভিবাসন হয়ে থাকবে।  ওঁরা শান্তাদুর্গার উপাসনা করেন।  শীতলার সঙ্গে সম্পর্ক আছে মনে হয়েছে, আমাদের ল আর দক্ষিণ ভারতের র পরস্পর স্থান পরিবর্তন করে। তাছাড়াও মুম্বাইতে শান্তাদুর্গা মন্দিরকে শীতলা মন্দির বলা হয়। শান্তাদূর্গা বা শান্তেরী নাম হলেও আমাদের মত দুর্গাদেবী নয়। এই অঞ্চলে গৌড়ীয়দের উপনিবেশ ঘটে পাল যুগে এই সিদ্ধান্ত করতে পারি আমরা, অনেক শতাব্দী আগে যেমন ঘটেছিল শ্রীলঙ্কায়। বাঙালি একটি মহাজাতি এবং উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে বাঙালির উপনিবেশ যুগে যুগে ঘটেছে। বাঙালী যেখানে থাকবে সেখানেই দুর্গারুপে না হোক মাতৃদেবীকার অন্য রুপে পূজা হবেই। 

মধ্য যুগে বাংলা সাহিত্যে দুর্গাপূজার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ঢাকেশ্বরী মন্দির চত্বরে আছে দুই ধরনের স্থাপত্যরীতি মন্দির। প্রাচীনতমটি পঞ্চরত্ন দেবী দূর্গার--যা সংস্কারের ফলে মূল চেহেরা হারিয়েছে। মন্দিরের প্রাচীন গঠনশৈলী বৌদ্ধ মন্দিরের মত। দশম শতকে এখানে বৌদ্ধ মন্দির ছিল--পরবর্তীতে কিভাবে সেন আমলে হিন্দু মন্দির হয়েছিল--তা ইতিহাসে লিখা নাই। ১১শ বা ১২শ শতক থেকে এখানে কালী পূজার সাথে দূর্গা পূজাও হত। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের ইতিহাস সম্পর্কে নানা কাহিনী প্রচলিত আছে। ধারণা করা হয় যে, সেন রাজবংশের রাজা বল্লাল সেন ১২শ শতাব্দীতে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। তবে সেই সময়কার নির্মাণ শৈলীর সাথে এর স্থাপত্যকলার মিল পাওয়া যায় না বলে অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন। তবে বিভিন্ন সময়ে এই মন্দিরের গঠন ও স্থাপনার নানা ধরনের পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে। ইতিহাসবিদ দানীর মতে, প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগে রমনায় কালী মন্দির নির্মিত হয়েছিল এবং এখানেও কালী পূজার সাথে দুর্গা পূজা হত।

 শতকে অভিনির্ণয়-এ, মৈথিলী কবি বিদ্যাপতির ‌‌‌‌‌দূর্গাভক্তিতরঙ্গিনীতে দূর্গা বন্দনা পাওয়া যায়। বঙ্গে ১৪শ শতকে দুর্গা পূজার প্রচলন ছিল কিনা ভালভাবে জানা যায় না। ঘটা করে দুর্গাপূজা চালুর আগে কিছু কিছু উচ্চ বর্ণ হিন্দুদের গৃহকোণে অত্যন্ত সাদামাঠা ভাবে ঘরোয়া পরিবেশে এই পূজা চালু ছিল। আর ঘটা করে দূর্গা পূজার ইতিহাস, খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। তবে কখন থেকে ঘটা করে এই পূজা চালু হল--তা নিয়ে পরিষ্কার বিশ্বাসযোগ্য ঐতিহাসিক কোন প্রমান পাওয়া যায় না। যতটুকু জানা যায় তা হল, কারো মতে, ১৫০০ খ্রীষ্টাব্দের শেষের দিকে দিনাজপুরের জমিদার প্রথম দূর্গা পূজা করেন। 

 

কংস নারায়ণের দুর্গা পুজোর মন্দিরের অষ্টধাতুর মূর্তি

কারো কারো মতে, ষোড়শ শতকে রাজশাহী তাহেরপুর এলাকার রাজা কংশ নারায়ন প্রথম দূর্গা পূজা করেন। তাহিরপুর রাজবংশ বাংলাদেশের প্রাচীন রাজবংশগুলোর মধ্যে অন্যতম।  এই রাজবংশের আদিপুরুষ ছিলেন মৌনভট্ট। আর বংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সামন্ত রাজা ছিলেন ইতিহাসখ্যাত কংস নারায়ণ রায়। সমসাময়িক বাংলার হিন্দু সমাজে তিনি চিরভাস্বর হয়ে থাকার মানসে এক মহাযজ্ঞ সাধন করতে আগ্রহী হলেন। এই লক্ষ্যে তাঁর পরগণার সব শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের দরবারে আহ্বান করে তাঁদের মত চাইলেন। তাঁর মনোবাসনার কথা শুনে পণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রী বললেন, ‘বিশ্বজিৎ, রাজসুয়, অশ্বমেধ ও গোমেধ—এই চারটি মহাযজ্ঞ নামে কথিত। প্রথম দুটি কেবল সার্বভৌম সম্রাটেরা করতে পারেন আর পরের দুটি কলিতে নিষিদ্ধ। তোমার পক্ষে দুর্গোৎসব ভিন্ন অন্য কোনো মহাযজ্ঞ উপযুক্ত নাই। এই যজ্ঞ সকল যুগে সকল জাতীয় লোকেই করতে পারে এবং এক যজ্ঞেই সব যজ্ঞের ফল লাভ হয়।’সমাগত সব পণ্ডিত রমেশ শান্ত্রীর এই মতে সমর্থন দিলেন।

মোগল সম্রাট আকবর (১৫৫৬-১৬০৫)-এর রাজত্বকালে রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার তাহেরপুরের রাজা কংস নারায়ণ ৮৮৭ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৫৮০ সালে বাংলায় প্রথম শারদীয় দুর্গাপূজার প্রচলন করেছিলেন বলে ইতিহাসে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়। রাজা কংস নারায়ণ সাড়ে আট লাখ টাকা ব্যয়ে আধুনিক শারদীয় দুর্গোৎসবের আয়োজন করেছিলেন।। উৎসবটি হয়েছিল বারনই নদের পূর্ব তীরে রামরামা গ্রামের দুর্গামন্দিরে। আজও বাঙালির সর্বজনীন দুর্গোৎসবে সেই পদ্ধতিই অনুসৃত হচ্ছে। তবে কংস নারায়ণের পরবর্তী চতুর্থ পুরুষ লক্ষ্মী নারায়ণের সময় সম্রাট আওরঙ্গজেবের ছোট ভাই বাংলার সুবেদার শাহ সুজা বারনই নদের পূর্ব তীরে অবস্থিত রাজা কংসের প্রাসাদ ধ্বংস করে দিয়ে যান।  পরে অবশ্য লক্ষ্মী নারায়ণ আওরঙ্গজেবের অনুকম্পায় নদীর পশ্চিম তীরে একটি পরগনা লাভ করেন। সেখানেই রাজবাড়ি নির্মাণ করে রাজত্ব করেন। ১৮৬২ সালে রাজা বীরেশ্বর রায়ের স্ত্রী রানী জয় সুন্দরী রাজবাড়ির সঙ্গে একটি দুর্গামন্দির নির্মাণ করেন। মন্দিরের নামফলকটি বর্তমানে রাজশাহীতে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।

রাজবংশের শেষ রাজা ছিলেন শিবশেখরেশ্বর। তাঁর বাবা শশী শেখরেশ্বরের সময় থেকে রাজারা কলকাতায় গিয়ে থাকতেন। শুধু পূজার সময় আসতেন। ১৯২৭ সালে শেষবারের মতো তিনি তাহেরপুরে এসেছিলেন। এরপর তিনি মারা গেছেন বলে ধারণা করা হয়। একপর্যায়ে রাজবাড়ির এই মন্দিরটি প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে যায়। ১৯৬৭ সালে রাজবাড়িতে কলেজ করা হয়। রাজবাড়ির ভেতর থেকে মন্দিরে যাওয়ার ফটকটিও একসময় বন্ধ করে দেওয়া হয়। মন্দিরটি জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে যায়। বর্তমান মন্দির কমিটির সভাপতি নিশিত কুমার সাহা জানান, গত কয়েক বছর থেকে তাঁরা নতুন করে এই মন্দিরটিতে দুর্গাপূজা শুরু করেছেন।

১৫১০ সালে কুচ বংশের রাজা বিশ্ব সিংহ কুচবিহারে দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন। অনেকে মনে করেন, ১৬০৬ সালে নদিয়ার ভবনানন্দ মজুমদার দূর্গা পূজার প্রবর্তক। ১৬১০ সালে কলকাতার বারিশার রায় চৌধুরী পরিবার প্রথম দূর্গা পূজার আয়োজন করেছিল বলে ধারণা করা হয়। তারাই প্রথম দুর্গার ছেলে-মেয়ে সহ সপরিবারে পূজা চালু করেন ।  এই পূজা আজো চলছে শুরুর সময়কার আচার পদ্ধতি অনুসারেই। পূজার বোধন হয় কৃষ্ণপক্ষের নবমী তিথিতে, অর্থাৎ মহানবমীর ১৫ দিন আগের তিথিতে। দেবী মূর্তির রূপ ও রংয়ের কোনো পরিবর্তন নেই। মণ্ডপে মূর্তিও তৈরি হয় সেই পুরনো আমলের কাঠামোর ওপর। আটচালা মণ্ডপেই হয় কুমারী পূজা।

নেত্রকোণার দুর্গাপুর এর পূর্ব নাম সুসং। এখন সুসং দুর্গাপুর নামেই সমধিক পরিচিত। সুসং শব্দটি মূলত ‘সু-সঙ্গ’ এর পরিবর্তিত রূপ। সুসঙ্গ শব্দটি জড়িয়ে আছে সোমেশ্বর পাঠক মতান্তরে সোমনাথ পাঠকের নামের সাথে। ধারণা করা হয়, তিনি ভারতের কান্যকুব্জ থেকে ১২৮০ খৃষ্টাব্দে পূর্ব ময়মনসিংহের উত্তরভাগ ‘পাহাড় মুল্লুকে’ সঙ্গীসাথীসহ আগমন করেন। তিনি সেখানকার অত্যাচারী রাজাকে যুদ্ধে পরাস্ত করেন এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য সু-সঙ্গ অর্থাৎ ভাল সঙ্গ নামে একটি স্বাধীন ও শান্তিপূর্ণ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে এটি সুসঙ্গ পরগণা হিসেবে পরিচিতি পায়। রাজবংশও উপাধী বদলে সিংহ উপাধী ধারণ করে। এই রাজবংশের রাজা রঘুনাথ সিংহ মোঘল সম্রাট মহামতি আকবরের সাথে একটি চুক্তি করেন। এই চুক্তির অংশ হিসেবে রাজা রঘুনাথ সিংহকে মানসিংহ এর পক্ষে বিক্রমপুরের চাঁদ রায়, কোদার রায় এর বিপক্ষে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে হয়। প্রায় নয় দিন ব্যাপী এই ভীষণ যুদ্ধ চলতে থাকে| পরিশেষে কেদার রায় পরাস্ত হলে রাজা রঘুনাথ সেখান থেকে অষ্ট ধাতুর এক দুর্গা প্রতিমা নিয়ে আসেন এবং রাজ মন্দিরে স্থাপন করেন যা আজো দশভূজা মন্দির নামে সুপরিচিত। তখন থেকেই সু-সঙ্গের সাথে দুর্গাপুর যোগ করে ঐ অঞ্চলের নামকরণ হয় সুসঙ্গ দুর্গাপুর।
আর মানসিংহ কেদার রায়ের গৃহমন্দির থেকে কেদারের আরাধ্য শিলাময়ী মা কালী দেবীকে নিয়ে  রাজস্থানে অম্বর দুর্গে এখন অধিষ্ঠিত করেন। এঁর পুজো করার জন্য বাঙালি পুরোহিত নিয়ে গেছিলেন মানসিংহ।


কেদার রায়ের গৃহমন্দির

১৭১১ সালে অহম রাজ্যের রাজধানী রংপুরে  শারদীয় পূজার নিমন্ত্রণ পেয়েছিলেন ত্রিপুরা রাজ্যের দূত রামেশ্বর নয়ালঙ্কার। নবাব সিরাজ-উদ-দ্দৌল্লার আক্রমনে কলকাতার একমাত্র চার্চ ধ্বংশ হবার পর সেখানে কোন উৎসব করা অবস্থা ছিল না। পলাশীর যুদ্ধে বিজয় লাভের জন্য ১৭৫৭ সালে লর্ড ক্লাইভের সন্মানে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিসারদের আপ্যায়নের জন্যই রাজা নবকৃষ্ণদেব শোভাবাজার রাজবাড়িতে এই পূজার আয়োজন করেন। রথের দিনে কাঠামো পূজা করে মূর্তি বানানো শুরু হয়। বোধন হয় নবমীর ১৫ দিন আগে। পূজায় বসত বাছাই করা বাইজিদের নাচের আসর। সন্ধিপূজায় কামান ছোঁড়া হতো। গোরাদের ব্যান্ড বাজিয়ে মহাসমারোহে জোড়া নৌকায় ভাসান হতো দশমীতে। তারপর উড়িয়ে দেওয়া হতো কৈলাশের উদ্দেশ্যে নীলকণ্ঠ পাখি।

নবাব সিরাজ পতনের পরে  কৃষ্ণচন্দ্র ও নবকৃষ্ণ--এই দুজন রাজার আনন্দিত হওয়াটা খুবই  স্বাভাবিক, ফলে দুর্গাপুজোর ক্ষেত্রেও কিছু উৎসাহে এসেছে।  ইতিহাস থেকে জানা যায়, কৃষ্ণচন্দ্র মূলত কালিপুজো আর জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলনের জন্য বিখ্যাত। আর নবকৃষ্ণের আগেই কলকাতায় একাধিক ব্যক্তির উদ্যোগে দুর্গাপুজো হয়েছে।  চিত্তেশ্বরীখ্যাত চিতে ডাকাত দুর্গাপুজো করত। যেখানে চিতে ডাকাত পূজা করত, সে মন্দির প্রতাপাদিত্যের সময় থেকে আছে।

আধুনিক দূর্গা পূজার প্রাথমিক ধাপ ১৮ম শতকে নানা বাদ্যযন্ত্র প্রয়োগে ব্যক্তিগত, বিশেষ করে জমিদার, বড় ব্যবসাযী, রাজদরবারের রাজ কর্মচারী পর্যায়ে প্রচলন ছিল। বাংলাদেশের সাতক্ষীরার কলারোয়ার ১৮ শতকের মঠবাড়িয়ার নবরত্ন মন্দিরে (১৭৬৭) দূর্গা পূজা হত বলে লোকমুখে শোনা যায়। পাটনাতে ১৮০৯ সালের দূর্গা পূজার ওয়াটার কালার ছবির ডকুমেন্ট পাওয়া গেছে। ওরিষ্যার রামেশ্বরপুরে একই স্থানে ৪০০ শত বছর ধরে সম্রাট আকবরের আমল থেকে দূর্গা পূজা হয়ে আসছে। জমিদার বাড়ি থেকেই এই পূজার প্রচলন হয়েছিল। বর্তমানে দূর্গা পূজা দুইভাবে হয়ে থাকে, ব্যক্তিভাবে, পারিবারিক স্তরে ও সমষ্ঠিগতভাবে, পাড়া স্তরে। সমষ্ঠিগতভাবে, বার ইয়ার বা বারোয়ারী পূজা ১৭৯০ সালের পশ্চিম বঙ্গের হুগলি জেলার গুপ্তি পাড়াতে বার জন বন্ধু মিলে টাকা পয়সা (চাঁদা) তুলে প্রথম সার্বজনীনভাবে বড় আয়োজনে দূর্গা উৎসব পালন করেন--যা বারোইয়ার বা বারবন্ধুর পূজা নামে ব্যাপক পরিচিতি পায়। কাসীম বাজারের রাজা হরিনাথ ১৮৩২ সালে বারোইয়ারের এই পূজা কলকাতায় পরিচিত করান। পরে তাদের দেখাদেখি আস্তে আস্তে তা উচ্চ বর্ণের হিন্দু বাঙ্গালী জমিদারদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সম্ভবত সেই থেকে বারোয়ারী পূজা শুরু। ১৯১০ সালে সনাতন ধর্ম উৎসাহিনী সভা ভবানীপুরে বলরাম বসু ঘাট লেনে এবং একই জেলায় অন্যান্যরা রামধন মিত্র লেন, সিকদার বাগানে একই বছরে ঘটা করে প্রথম বারোয়ারী পুজার আয়োজন করে।

১৯২৬ সালে অতীন্দ্রনাথ বোস জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে পূজা উৎসবে অংশ গ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে দূর্গা পূজা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল (যেমন, কবি নজরুলের আনন্দময়ীর আগমনে কবিতা, বঙ্কিচন্দ্রের বন্দে মা তরম কবিতা, পরবর্তীতে ভারতের জাতীয় সংগীত...)। বৃটিশ বাংলায় এই পূজা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে দূর্গা স্বাধীনতার প্রতীক হিসাবে জাগ্রত হয়। বিংশ শতাব্দির প্রথমার্ধে এই পূজা ঐতিহ্যবাহী বারোয়ারী বা কমিউনিটি পূজা হিসাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। আর স্বাধীনতার পর এই পূজা পৃথিবীর অন্যতম প্রধান উৎসবের মর্যাদা পায়।

কলকাতার নামকরা পুরনো পূজামন্ডপগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে আছে শোভাবাজার রাজবাড়ি, হাটখোলার দত্ত, পাথুরিয়াঘাটা, লাহাবাড়ির পূজা, ছাতুবাবু-লাটুবাবুর বাড়ির পূজা, মালিক বাড়ির পূজা ইত্যাদি। এই পূজাগুলো বাসন্তী দুর্গা পূজা।
 কলকাতার ইতিহাস ঘাঁটলে সবচেয়ে পুরনো পূজা বলতে পাওয়া যায় বাগবাজারের প্রাণকৃষ্ণ হালদারের পূজামন্ডপ। প্রায় ৪০০ বছরের ইতিহাস। কষ্ঠিপাথরের খোদাই করা সেই মূর্তির সঙ্গে  ছিলেন জয়া আর বিজয়া নামে দুই সঙ্গিনী। দুর্গা পুত্র-কন্যারা ছিলেন না।
কোলকাতার লাহাবাড়ির পূজা ২০০ বছররের বেশ পুরনো।  ঈশ্বর প্রাণকৃষ্ণ লাহা পারিবারিক দেবী জয়া মায়ের নির্দেশেই দুর্গার পুজা শুরু করেন। ১৭৮০ সালে রামদুলাল দে সরকার বিডন স্ট্রিটের বাড়িতে যে পূজা চারু করেন তাই ছাতুবাবু-লাটুবাবু পূজা নামে পরিচিত। ৩৫০ বছরেরও বেশ সময় আগে থেকে হাওরা পণ্ডিত সমাজের সভাপতি ‍মুরারী মোহন বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়িতে দুর্গাপূজা হত। ১৭০ বছরের বেশী পুরনো রামলোচন ঘোষের পাথুরিয়াঘাটার দুর্গাপূজা। এই বাসন্তী পূজাতে প্রায় সবকটাতে মণ্ডবে পশু বলী হত, কালক্রমে পশু বলী বন্ধ হয়।

সরকারী বা জাতীয়ভাবে এই উৎসবকে দূর্গা পূজা বা দূর্গা উৎসব হিসাবে অভিহিত করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় এটাকে শরৎ কালের বার্ষিক মহা উৎসব হিসাবে ধরা হয় বলে ইহাকে শারদীয় উৎসবও বলা হয়। গত বছর কার্তিক মাসের ২য় দিন থেকে ৭ম দিন পর্যন্ত এই উৎসবকে পঞ্চমী, ষষ্ঠি, মহাসপ্তমী, মহাঅষ্টমী, মহানবমী ও দশমী নামে পালন করা হয়েছে। বাংলা পঞ্চিকা অনুসারে, এ বছর শুক্রবার ছিল মহালয়া ( দেবী পক্ষের আগমন বার্তা), ২৪ শে আশ্বিন পন্চমী, তারপর ষষ্ঠি, মহাসপ্তমী, মহাঅষ্টমী, মহানবমী ও ২৯ শে আশ্বিন দশমী নামে পালন করা হবে। রামায়ন অনুসারে, অকালে বা অসময়ে দেবীর আগমন বা জাগরণ বলে শরৎকালের দূর্গা উৎসবকে অকালবোধনও বলা হয়। বসন্তকালের দূর্গা পূজাকে বাসন্তী পূজা বলা হয়। ধর্মীয় শাস্ত্রে,  ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে, বিভিন্ন দেশে আমরা দূর্গার বিভিন্ন নাম পাই। যদিও বলা হয়ে থাকে, মা দুর্গার  একশত আটটি নাম, তবে কম বা বেশি  হওয়ার বিতর্ক রয়েই যায়ঃ (১)দুর্গা, (২) সাধ্বী, (৩) ভবপ্রীতা, (৪) ভবানী, (৫)ভবমোচনী, (৬) আর্য্যা, (৭) সতি,(৮) জয়া, (৯)আদ্যা (১০) ত্রিনেত্রা, (১১) শূলধারিণী, (১২)পিনাকধারিণী, (১৩) চিত্রা, (১৪) চন্দ্রঘণ্টা,(১৫) মহাতপা, (১৬) অন্নপূর্ণা, (১৭) বুদ্ধি, (১৮) অহঙ্কারা, (১৯) চিত্তরূপা, (২০) চিতা, (২১)ঈশ্বরী, (২২) সর্বমন্ত্রময়ী, (২৩) নিত্যা, (২৪) সত্যানন্দস্বরূপিণী, (২৫) অনন্তা, (২৬) ভাবিনী, (২৭) ভাব্যা, (২৮) ভব্যা, (২৯) অভব্যা, (৩০) সদাগতি, (৩১) শাম্ভবী,(৩২) দেবমাতা, (৩৩) ঊমা, (৩৪) রত্নপ্রিয়া, (৩৫) সর্ববিদ্যা, (৩৬) দক্ষকন্যা, (৩৭) দক্ষযজ্ঞবিনাশিনী, (৩৮) অপর্ণা, (৩৯) অনেকবর্ণা, (৪০) পাটলা, (৪১) পাটলাবতী, (৪২) পট্টাম্বরপরিধানা, (৪৩) কলমঞ্জীররঞ্জিনী, (৪৪) অমেয়বিক্রমা, (৪৫) ক্রূরা, (৪৬) সুন্দরী, (৪৭) সুরসুন্দরী, (৪৮) বনদুর্গা, (৪৯) মাতঙ্গী, (৫০) মতঙ্গমুনিপূজিতা, (৫১) ব্রাহ্মী,  (৫২) মাহেশ্বরী, (৫৩) ঐন্দ্রী, (৫৪) কৌমারী, (৫৫) বৈষ্ণবী, (৫৬) চামুণ্ডা, (৫৭) বারাহী, (৫৮) পার্বতী (৫৯) পুরুষাকৃতি, (৬০) বিমলা, (৬১)উৎকর্ষিণী,(৬২) জ্ঞানা, (৬৩) ক্রিয়া, (৬৪) সত্যা,(৬৫) বুদ্ধিদা, (৬৬) বহুলা, (৬৭) বহুলপ্রেমা, (৬৮) সর্ববাহনবাহনা, (৬৯) শুম্ভনিশুম্ভহননী, (৭০) মহিষাসুরমর্দিনী, (৭১) মধুকৈটভহন্ত্রী, (৭২) চণ্ডমুণ্ডবিনাশিনী, (৭৩) সর্বাসুরবিনাশা,(৭৪) সর্বদানবঘাতিনী, (৭৫) সর্বশাস্ত্রময়ী, (৭৬) মহামায়া, (৭৭) সর্বাস্ত্রধারিণী, (৭৮) অনেকশস্ত্রহস্তা,(৭৯) অনেকাস্ত্রধারিণী, (৮০) কুমারী, (৮১) কন্যা,(৮২) কৈশোরী, (৮৩) যুবতী, (৮৪) যতি,(৮৫) অপ্রৌঢ়া, (৮৬) প্রৌঢ়া, (৮৭) বৃদ্ধমাতা, (৮৮) বলপ্রদা, (৮৯) মহোদরী,(৯০) মুক্তকেশী, (৯১) ঘোররূপা, (৯২) মহাবলা,(৯৩) অগ্নিজ্বালা, (৯৪) রৌদ্রমুখী,(৯৫) কালরাত্রি, (৯৬) তপস্বিনী, (৯৭) নারায়ণী, (৯৮) ভদ্রকালী, (৯৯) বিষ্ণুমায়া, (১০০) জলোদরী,(১০১) শিবদূতী, (১০২) করালী, (১০৩) অনন্তা, ১০৪) পরমেশ্বরী, (১০৫) কাত্যায়নী, (১০৬) সাবিত্রী, (১০৭) প্রত্যক্ষা এবং (১০৮) ব্রহ্মবাদিনী। আমরা ১০৮ টি নামের সাথে আরো কিছু নাম পাই, যেমন,  চিন্তা, লক্ষী, মনঃ, চিতি, শাকম্ভরী --প্রমুখ নামেও দেবী দুর্গাকে ডাকা হয়, পূজাও হয়ে থাকে। ভারতবর্ষে গবেষণা  হলে,  দুর্গার আরো নাম সংশোধন , সংযোজন, বিয়োজন হতে পারে।

দুর্গাপূজা ভারতে অসম, বিহার, ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যা ও পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপকভাবে উৎযাপন করা হয়। সেখানে পাঁচ দিনের ছুটি ঘোষণা করা হয়। পশ্চিম বঙ্গ ও ত্রিপুরায় সবচেয়ে বড় সামাজিক, সাংস্কৃতিক উৎসব হিসাবে ইহা পালিত হয়। এসব স্থানে বাঙ্গালী হিন্দুরা ব্যাপক সংখ্যায় বসবাস করে। বাঙ্গালী হিন্দুদের বাইরে এ পূজা অতীতে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল না। বর্তমানে পূর্ব ভারতের কলকাতা, হুগলী, শিলিগুড়ি, কুচবিহার, লতাগুড়ি, বাহারাপুর, জলপাইগুড়ি এবং ভারতের অন্যান্য অঞ্চল যেমন, আসাম, বিহার, দিল্লী, উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গোয়া, গুজরাট, পাঞ্জাব, কাশ্মীর, অন্ধ্র প্রদেশ, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, কেরালায় ঘটা করে এই উৎসব পালন করা হয়। নেপালে ও ভুটানেও স্থানীয় রীতি-নীতি অনুসারে প্রধান উৎসব হিসাবে পালন করা হয়।
 
(আধুনিক সময়ের দুর্গাপূজা মূর্তি)

দুই বাংলায় দেবী দুর্গার যে মূর্তিটি সচরাচর দেখা যায় সেটি পরিবার সমন্বিতা বা স্বপরিবার দুর্গার মূর্তি। এই মূর্তির মধ্যস্থলে দেবী দুর্গা সিংহবাহিনী ও মহিষাসুর মর্দিনী, তাঁর মুকুটের উপরে শিবের ছোট মুখ, দেবীর ডানপাশে দেবী লক্ষ্মী ও গণেশ, বামপাশে দেবী সরস্বতী ও কার্তিকেয়। হিন্দুরা দেবী দূর্গাকে মহাশক্তির একটি উগ্র রূপ মনে করেন। দেবী দুর্গার অনেকগুলি হাত। বিশেষত দেবী দূর্গার অষ্টাদশভূজা, ষোড়শভূজা, দশভূজা, অষ্টভূজা ও চতুর্ভূজা মূর্তি দেখা যায়। তবে দেবী দূর্গার স্বপরিবার দশভূজা রূপটিই বেশি জনপ্রিয়। আবার দেবীর এই দশভূজা স্বপরিবার মূর্তির সর্বপ্রথম কলকাতায় সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার ১৬১০ সালে প্রচলন করেন। তাঁরা কার্তিকেয়র রূপ দেন জমিদার পুত্রের, যা তৎপূর্বে ছিলো সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের আদলে যুদ্ধের দেবতা রূপে। এগুলি ছাড়াও বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে দেবী দুর্গার বিভিন্ন রকমের স্বতন্ত্র মূর্তিও চোখে পড়ে। তবে দুর্গার রূপকল্পনা বা কাঠামো বিন্যাসে যতই বৈচিত্র থাকুক, বাংলায় দুর্গোৎসবে প্রায় সর্বত্রই দেবী দুর্গা স্বপরিবারে পূজিতা হন।

দেবী দূর্গার তত্ত্ব পরিচিতি
দেবনাগরীঃ- পার্বতী 
লিপ্যন্তরঃ- দূর্গা 
অন্তর্ভুক্তিঃ- মহাশক্তি
আবাসঃ- কৈলাস
মন্ত্রঃ- ওঁ দুর্গে দুর্গে রক্ষণি স্বাহা
অস্ত্রঃ- ত্রিশূল, খর্গ, চক্র, বাণ, শক্তি, ঢাল, ধনুক, ঘণ্টা, পরশু, নাগপাশ
সঙ্গীঃ- শিব
বাহনঃ- সিংহ, বাঘ
দুর্গা অর্থাৎ "যিনি দুর্ভোগ বা সংকট থেকে রক্ষা করেন তিনি দেবী দূর্গা। যে দেবী অগম্যা, দুষ্প্রাপা বা যাকে সহজে পাওয়া যায় না এই অর্থে– দূর্গা। দূর্গ নামক দৈত্যকে দমন করে ইনি দূর্গা নাম প্রাপ্ত হন। সনাতন ধর্মমতে– পরমা প্রকৃতি স্বরূপা মহাদেবী, মহাদেবের পত্নী। মার্কেণ্ডেয় পুরাণের মতে– ইনি মহামায়া, পরমবিদ্যা, নিত্যস্বরূপা, যোগনিদ্রা। ইনি জন্মমৃত্যু-রহিতা। আদিকালে বিষ্ণু যখন যোগনিদ্রায় ছিলেন, তখন মধু ও কৈটভ [মধুকৈটভ] নামক দুটি ভয়ঙ্কর দৈত্য ব্রহ্মাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল। এই সময় ব্রহ্মা যোগনিদ্রারূপী এই দেবীকে বন্দনা করেন। পরে এই দেবীর দ্বারা বিষ্ণু বলিয়ান হয়ে ঐ দৈত্যদের সাথে যুদ্ধ করার ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। আবার এই দেবীর প্রভাবে দৈত্যরা বিষ্ণুর সাথে যুদ্ধ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। হিন্দুশাস্ত্রে "দূর্গা" শব্দটিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে যে:-
“দৈত্যনাশার্থবচনো দকারঃ পরিকীর্তিতঃ।
উকারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মত।।
রেফো রোগঘ্নবচনো গশ্চ পাপঘ্নবাচকঃ।
ভয়শত্রুঘ্নবচনশ্চাকারঃ পরিকীর্তিত।।”
অর্থাৎ, দ:- দৈত্য বিনাশ করে,
উ-কার:- বিঘ্ন নাশ করে,
রেফ:- রোগ নাশ করে,
গ:- পাপ নাশ করে এবং
অ-কার:- শত্রু নাশ করে
এর পরিপূর্ণ অর্থ হলো যে= দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা।
অন্যদিকে শব্দকল্পদ্রুম বলেছে,
"দুর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা দুর্গা বা প্রকীর্তিতা"।
অনুবাদ:- যিনি দূর্গ নামক অসুরকে বধ করেছিলেন, তিনি সব সময় দুর্গা নামে পরিচিত।
শ্রীশ্রীচণ্ডী বা দেবীমাহাত্ম্যেম্ অনুসারে যে দেবী:-
"নিঃশেষ দেবগণ শক্তি সমূহ মূর্ত্যাঃ"
সকল দেবতার সম্মিলিত শক্তির প্রতিমূর্তি, তিনিই দুর্গা।

দূর্গাপূজা বা দূর্গোৎসব, সনাতনী হিন্দু সম্প্রদায়ের দেবী দূর্গাকে কেন্দ্র করে প্রচলিত এক বৃহৎ উৎসব। এই দূর্গাপূজা সমগ্র হিন্দু সমাজেরই প্রচলিত উৎসব। তবে বাঙালি হিন্দু সমাজে এটি অন্যতম বিশেষ ধর্মীয় ও প্রধান সামাজিক উৎসব। আশ্বিন বা চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষে দুর্গাপূজা করা হয়। আশ্বিন মাসের দুর্গাপূজা শারদীয়া দুর্গাপূজা এবং চৈত্র মাসের দুর্গাপূজা বাসন্তী দুর্গাপূজা নামে পরিচিত। শারদীয়া দুর্গাপূজার জনপ্রিয়তা বেশি।
 
বাংলাদেশের ঢাকা, চট্রগ্রাম, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী, সিলেট, মৌলবীবাজার (বিশেষ করে শ্রীমঙ্গল), রংপুর, বগুরা এবং অন্যান্য জেলায়ও ব্যাপক আয়োজনের মধ্য দিয়ে এই উৎসব পালন করা হয় এবং সরকারীভাবে এক দিনের এবং হিন্দুদের জন্য তিন দিনের ছুটি ঘোষনা করা হয়। বিদেশে যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, জামার্নী, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স, সিঙ্গাপুর, মরিশাস, ফিজি, টোবাকো, কুয়েত, মালয়েশিয়া সহ বিশ্বের বহু দেশে অভিবাসী হিন্দুদের বা বাঙালী হিন্দুদের নানা সংগঠন এই উৎসব পালন করে থাকে। ২০০৬ সালে, মহাদূর্গা পূজা অনুষ্ঠান ব্রিটিশ মিউজিয়ামের গ্রেট কোর্টে অনুষ্টিত হয়েছিল। বঙ্গে এই পূজাকে শারদীয় পুজা, শারদোৎসব, মহা পূজা, মায়ের পূজা, ভগবতী পূজা এবং বসন্তকালে বাসন্তী পুজা হিসাবে উৎযাপন করা হয়। বিহার, আসাম, উড়িষ্যা, দিল্লী, মধ্যপ্রদেশ--এ দূর্গা পূজা, মহারাষ্ট, গুজরাট, উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব, কেরালায়, হিমাচল প্রদেশ, মহীশুর, তামিলনাড়ু, অন্ধ্র প্রদেশে এ পূজাকে নবরাত্রি পূজা বলা হয়।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত