আর্চারি তারকা ও দম্পতি রোমান-দিয়ারা কেন দেশ ছেড়ে যান?
প্রকাশ: ৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:১৫ | আপডেট : ৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪:২৫
খেলতে খেলতেই প্রেম। তারপর বিয়ে। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে তারকা দম্পতি হয়ে ওঠেন রোমান সানা-দিয়া সিদ্দিকী। কিন্তু এখন তাঁরা উন্নত জীবনের আশায় যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে। দুই তারকা আর্চারের যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে গত পরশু। যুক্তরাষ্ট্রে তাঁরা থিতু হতে গেছেন, নাকি ঘুরতে গেছেন, কিছু বলে যাননি। বাংলাদেশ আর্চারি ফেডারেশন এ বিষয়ে কিছু জানে না। দিয়ার বাবা অবশ্য বলেছেন তাঁর মেয়ে চিকিৎসা করাতে গেছেন। তবে ধারণা করা হচ্ছে, স্থায়ীভাবে থাকার জন্যই যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন তাঁরা।
খেলার মাঝপথে বা খেলা শেষ করে বিদেশে থিতু হওয়া বাংলাদেশি ক্রীড়াবিদের সংখ্যা অনেক। এক যুক্তরাষ্ট্রেই বিভিন্ন খেলার খেলোয়াড় আছেন ৪০ থেকে ৫০ জন! আশি–নব্বইয়ের দশক থেকে যাওয়া শুরু হয়েছে। সেই ধারা আজও চলছে। ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান দেশের প্রথম অলিম্পিয়ান ও দুইবারের দ্রুততম মানব সাইদুর রহমান ডন। খেলা ছেড়ে পাতিয়ালা থেকে কোচিং ডিগ্রি নেন। পরে প্রবাসজীবন বেছে নেন। আরও অনেক নাম আসবে। সাফ গেমসে (বর্তমানে এসএ গেমস) সোনা জিতেও দেশ ছাড়েন বিমল চন্দ্র তরফদার, মাহফুজুর রহমান মিঠু, কারার মিজানরা।
২০২১ সালে আর্চারির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে যুক্তরাষ্ট্র গিয়েছিল বাংলাদেশ আর্চারি দল। সেই দলের সবাই পাঁচ বছরের ভিসা পান যুক্তরাষ্ট্রের। সেই সুযোগ নিয়ে আগেই যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন আর্চার অসীম কুমার ও আবদুল হাকিম রুবেল। এবার গেলেন রোমান-দিয়া। তাঁদের চলে যাওয়া বড় ক্ষতি, নবীনদের কাছে খারাপ বার্তাও। দেশের রুগ্ন ক্রীড়াঙ্গণ পারেনি তাঁদের ধরে রাখতে।
আর্চারি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী রাজীব উদ্দীন আহমেদও মানছেন তা, ‘এটা অবশ্যই আমাদের জন্য ক্ষতি। অনেক পরিশ্রমের বিনিময়ে একজন খেলোয়াড় তৈরি হয়।’
রোমান প্রায় খেলা ছাড়ার অবস্থায় ছিলেন। জাতীয় দলে আসার মতো পারফরম্যান্স থেকে অনেকটা দূরে ছিলেন গত কিছুদিনে। ‘দেশ আমাকে কী দিয়েছে’—এই ভাবনা থেকে রাগে-ক্ষোভে অবসরও নিয়েছিলেন। তবে পরে ফিরতে চেয়ে দরখাস্ত দিয়েছিলেন আর্চারি ফেডারেশনকে। আগামী ২৩ জানুয়ারি থেকে শুরু র্যাঙ্কিং টুর্নামেন্ট। সেটিতে ভালো করলে রোমান ক্যাম্পে আসতে পারতেন; কিন্তু তিনি সেই সুযোগ নিলেন না!
আর্চারিতে রোমান-দিয়াই সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন। এত কিছু করার পরও যদি চলে যান, কী করার আছে। এমন দাবি করে আর্চারি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বলছেন, ‘ছেলেদের টিমটা মোটামুটি আছে। রোমানের না থাকা বিরাট কোনো ক্ষতি নয়। তবে মেয়েদের টিমটা হালকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা একটু পরিশ্রম করলে ক্ষতিটা কাটিয়ে উঠে যাবে। শনিবার (আজ) ফেডারেশনের সভা। তাতে এসব নিয়েও আলোচনা হবে।’
তবে দেশের আলোচিত দুই আর্চারের এভাবে যাওয়াটা মানতে পারছেন না কাজী রাজীব উদ্দীন, ‘রোমান আনসারে চাকরি করত, ভালো বেতন পেত। দিয়াকেও আনসার ভালো বেতন দিত। তারপরেও তারা কেন গেল, তারাই বলতে পারবে।’ নিজের জীবন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার সবারই আছে। রোমান-দিয়ারও আছে। তবে জানিয়ে গেলে খুশি হতেন জানিয়ে কাজী রাজীব বলছেন, ‘অসীম আমাকে বলে গেছে। যাওয়ার আগে দোয়া নিয়ে গেছে। রুবেল জানিয়ে যায়নি। পরশু ওর সঙ্গে কথা হয়েছে। ও যে খেলোয়াড় ছিল, এমন একটা সার্টিফিকেট চেয়েছে আমাদের কাছে। সার্টিফিকেট পেলে নাকি ও একটা ভালো চাকরি পেতে পারে।’
আর্চারি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক খানিকটা স্বস্তিও পাচ্ছেন। সেটা কী? ‘সৌভাগ্য যে ওরা খেলতে গিয়ে পালিয়ে যায়নি। ভিসা আছে, গেছে। যাওয়ার সিদ্ধান্তটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।’ পরিশেষে তিনি দুই আর্চারের জন্য রাখছেন শুভকামনাও, ‘ওদের জন্য দোয়া করছি। ওরা সেখানে সুখে–শান্তিতে থাকুক।’
শুভকামনা রাখছেন সাবেক ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়ন এলিনা সুলতানাও। তবে এলিনা মানতে পারছেন না ক্রীড়াবিদদের এভাবে দেশ ছাড়া। দেশের ক্রীড়া সংস্কৃতি নিয়ে ক্ষোভ জানিয়ে এলিনা বলছেন, ‘খেলোয়াড়দের চলে যাওয়া ফেডারেশনের ব্যর্থতা। ফেডারেশন খেলোয়াড়দের ওপরে নানা আদেশ-নির্দেশ, নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কিন্তু সমস্যার সমাধান করতে পারে না। বাংলাদেশে ভালো খেলোয়াড়দের কোনো মূল্য নেই। একজন চ্যাম্পিয়ন মাঠে গেলে একটু বসতেও বলা হয় না।’
সামান্য সম্মানও না পেলে খেলায় থেকে কী লাভ? শুধু একটা ক্রেস্ট পেল, মিডিয়ায় নাম আসাই কী সব—এসব প্রশ্ন এলিনার মনে। আক্ষেপ করে বললেন, ‘আর্থিক নিরাপত্তা না থাকলে খেলোয়াড়েরা খেলায় কেন সময় নষ্ট করবে। কত খেলোয়াড় অসুস্থ হয়ে মারা গেছে। কেউ খোঁজ নেয়নি।’
খেলোয়াড়েরা কেন বিদেশে চলে যান, তা কারও অজানা নয়। উন্নত জীবনের আশায় যান। তবে যাঁদের পারফরম্যান্স শেষ পর্যায়ে তাঁরাই আসলে চলে যেতে চান বলছেন অ্যাথলেটিকস কোচ ও বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের বর্তমান অ্যাডহক কমিটির যুগ্ম সম্পাদক কিতাব আলী, ‘২০০৬ কলম্বো সাফ গেমসে হার্ডলসে সোনা জেতার কদিন পরই দেশ ছাড়ে মাহফুজুর রহমান মিঠু। সে ব্যতিক্রম। তবে পারফরম্যান্স থাকলে কেউ যেতে চায় না। আর গেলেও সেটা বড় কোনো ব্যাপার নয়। ওরা দেশে টাকা পাঠাবে। নিজেরাও ভালো থাকবে।’
বাংলাদেশের জাতীয় বাজেট বেড়েছে। দেশের অর্থনীতি আগের চেয়ে হয়েছে অনেক বড়। এখন উন্নয়নশীল দেশের তালিকায়। কিন্তু সামগ্রিক অর্থনীতির ছাপটা ক্রীড়াঙ্গনে চোখে পড়ে না। ক্রিকেট-ফুটবলের বাইরে অন্য খেলাগুলো বেহাল। ভালোভাবে জীবনযাপনের নিশ্চয়তা নেই। সাফল্য আনলে হয়তো টুকটাক কিছু বোনাস মেলে। কিন্তু অর্থনৈতিক বা সামাজিক স্বীকৃতির পেছনে খেলোয়াড়দের ছুটতে হয় নিরন্তর। ফলে নিজেদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে সুযোগ পেলেই বিদেশে পাড়ি জমান কেউ কেউ। যার সর্বশেষ উদাহরণ রোমান-দিয়া।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত