আব্বাসবোমায় বিএনপিতে কম্পন
প্রকাশ: ২৩ এপ্রিল ২০২১, ১১:২৪ | আপডেট : ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১:২৪
হঠাৎ করেই একটি তথ্যবোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য মির্জা আব্বাস। আর সে বোমা বিস্ফোরণে ভয়ানক কম্পন সৃষ্টি হয়েছে দলটিতে। কারণ, যে ঘটনার জন্য তার দল এ যাবৎ সরকারকে দায়ী করে আসছিল, সে ঘটনার জন্য তিনি প্রকাশ্যেই দায়ী করলেন তারই দলের অজ্ঞাত কিছু লোককে। তার এ বক্তব্য বিএনপির অভ্যন্তরে সৃষ্টি করেছে ব্যাপক তোলপাড়। রাজনৈতিক অঙ্গনে জন্ম দিয়েছে নতুন আলোচনার। গণমাধ্যম জগতেও চলছে পর্যালোচনা-বিশ্লেষণ। কেন এবং কোন তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে মির্জা আব্বাস এমন একটি বিস্ফোরক মন্তব্য করলেন, তা নিয়ে এখন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
গত ১৭ এপ্রিল বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য এম ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার ৯ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় মির্জা আব্বাস বলেছেন, ‘ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার পেছনে আওয়ামী লীগ বা সরকার জড়িত নয়। যারা জড়িত তারা দলের অভ্যন্তরেই আছেন। দলের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা ওই ব্যক্তিদের অনেকেই চেনেন। ইলিয়াস গুম হওয়ার আগের রাতে দলীয় অফিসে কোনো এক ব্যক্তির সঙ্গে তার বাগবিতণ্ডা হয় মারাত্মক রকমের। ইলিয়াস খুব গালাগালি করেছিলেন ওই ব্যক্তিকে। সেই যে পেছন থেকে দংশন করা সাপগুলো এই দলে এখনও রয়ে গেছে।’ মির্জা আব্বাস এ সময় দলের মহাসচিবকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘যদি এদের দল থেকে বিতাড়িত না করেন, তাহলে দল কোনো পরিস্থিতিতেই এগোতে পারবে না। (সূত্র : ১৮ এপ্রিলের দৈনিকসমূহ)
মির্জা আব্বাসের ওই বক্তব্য মিডিয়ায় প্রচারিত হওয়ার পর সর্বত্র তুমুল অলোচনার সৃষ্টি হয়। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে এতদিন বিএনপির পক্ষ থেকে ইলিয়াস গুমের জন্য যে সরকারকে দায়ী করা হচ্ছিল, তার কি হবে? বিএনপির দাবি এবং মির্জা আব্বাসের বক্তব্য যে একেবারে বিপরীত সেটা তো অস্বীকার করা যাবে না। এখন প্রশ্ন হলো, কোন তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে মির্জা আব্বাস কথাগুলো বলেছেন। নিশ্চয়ই ওই কথার পেছনে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ তার কাছে আছে। কারণ তিনি একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিক এবং দলের একজন প্রবীণ নেতা। তার কথার ওজন এবং গুরুত্ব দুটোই আছে। তিনি তো আর নেত্রকোনার ছাব্বিশ বছর বয়সি ‘শিশু বক্তা’ রফিকুল ইসলাম মাদানী নন, যে বলবেন, ‘অত কিছু বুঝি নাই, জোশের চোটে বলে ফেলেছি। আমারে মাফ কইরা দেন।’
গত ১৮ এপ্রিল নিজ বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলন করে তিনি বলেছেন, ‘আমার বক্তব্য কাটপিস করে প্রচার করা হয়েছে। সেই কাটপিসকে তুলে ধরে সামনের অংশ, পেছনের অংশ বাদ দিয়ে মাঝখান থেকে যার যতটুকু দরকার ততটুকু নিয়ে মনের মাধুরী দিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। এর সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এবং আমি কোনো দায়িত্ব বহন করি না। যারা বলেছেন, যারা লিখেছেন, এর জন্য তারাই দায়দায়িত্ব বহন করবেন। সংবাদ সম্মেলনে মির্জা অব্বাস দাবি করেন, ইলিয়াস আলীর গুম সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন, সরকারকে কটাক্ষ করেই বলেছেন। সরকার করেনি, তাহলে সরকার খুঁজে বের করে দিক কে করেছে। মিডিয়া তার বক্তব্য বিকৃত করে প্রচার করেছে বলেও মির্জা আব্বাস দাবি করেন।
বেকায়দায় পড়লে নিজের বলা কথাকে বেমালুম অস্বীকার করার একটি সহজাত প্রবণতা আমাদের দেশের কোনো কোনো রাজনীতিকের মধ্যে প্রকটভাবেই দৃশ্যমান। এরা তখন বলির পাঁঠা বানাতে চায় মিডিয়া তথা সংবাদকর্মীদের। এখন হাতে হাতে স্মার্টফোন। তাই বলা কথাকে অস্বীকার করে অত সহজে পার পাওয়া যাবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। মির্জা আব্বাস সেদিন যা বলেছেন সবগুলো টিভি চ্যানেল তা অবিকৃতভাবেই প্রচার করেছে। তাহলে কি সবগুলো চ্যানেল যুক্তি করে তার বক্তব্যকে কাটছাঁট করে প্রচার করেছে? কিন্তু সাংবাদিকতা সম্বন্ধে যারা ন্যূনতম ধারণা রাখেন, তারা জানেন যে, এটা কখনই সম্ভব নয়। একটি চ্যানেল বা সংবাদপত্র যখন অনুসন্ধানী রিপোর্ট করে, তখন অন্যদের সঙ্গে পার্থক্য থাকতে পরে। কিন্তু যখন কোনো ঘটনার নিউজ প্রচার-প্রকাশ করে বা কারও রেকর্ড করা বক্তব্য প্রচার করে, তা অবিকৃতভাবেই করতে হয়। সংবাদমাধ্যমগুলো তাদের গ্রহণযোগ্যতার দিকে সজাগ দৃষ্টি রেখেই এ কাজটি করে। আমাদের রাজনীতিকরা যখনই কোনো কথা বলে ফেঁসে যান, তখনই ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ মিডিয়ার ওপর দায় চাপিয়ে শরীরে লাগা ধুলো-ময়লা ঝেড়ে সাফসুতরো হওয়ার চেষ্টা করেন। এ জন্যই রাজনীতিকদের কায়কারবারে ত্যক্তবিরক্ত মানুষেরা বলে থাকেন, রাজনীতিতে যেমন শেষ কথা বলে কিছু নেই, তেমনি রাজনীতিকদের কথারও কোনো আগামাথা নেই। আর এ কারণেই জনসাধারণের কাছে রাজনীতিকদের কথার গুরুত্ব এখন অনেকাংশেই কমে গেছে।
এদিকে একদিন পরেই নিজ বক্তব্য থেকে মির্জা আব্বাসের ইউটার্ন করার নেপথ্য খবরও এসেছে মিডিয়ায়। ১৯ এপ্রিলের পত্রিকার খবর বলা হয়েছে, ইলিয়াস আলী গুমের ৯ বছর পরে হঠাৎ মির্জা আব্বাসের ভিন্নরকম বক্তব্য দলের ভেতরে এবং বাইরে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে। কেন, কী কারণে, কাকে উদ্দেশ্য করে মির্জা আব্বাস এসব কথা বলেছেনÑ তা নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা। পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, মির্জা অব্বাসের বক্তব্য মিডিয়ায় প্রচারিত হওয়ার পর দলের হাইকমান্ড বিস্মিত ও তার ওপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন। তার এ বক্তব্য সরকারকে দায়মুক্ত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে বলে মনে করেন দলটির নেতাকর্মীরা। তারা মনে করেন, এ বক্তব্যের দ্বারা মির্জা আব্বাস নিজের ও দলের চরম ক্ষতি করেছেন। মির্জা আব্বাসের ওই বক্তব্যে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তার ওপর চরম ক্ষুব্ধ হয়েছেন বলে একটি পত্রিকার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে মহাসচিবের উপস্থিতিতে তিনি ওই মন্তব্য করায় মহাসচিবও চরম বিব্রত। দলটির নেতারা মনে করেন, ইলিয়াস আলীর গুমের জন্য এতদিন তারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে দায়ী করে আসছিলেন। মির্জা আব্বাসের এ বক্তব্যের মাধ্যমে সরকারের হাতে নতুন হাতিয়ার তুলে দেওয়া হয়েছে। এমতাবস্থায় দলের হাইকমান্ড সংবাদ সম্মেলন করে তার বক্তব্য স্পষ্ট করার নির্দেশ দিলে পরদিন ওই সংবাদ সম্মেলন করেন মির্জা আব্বাস। সংবাদ সম্মেলনে মির্জা আব্বাস বলেছেন, ‘ইলিয়াস আলী গুমের জন্য বিএনপির কিছু নেতা দায়ী-আমি কি এই কথা বলেছি? কেউ কি তা প্রমাণ করতে পারবে? বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য হয়ে আমার পক্ষে কি এমন বক্তব্য দেওয়া সম্ভব? নিজের মাথায় নিজেই বোমা ফাটানো-এটা তো সম্ভব না। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, এখানেও আমার কথা বিকৃত করা হয়েছে’ (সূত্র : ১৯ এপ্রিলের দৈনিকসমূহ)।
মির্জা আব্বাস এখন যতই চেষ্টা করুন, নতুন নতুন কথা বলুুন, তিনি যে ওই কথাগুলো নিজের মুখে সজ্ঞানেই বলেছিলেন, তা এখন অস্বীকার করলেও লুকাতে পারবেন না। যেমন যায় না শাক দিয়ে মাছ ঢাকা। হ্যাঁ, তিনি এর কৈফিয়ৎ হিসেবে ‘মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে’ বলে দুঃখ প্রকাশ করতে পারেন। তাতে তার দল বিষয়টিকে হালকাভাবে নিলে নিতেও পারে। কিন্তু তা না করে পুরো দোষ মিডিয়ার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তিনি নিজে ‘ডিটারজেন্ট ধোয়া’ সফেদ বস্ত্র হতে চাইছেন। সচেতন মহলের আপত্তিটা সেখানেই। বিশেষত আমরা যারা সংবাদকর্মী তারা এ ঘটনায় যারপরনাই বিস্মিত, হতভম্ব। এ ট্র্যাডিশন যদি চলতে থাকে তাহলে রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য প্রচার করাই খুব ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে। তারা অবেগের ঠেলায় একটা কিছু বলে ফেলবেন, তারপর ওপর থেকে ঠেলা খেয়ে দোষ চাপাবেন মিডিয়ার ওপর, আর শেষ ঠেলা সামলাতে হবে মিডিয়াকে, এটা তো হতে পারে না। মির্জা আব্বাস যদি মনে করেন, মিডিয়া তার বক্তব্য বিকৃত করেছে, তাহলে ইচ্ছা করলে তিনি ওই টিভি চ্যানেল বা পত্রিকার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেন। বিষয়টি তো মৌখিক নয়, রেকর্ডকৃত। আর তা দেশবাসী সবাই শুনেছে। শুধু টিভি নয়, সামাজিক মাধ্যমেও তার বক্তব্য ভাইরাল হয়েছে। তাহলে তিনি যদি আইনি পদক্ষেপ নেন, আদালতেই প্রমাণ হবে মিডিয়া তার বক্তব্য বিকৃত করেছে, নাকি তিনি যা বলেছেন তা-ই প্রচার করেছে।
তবে, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা মির্জা আব্বাস না জেনেবুঝে কিছু বলেননি। তার বক্তব্যের ভেতরে ঢুকলেই বিষয়টি অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। কারা ইলিয়াস আলীকে গুম করেছে তাদের নাম না বললেও তিনি যে ইঙ্গিত করেছেন, তাতে অনেকের কাছেই বিষয়টি আর অস্পষ্ট নেই। এটা সর্বজনবিদিত যে, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কারান্তরীণ হওয়ার আগ অবধি তার গুলশানের কার্যালয়ে একটি চক্র দলটির সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত। এ বিষয়ে দেশের পত্র-পত্রিকায় বহু সংবাদ-রিপোর্ট ইতঃপূর্বে প্রকাশিত হয়েছে। মির্জা আব্বাসসহ সিনিয়র কিছু নেতা ওই চক্রটির তৎপরতাকে ভালো চোখে দেখতেন না। তারা এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও হস্তক্ষেপ করত। দলীয় কোনো পদ-পদবি না থাকলেও চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে তাদের ছিল দোর্দণ্ড প্রতাপ। তাদের ইঙ্গিতে অনেকের রাজনৈতিক জীবন সংহার হয়েছে। এই চক্রের একজনকে সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটি তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছে। এই অব্যাহতি দেওয়ার পরে সে স্বঘোষিত কর্মকর্তা তার ফেসবুক পেজে লিখেছেন, এই অব্যাহতিতে তিনি অখুশি নন। কারণ তাকে বেগম জিয়ার প্রেস সচিব পদে কেউ নিয়োগপত্র দেয়নি, এমনকি তিনি নাকি বেতন-ভাতাও নিতেন না। আগে-পরে প্রকাশ্যে এটাও বলতেন যে, খালেদা জিয়ার প্রেস সচিবের দায়িত্ব পালন করলেও তিনি বিএনপি করেন না। তার এ বক্তব্য বিএনপির হাইকমান্ড জানলেও কেউ মুখ খোলেনি। যারা খুলেছে, তারা দলের পদ-পদবি হারিয়েছে, অথবা দল থেকে বিতাড়িত হয়েছে।
দলের দীর্ঘদিনের নেতা হিসেবে মির্জা আব্বাস অভ্যন্তরের অনেক কিছুই জানেন বা বোঝেন। হয়তো প্রকাশ করেন না। এবার কেন এমন একটি তথ্যবোমা তিনি ফাটালেন তা অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না। এটা কি দলের মধ্যে দীর্ঘদিনের কোন্দলজনিত ঘটনা থেকে হঠাৎ বিস্ফোরিত, নাকি তার ‘সিøপ অব টাং’? বিষয়টি পরিষ্কার করার দায়িত্ব মির্জা আব্বাসের নিজের। তবে, একটি সংবাদ সম্মেলনে বলা কথা অস্বীকার করলে বা মিডিয়ার ওপর দায় চাপিয়ে তিনি প্রশ্নমুক্ত হতে পারবেন না। তাকে ঝেড়ে কাশতেই হবে। অবশ্য তিনি সেভাবে কাশবেন কি না সেটাই প্রশ্ন। সৌজন্যে সময়ের আলো।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত