আজ আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস
প্রকাশ: ২৯ মে ২০২৪, ১০:৫৫ | আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০:৩৩
পৃথিবীর ৪৩টি দেশে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের মাধ্যমে শান্তিরক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ৩৭ বছর ধরে প্রায় ৬৩টি মিশনে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশ নিজেদের মেধা ও দক্ষতার মাধ্যমে বিশ্ব শান্তিরক্ষায় অবদান রেখে চলেছে। শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশগুলোর মধ্যে বর্তমানে বাংলাদেশ প্রথম স্থানে অবস্থান করছে। আজ বুধবার (২৯ মে) ‘আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস’। এ উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সশস্ত্র বাহিনী। শান্তিরক্ষা মিশনে শহীদদের পরিবার ও আহতদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এদিন উপস্থিত থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ রাখার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও শান্তিরক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনকারী দেশ হিসেবে ১১৮টি দেশের মধ্যে ইতোমধ্যে এক নম্বর দেশ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশ। আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতরের (আইএসপিআর) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ১৩টি দেশে বাংলাদেশের ৬ হাজার ৯২ জন শান্তিরক্ষী দায়িত্ব পালন করছেন। এর মধ্যে নারী শান্তিরক্ষী রয়েছেন ৪৯৩ জন। সেনাবাহিনীর ৪ হাজার ৯৭০ জন, নৌবাহিনীর ৩৫২ জন, বিমানবাহিনীর ৪০৬ জনসহ তিন বাহিনীর ৫ হাজার ৭২৮ জন শান্তিরক্ষী বর্তমানে দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন। ১৯৮৮ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের শুরু থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের ১৬৮ জন শান্তিরক্ষী শহীদ হয়েছেন। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর ১৩১ জন, নৌবাহিনীর ৪ জন ও বিমানবাহিনীর ৯ জন শহীদ হয়েছেন। আহত হয়েছেন ২৬৬ জন।
অপরদিকে পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৯ সালে নামিবিয়া মিশনের মধ্য দিয়ে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ পুলিশের যাত্রা শুরু হয়। তখন থেকে এ পর্যন্ত পুলিশের ২১ হাজার ৪৫৩ জন শান্তিরক্ষী বিভিন্ন দেশে পেশাদারত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে মিশন সম্পন্ন করেছেন। এর মধ্যে নারী শান্তিরক্ষী রয়েছেন ১ হাজার ৮১০ জন। বর্তমানে ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, মালি, সাইপ্রাস, সেন্ট্রাল আফ্রিকা, সাউথ সুদান ও লিবিয়ায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ পুলিশের ১২০ জন নারী সদস্যসহ ৩৬৪ জন শান্তিরক্ষী নিয়োজিত রয়েছেন। অতীতে বিভিন্ন মিশনে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ২৪ জন পুলিশ সদস্য আত্মত্যাগ করেছেন। আহত হয়েছেন ১২ জন।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে গত ৩৭ বছর ধরে ব্লু-হেলমেটের অধীনে বিশ্বের বিভিন্ন বিরোধপূর্ণ দেশে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ কাজ করে যাচ্ছে। সম্প্রতি একটি মহল জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী থেকে বাংলাদেশি সদস্যদের বাদ দিতে অপতৎপরতা শুরু করেছে। কিন্তু এ ধরনের অভিযোগ তুলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রম থেকে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের বাদ দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের অবদান বিশ্বস্বীকৃত।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে একাধিকবার কাজ করেছেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা কর্নেল (অব.) মো. ফরিদ উদ্দিন। লাইবেরিয়ায় ২০০৮-২০০৯ সালে তার কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেন, ‘সেখানে ১০০ দেশের শান্তিরক্ষী কাজ করতো। বাংলাদেশের দুটি কন্টিনজেন্ট ছিল। এছাড়া বাংলাদেশের ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়ন ছিল একটা। তারা সেখানে দেশটির রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, কনস্ট্রাকশন নির্মাণে কাজ করেছেন।’
কর্নেল ফরিদ বলেন, ‘১০০ দেশের মধ্যেও বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল। কারণ বাঙালিদের আচার-ব্যবহার ভালো। তাছাড়া সেনাবাহিনী ও পুলিশ দেশে বিভিন্ন সিভিল ওয়ার্কে যুক্ত থাকে। বন্যা, দুর্যোগ ও নির্বাচনসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনায় দায়িত্ব পালন করে থাকে। যে কারণে বাংলাদেশি সৈনিকদের জনসম্পৃক্ততা বেশি। সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিপদে-আপদে কীভাবে কাজ করতে হয়, সেটা তারা জানে। কিন্তু অন্য অনেক দেশের সেনাবাহিনীর সদস্যরা এত জনসম্পৃক্ত থাকে না। আর আমাদের চিন্তা-চেতনা, ধর্মীয় অনুভূতি, কৃষ্টি-কালচার, পরোপকারিতার মনোভাব বেশি। এসব কারণে আমাদের লোকজন দ্রুত মিশে যেতে পারে। কাজের ক্ষেত্রে, খাবারের সময় আমরা তাদের সঙ্গে নিয়ে খাই। অন্য দেশের শান্তিরক্ষীরা সেটা করে না। আমরা স্থানীয়দের ভালোমন্দের খোঁজ-খবর নিই। আমাদের সৈনিকরা গ্রামগঞ্জের মানুষ। তারা এসব ভালো জানে। অনেক দেশের মিশন থেকে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের নিয়ে আসার সময় ওই দেশের মানুষ মিছিল করেছে, তারা বাংলাদেশিদের যেতে দেবে না। তারা বাংলাদেশ বাংলাদেশ বলে স্লোগান দিতো। এটাই আমাদের বড় অর্জন।’
পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. জালাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী পূর্ব তিমুরে প্রটেকশন অফিসার ও দারপুর মিশনে প্ল্যানিং অফিসার হিসেবে কাজ করেছেন চার বছরের বেশি। ডেপলয়মেন্ট, অপারেশনাল ও অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভসহ পুলিশের প্ল্যানিংয়ের অ্যাকটিভিটিজ ছাড়াও বিভিন্ন স্ট্র্যাটেজিক ডকুমেন্ট ও পলিসি ডকুমেন্টস তৈরিতেও কাজ করেছেন তিনি। দেশে দেশে শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের অবদান ও মিশনে তার কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে বলেন, ‘বিভিন্ন শান্তিরক্ষা মিশনে আমরা কাজ করেছি। এখনও করে যাচ্ছি। কাজ করতে গিয়ে নানাভাবেই আমরা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। সংশ্লিষ্ট দেশের জননিরাপত্তার যে দায়িত্ব, সেটি আমরা আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে পালন করার চেষ্টা করেছি। ইউএন ম্যান্ডেটের আলোকে আমরা চেষ্টা করি—যাতে জননিরাপত্তা ও জনসেবাটা নিশ্চিত করতে পারি।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা সব জায়গাতেই সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। তারা পেশাদারত্ব ও দক্ষতা দিয়ে কাজ করছেন। বিশেষ করে আমাদের দেশের মানুষের কৃষ্টি, কালচারের কারণে আমরা মানুষকে সহজভাবে, আন্তরিকভাবে ও আতিথেয়তার সঙ্গে গ্রহণ করতে পারি। যে কারণে অন্য দেশে গেলেও আমরা সেদেশের মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা অল্প সময়ের মধ্যে অর্জন করতে সক্ষম হই। তাছাড়া বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা কঠোর পরিশ্রম করতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই মিশনে তো বিভিন্ন দেশের শান্তিরক্ষীরা কাজ করেন. সেক্ষেত্রেও সেদেশের মানুষের আস্থার বিষয়টি চলে আসে বাংলাদেশি অফিসারদের প্রতি। ইউএন’র একটা স্ট্যান্ডার্ড সিস্টেম আছে। সেই সিস্টেম অনুযায়ী আমরা কাজ করি। সেটা করতে গিয়ে আমরাও অনেক কিছু শিখি—একটা সিস্টেম কীভাবে কাজ করে। যখন আমরা দেশে ফিরে আসি তখন সেই অভিজ্ঞতাটা কর্মক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারি। যে কারণে দেশের জন্যেও আমাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগে।’
জালাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘মিশনে হিউম্যান রাইটসের বিষয়গুলো কঠোরভাবে মেনে চলার চেষ্টা করি আমরা। যে কারণে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের নিয়ে তেমন কোনও অভিযোগ নেই। আমরা মানবাধিকারকে সুরক্ষিত রেখেই কাজ করে থাকি।’
পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘স্থানীয় জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার যারা কাজ করেন, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই আমাদের মূল কাজ। তাছাড়া কমিউনিটি পুলিশিং এবং স্থানীয় পুলিশের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজ করতে হয় আমাদের।’
সান
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত