অর্ধশতাধিক আসনে নৌকার ‘নতুন মাঝি’!

  গ্রামনগর বার্তা অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০২৩, ১১:১৭ |  আপডেট  : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৩১

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে অর্ধশতাধিক আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী পরিবর্তন হচ্ছে। নানা কারণে এসব আসনে দলটির প্রার্থী পরিবর্তন হবে বলে দলীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে।

গেলো দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর খুব বেশি পরিবর্তন করা হয়নি। তবে এবার ‘জিতে আসার মতো ভালো প্রার্থীকে’ মনোনয়ন দেওয়ার কথা বলেছেন দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা। নতুন মুখের সেই ‘চমক’ দেখা যাবে রবিবার (২৬ নভেম্বর)।

এবার আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৩৬২টি। তাদের মধ্যে টানা তিন দিন দলের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সভায় দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়, তাতে ৫০ থেকে ৬০টি আসনে পরিবর্তন আসার তথ্য জানা যাচ্ছে।

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের একাধিক সদস্য বলেছেন, টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকায় অনেক সংসদ সদস্য নানান বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছেন, অনেকে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে থেকেছেন। রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে নেতিবাচক এই ধারা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি একাদশ সংসদের অন্তত দুই ডজন এমপি। এছাড়াও মোট ৩১ জন সংসদ সদস্য মারা গেছেন। এসব আসনের উপনির্বাচনে যারা নৌকার টিকিটে সংসদ সদস্য হয়েছেন, তাদের মধ্যেও অনেকে ভালো কাজ করতে পারেননি। এ ছাড়া সাবেক আমলা, সরকারি কর্মকর্তা ও তারকাদের আওয়ামী লীগের প্রার্থী করা হচ্ছে। এসব দিক বিবেচনায় ৫০ থেকে ৬০টি আসনে এবার নতুন প্রার্থী দেওয়া হচ্ছে।

তাদের মতে, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থা ও বৈশ্বিক চাপের কারণে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ‘অগ্নিপরীক্ষা’ হিসেবে দেখছে আওয়ামী লীগ। সে জন্য এবার যেকোনও পরিস্থিতিতে জিতে আসার মতো ‘ভালো’ প্রার্থী দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। মূলত সংসদ সদস্য হয়ে এলাকা থেকে যারা জনবিচ্ছিন্ন ছিলেন, তাদের বড় একটা অংশ এবার নৌকার টিকিট পাবেন না। এ ছাড়া বয়স বেশি হওয়ায় কয়েকজন সংসদ সদস্য এবার মনোনয়ন পাচ্ছেন না। বিতর্কিত সংসদ সদস্যদের মধ্যে জেতার মতো কয়েকজনকে এবারও প্রার্থী করা হচ্ছে।

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরুর পর থেকে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জেতার মতো প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়ার কথা বলে আসছেন। শনিবার (২৫ নভেম্বর) তিনি বলেছেন, ‘নতুন ও পুরনো মিলিয়েই আমরা এবার মনোনয়ন দিচ্ছি। যেখানে পুরনোরা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছেন, তাদের নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। যাদের জনপ্রিয়তা আছে, তাদেরই মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে।’

শুক্রবার (২৪ নভেম্বর) আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিষয়ে জানতে চাইলে এক ব্রিফিংয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, নতুন অনেকে এসেছেন, কিছু বাদও পড়েছেন। তবে উইন্যাবল (বিজয়ী হতে সমর্থ) প্রার্থী আমরা বাদ দিইনি। যারা উইন্যাবল-ইলেক্ট্যাবল নন, জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছেন; তারা বাদ পড়েছেন। নারী-পুরুষ সব প্রার্থীর ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য হয়েছে।’

গত বৃহস্পতিবার (২৩ নভেম্বর) তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয় ভবনে দলের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই দিন দুটি বিভাগের প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করা হয়। শুক্র ও শনিবারও দলটির সভাপতি ও সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে বোর্ডের সভায় বাকি ছয় বিভাগের প্রার্থী চূড়ান্ত হয়। তবে সব আসনের প্রার্থী চূড়ান্ত হওয়ার পর একসঙ্গে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা হবে বলে জানান দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

জানা গেছে, বৃহস্পতিবার রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের ৭২টি আসনে দলীয় প্রার্থী বাছাই করে আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে ১০ থেকে ১২টি আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য নৌকার টিকিট পাচ্ছেন না দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। শুক্রবার খুলনা, বরিশাল ও ময়মনসিংহ বিভাগের ৮১টি আসনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ঠিক করা হয়। এর মধ্যে ১৫ থেকে ১৭টি আসনে আসছে নতুন মুখ। শনিবার ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের ১৪৭টি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বাছাই করা হয়েছে। এই তিন বিভাগের ২৫ থেকে ৩১টি আসনের বর্তমান সংসদ সদস্যরা এবার বাদ পড়তে পারেন।

একাধিক দলীয় সূত্রে জানা গেছে, মাগুরা-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে রাজনীতিতে নতুন ইনিংস শুরু করতে যাচ্ছেন তারকা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। এছাড়াও ঢাকা-১০ আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য জনপ্রিয় চিত্রনায়ক ফেরদৌস আহমেদকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে। গুঞ্জন আছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনকে ঢাকা-৬ আসনে, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানককে ঢাকা-১৩ ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমকে ঢাকা-৮ আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব এবং এসডিজি বিষয়ক সাবেক মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কামাল আজাদ জামালপুর-৫ আসনে প্রার্থী হতে যাচ্ছেন বলেও আভাস পাওয়া গেছে।

এছাড়াও ফরিদপুর-৩ আসনে মনোনয়ন পেতে যাচ্ছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামীম হক, রংপুর-৫ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য এইচএন আশিকুর রহমানের পুত্র ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতা রাশেক রহমান, চাঁদপুর-১ আ.লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ, জামালপুর-৪ আসনে ছাত্রলীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেত্রী মারুফা আক্তার পপি ও যশোর-২ (ঝিকরগাছা ও চৌগাছা) স্বনামধন্য হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মো. তৌহিদুজ্জামান তুহিন।

তবে ছাত্রলীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহ ই আলম ও আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ নাথকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি বলেও সূত্র নিশ্চিত করেছে। 

এছাড়া ময়মনসিংহ, রাজশাহী, শেরপুর, বরগুনা, ভোলা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, শেরপুর, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, নওগা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ ও পবনাসহ আরও কয়েকটি জেলায় এক বা একাধিক আসনে প্রার্থী পরিবর্তন করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া জানিয়েছেন, আগামীকাল (আজ রবিবার) বিকাল ৪টায় ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করবেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের এক সদস্য বলেন, ৩০০ আসনে প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করা হলেও ঘোষণার আগ পর্যন্ত কারা বাদ যাচ্ছেন আর কারা নতুন করে যুক্ত হচ্ছেন, সেটি নিশ্চিত করে বলা যাবে না। অতীতে চূড়ান্ত করা তালিকা ঘোষণার ঠিক আগমুহূর্তেও প্রার্থী পরিবর্তন করার নজির রয়েছে।

যদিও শুক্রবার ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘কৌশলগত কারণে কোন কোন বিভাগের মনোনয়ন চূড়ান্ত হয়েছে, তা আর প্রকাশ করা হচ্ছে না। আমরা মনোনয়নের ব্যাপারটা সুনির্দিষ্ট করে এখনও বলছি না। কারণ, এর মধ্যে আমরা যেসব প্রার্থী দিয়েছি, সেসব মনোনয়নে ভুলত্রুটিও থাকতে পারে। সেটাও সংশোধনের একটা সুযোগ রেখেছি। এ কারণে আমরা ঠিক করেছি—ভিন্নভাবে, অর্থাৎ জেলাওয়ারী বা বিভাগওয়ারী প্রার্থিতা ঘোষণা করবো না। একসঙ্গে ৩০০ আসনের প্রার্থিতা ঘোষণা করতে চাই।’

এদিকে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করা সবার সঙ্গে মতবিনিময় সভা করবেন দলটির সভাপতি ও সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সভাপতি শেখ হাসিনা। রবিবার (২৬ নভেম্বর) সকাল ১০টায় তার সরকারি বাসভবন গণভবনে অনুষ্ঠিত হবে সভাটি। সভা শেষ হওয়ার পর আওয়ামী লীগের দফতর থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ৩০০ আসেন নৌকার প্রার্থীদের নাম প্রকাশ করা হবে বলে জানা গেছে।

প্রার্থী বাছাইয়ের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, এবারের নির্বাচনে জেতে আসার মতো ভালো প্রার্থী দেওয়ার কথা বলেছেন নেত্রী শেখ হাসিনা। এলাকায় জনপ্রিয়, নেতাকর্মীদের কাছে গ্রহণযোগ্য প্রার্থীকে আমরা বেছে নিতে চাই।

আওয়ামী লীগ এবার ৩০০ আসনেই দলীয় প্রার্থী দেওয়ার কথা বললেও একাধিক সূত্র বলছে, ১৪ দলের শরিক দলকে সমঝোতার ভিত্তিতে কিছু আসনে ছাড় দেওয়া হলেও তারা নৌকা প্রতীকে ভোট করবেন। বর্তমানে জোট শরিকদের ৮ জন সংসদ সদস্য থাকলেও এবার এই সংখ্যা সামান্য বাড়তে পারে। ছাড়ের তালিকায় নতুন করে যুক্ত হতে পারে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া কল্যাণ পার্টিসহ আরও দুই-তিনটি দলের নাম। এসব দলকে এক বা একাধিক আসনে ছাড় দিতে পারে আওয়ামী লীগ।

শনিবার (২৫ নভেম্বর) আওয়ামী লীগের শরিকদের মনোনয়নের বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়ে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘শরিক সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত আমাদের এখনও হয়নি। আমরা এখনও ঠিক করিনি শরিকদের আসলে আমাদের প্রয়োজন আছে কিনা। জোটের বিপরীতে জোট, আমাদের প্রতিপক্ষ যদি বড় জোট করতো, তাহলে তার বিপরীতে আমাদের জোট হতো। তা ছাড়া আমরা কেন অহেতুক জোট করতে যাবো? প্রয়োজন না থাকলে তো জোট করবো না। আর জোট করবো যাদের নিয়ে, তাদের তো মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা থাকতে হবে।’

একাদশ জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের ২৬২ জন সংসদ সদস্য আছেন। ওই নির্বাচনে দলটি ২৫৮টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল।

কা/আ

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত