অবশেষে নিভলো সুন্দরবনের আগুন, পুড়ে গেছে তিন একর বনভূমি

  হেদায়েত হোসাইন, সুন্দরবন থেকে ফিরে

প্রকাশ: ৪ মে ২০২১, ১৯:২৩ |  আপডেট  : ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:০০

অবশেষে প্রায় ৩০ ঘন্টা পরে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের দাসের ভারানি এলাকার আগুন নিভেছে। ফায়ার সার্ভিস, বন বিভাগ, সিপিজি সদস্য ও স্থানীয়দের সম্মিলিত চেষ্টা এবং বৃষ্টির পানিতে ওই এলাকার সম্পূর্ণ আগুন নেভাতে সক্ষম হয়েছে। মঙ্গলবার (০৪ মে) বিকেল সাড়ে ৫টায় আগুন নেভানো অভিযান সমাপ্ত করেছে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ।এর আগে সোমবার (০৩ মে) দুপুরের দিকে দাসের ভারানি এলাকার আগুন লাগে।৩০ ঘন্টার এই অগ্নিকান্ডে বনের কি পরিমান ক্ষতি হয়েছে জানাতে পারেনি বন বিভাগ। ফায়ার সার্ভিস বলছে আগুনে অন্তত তিন একর বনভূমি পুড়ে গেছে। তবে পুড়ে যাওয়া বনভূমির পরিমান আরও বেশি বলে দাবি করেছে স্থানীয়রা। এর আগে ৮ ফেব্রুয়ারি সুন্দরবনের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্চের ধানসাগর স্টেশনের টহল ফাড়ি এলাকায় অগ্নিকান্ডে ৩ শতাংশ বনভূমি পুড়ে যায়। এই নিয়ে গেল ২০ বছরে সুন্দরবনে ২৫ বার অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। সুন্দরবনে একের পর এক আগুন লাগার ঘটনায় ক্ষোভ ও হাতাশা প্রকাশ করেছেন স্থানীরা।

স্থানীয় কাইয়ুম, ফজলু, সাকিবুল ইসলামসহ কয়েক জন বলেন, সোমবার আগুনের ধোয়া দেখেই আমরা বন বিভাগকে খবর দেই। পরে বন বিভাগের কর্মকর্তারা আসলে তাদের সাথে আমরা বনের মধ্যে প্রবেশ করি। লোকালয় থেকে অনেক দূরে গহীন বনে অগ্নিকান্ড সংগঠিত হওয়ায় ঘটনাস্থলে পৌছাতে আমাদের দেরি হয়েছে।বনরক্ষী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সাথে আমরাও আগুনের চারপাশে ফায়ার বেজ কাটার কাজ করেছি। দুই দিনে অক্লান্ত পরিশ্রমে আজ সুন্দরবনের আগুন নেভাতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু এই সময়ে সুন্দরবনের অন্তত ৫ একর বনভূমি পুড়ে গেছে বলে দাবি করেন তারা।

বন বিভাগের সহয়তাকারী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কমিউনিটি পেট্রোলিং গ্রুপ (সিপিজি)‘র সদস্য মোঃ ফিরোজ ও সগির হোসেন বলেন, আগুনের খবর পেয়ে আমরা বন বিভাগের সাথে এসে গাছের ডাল কেটে, ফায়ার সার্ভিসের মালামাল বহন করে এবং ফায়ার বেজ কেটে আগুন নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতা করেছি।
 
বন সংলগ্ন রসুলপুর গ্রামের মোঃ আফজাল হাওলাদার বলেন, সুন্দরবন আমাদের মায়ের মত। সুন্দরবন আমাদের আগলে রাখে। সুন্দরবনের উপর নির্ভর করে আমরা বেঁচে থাকি। কিন্তু সুন্দরবনের উপর একের পর এক যে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে আমাদেরকে দারুনভাবে ব্যথিত করছে। এসব আগুনে সুন্দরবনের গাছ পুড়ে ছাই হয়না, সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রাণিও হুমকীর মধ্যে পড়ে। বারবার সুন্দরবনে আগুন লাগলেও আগুন লাগার কারণও সাধারণ মানুষকে জানানো হয় না। সুন্দরবন রক্ষায় আগুনের বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়ার দাবি জানান তারা। 

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, বাগেরহাটের উপ-সহকারী পরিচালক মো. গোলাম সরোয়ার বলেন, সকলের প্রচেষ্টায় দাসের ভারানি এলাকায় দৃশ্যমান সকল আগুন আমরা নেভাতে সক্ষম হয়েছি। এখন আর কোথাও আগুন নেই। তবে ওই জায়গাটিতে শুকনো পাতার অনেক পুরু স্তুপ রয়েছে। যার ফলে কোথাও সুপ্ত আগন থাকতে পারে। যেহেতু দৃশ্যমান কোন আগুন নেই তাই আমরা অভিযান সমাপ্ত করেছি। এরপরেও কোথাও যদি আগুন দেখা যায় সেক্ষেত্রে বন বিভাগ আমাদের জানালে আমরা আগামীকাল আবারও পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করব।

ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে গোলাম সরোয়ার আরও বলেন, আগুনে দাসের ভারানি এলাকার অন্তত তিন একর বনভূমি পুড়েগেছে। ছোট গাছ, লতাপাতাসহ বেশকিছু বড় গাছ পুড়ে গেছে। 

সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোহাম্মাদ বেলায়েত হোসেন বলেন, ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায় আমরা আগুন নেভাতে সক্ষম হয়েছি। এরপরেও কোথা কোন সুপ্ত আগুন থাকলে সেগুলো নেভানো হবে। প্রয়োজনে আবারও ফায়ার সার্ভিসের সহযোগিতা নেওয়া হবে। অগ্নিকান্ড সংগঠিত এলাকায় বনরক্ষীদের টহল জোরদার করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, অগ্নিকান্ডের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমান জানতে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।তদন্ত কমিটির রিপোর্টে যদি অগ্নিকান্ড মানবসৃষ্ট এমন রিপোর্ট পাওয়া যায় তাহলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহনের আশ্বাস দেন তিনি।

যেভাবে আগুন নেভানো হল সুন্দরবনের আগুনঃ সোমবার (০৩ মে) দুপুরের দিকে আগুন লাগে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের দাসের ভারানি এলাকায়। অগ্নিকান্ডের খবর পেয়েই ঘটনাস্থলে পৌছায় বন বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয়রা।লোকালয় থেকে আগুনের স্থান বনের অনেক ভিতরে হওয়ায় ঘটনাস্থলে পৌছাতেই দুই ঘন্টা কেটে যায় তাদের। প্রথমে ফায়ার সার্ভিসের একটি শরণখোলা স্টেশনের একটি টিম থাকলেও পরবর্তীতে তিনটি টিম যায় ঘটনাস্থলে।ভোলা নদী থেকে আগুনের স্থান পর্যন্ত পানির পাইপ টানতে নেমে আসে সন্ধ্যা। সুন্দরবনের নিয়ম অনুযায়ী অগ্নি নির্বাপন অভিযান বন্ধ রেখে সবাই চলে আসেন লোকালয়ে। মঙ্গলবার সকাল ৭টায় সুন্দরবন সংলগ্ন শরণখোলা উপজেলার রসুলপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায় ফায়ার সার্ভিসের তিনটি টিম আগুন নির্বাপনের জন্য সকল যন্ত্রপাতি নিয়ে রসুলপুর গ্রামে। ভোলা নদী পার হয়ে স্থানীয় অর্ধশতাধিক লোক, বন বিভাগের শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ আবার বনের মধ্যে প্রবেশ করেন ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা। প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টার চেষ্টায় নদী থেকে আগুন পর্যন্ত ডেলিভারী পাইপ নিতে সক্ষম হন তারা। এরপরেই শুরু হয় কাক্সিখত সেই কর্মযজ্ঞ। আগুনের স্থানে পানি সরবরাহ শুরু করে ফায়ার সার্ভিস। পানি পেয়ে তেজ কমে আগুনের। ফায়ার সার্ভিসের সহযোগি হিসেবে আগুন নির্বাপনে কাজ করে বন বিভাগ, সিপিজি সদস্য ও স্থানীয় অর্ধশতাধিক মানুষ। এভাবে কর্মযজ্ঞ চলার মাঝে ১২টার দিকে বৃষ্টি নামে সুন্দরবনে। বৃষ্টির পানি ও ফায়ার সার্ভিসের দমকালের পানিতে আগুন নিভতে শুরু করে আস্তে আস্তে। এভাবে কাজ করতে করতে দুপুর আড়াইটার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ফায়ার সার্ভিস ও বন বিভাগ। সর্বশেষ বিকেল ৫টায় দৃশ্যমান সকল আগুন নিভে যায় দাশের ভারানি এলাকার। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, বাগেরহাটের উপ-সহকারী পরিচালক মো. গোলাম সরোয়ার অগ্নি নির্বাপন অভিযান সমাপ্ত করেন। এভাবেই নেভানো হয় সুন্দরবনের আগুন।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত