অজ্ঞতা নয়, জানতে হবে ধর্ষণ সম্পর্কিত আইন
প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২২, ১২:৪৪ | আপডেট : ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২:৪৫
২০২০ সাল আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। এ বছর বাংলাদেশ লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা- সম্পর্কিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে যুগান্তকারী একটি পরিবর্তন আনা হয়েছে। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা এবং অন্যান্য কিছু পরিবর্তন এনে বাংলাদেশ সরকার ধর্ষণকে সবচেয়ে ঘৃণ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় অনেক মামলা দ্রুত বিচারের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় নেমে পরিবর্তনের ডাক দিয়েছেন। ধর্ষকদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে দেশব্যাপী প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও সমাবেশ হয়েছে।
সরকার এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তটিকে অবলম্বন করে আইনের সময়োপযোগী সংস্কার করেছে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো কঠোর আইন, প্রচার–প্রচারণা ও উচ্চ আদালতের নানা ধরনের নির্দেশনার পরও নারীর প্রতি সহিংসতা কমানো যাচ্ছে না। বরং দিন দিন এর মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি ২০২০ সালে কোভিড–১৯ মহামারির সময় নারী ও মেয়েদের প্রতি সহিংসতার ঊর্ধ্বগতি সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে। বছরজুড়ে নারীর প্রতি সহিংসতা নতুন নতুন মাত্রা পেয়েছে। আবার এই সবকিছুর জন্য আবার নারীকেই দায়ী করছে সমাজ। নারীকে দায়ী করার এই মানসিকতার পেছনে প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাই কাজ করছে। আর সমাজের এই জায়গায় কাঠামোগত সংস্কার জরুরি।
বাংলাদেশে অনেক কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও অনেক নারী ও মেয়ে প্রায়ই আইনের অধীনে অর্থবহ আইনি প্রতিকার পান না এবং এর ফলে নির্যাতনকারীদের খুব কমই বিচারের আওতায় আনা যায়। অনেক ক্ষেত্রে বিচার প্রায় বিলম্বিত হয় বা বছরের পর বছর ধরে টানা হয়। কোনো সাক্ষী সুরক্ষা আইন এ ব্যবস্থা গ্রহণ না করা, নির্যাতনকারীদের ভয় বা হুমকি, আদালতে মামলা চালিয়ে যাওয়ার আর্থিক ও মানসিক চাপের কারণে অনেক নারী প্রায়ই আদালতের বাইরে আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা করে ফেলেন।
নারীদের ক্ষমতায়নের বিষয়গুলোকে সমাজ এখনো ভালো চোখে দেখে না। নারীর বাইরে বের হওয়াকে পুরুষের ক্ষমতা খর্ব হওয়া হিসেবে দেখা হয়। ফলে নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে। বিশ্বের যেসব দেশে মানবাধিকার ও সভ্যতার মানদণ্ড অনেক ওপরে, শিক্ষা-দীক্ষা, অর্থনীতি, সামাজিক ন্যায়বিচারে যাদের প্রশংসনীয় অবস্থান আছে, সেসব দেশেও নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউর ২০২০ সালের এক জরিপে দেখা যায়, সুইজারল্যান্ডে প্রতি ১ লাখ মানুষের মধ্যে ৭৭ দশমিক ৫ জন নারী ধর্ষিত হয়। সুইডেনে এই হার ৬৩ দশমিক ৫, অস্ট্রেলিয়ায় ২৮ দশমিক ৬, যুক্তরাষ্ট্রে ২৭ দশমিক ৩, নিউজিল্যান্ডে ২৫ দশমিক ৮, নরওয়ে ১৯ দশমিক ২, ফ্রান্সে ১৬ দশমিক ২, অস্ট্রিয়ায় ১০ দশমিক ৪, জার্মানিতে ৯ দশমিক ৪, নেদারল্যান্ডসে ৯ দশমিক ২। দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রতি ১ লাখ নারীর মধ্যে ১৩২ দশমিক ৪ জন ধর্ষিত হয়। বাংলাদেশে এই হার ৯ দশমিক ৮২।
সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ই ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতার প্রধান কারণ। ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মতো জঘন্য অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি নাগরিকদের পারিবারিক ও নৈতিক মূল্যবোধের উন্নয়ন করতে হবে।
বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে ধর্ষণ ও নির্যাতনকারী তথা অপরাধীরা অনেক ক্ষেত্রেই রেহাই পেয়ে যায়। বিচারপ্রক্রিয়া দীর্ঘদিন চলতে থাকলে বাদী ও সাক্ষীরা মামলাটি পরিচালনা করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
এ ধরনের ঘটনাগুলোতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাক্ষী পাওয়া যায় না বা সাক্ষী থাকলেও তাঁরা সাক্ষ্য প্রদান করতে অনীহা প্রকাশ করেন। আবার দীর্ঘদিন পর মামলার রায়ে আসামির সাজা হলেও তা গণমাধ্যমে অনেক সময় গুরুত্বসহকারে প্রকাশ পায় না। ফলে শাস্তির খবরগুলো জনসম্মখে না আসায় অনেকেই মনে করে দেশে বিচারহীনতার উদাহরণ বেড়ে যাচ্ছে। তাই গুরুতর ও স্পর্শকাতর অপরাধগুলোর বিচারকার্য দ্রুত সম্পন্ন করে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা হলে এবং তা গণমাধ্যমে প্রচার করলে সেটি অপরাধীদের জন্য একটি সতর্কমূলক বার্তা বহন করবে।
পরিবারে সঠিক শিক্ষার অভাবে নারীর প্রতি আধিপত্য বিস্তারের প্রবণতা জন্মে। তখন তাঁরা যেকোনো গর্হিত অপকর্ম করতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। সন্তানদের সঠিক শিক্ষায় গড়ে তুলতে হবে। তাদের নীতিবান ও আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
এ দায়িত্ব পরিবার, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবাইকে নিতে হবে। নারীর প্রতি সম্মান, নারীর মর্যাদাসহ অন্যান্য সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে শিক্ষা ও গঠনমূলক বিষয় নিয়ে পরিবারে আলোচনা করতে হবে। শিশু বয়স থেকেই শিশুর মননশীলতায় নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে।
সমাজের প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া নারী সহিংসতা বন্ধে শুধু সরকারের ওপর দায়িত্ব দিয়ে দিলেই হবে না। সবার আন্তরিক সহযোগিতা ও অংশগ্রহণ ছাড়া এই ভয়াবহ ব্যাধি সরকারের একার পক্ষে বন্ধ করা সম্ভব নয়।
অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি ২০২১ সালের দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতনের মতো বিষয়গুলো এখনো আমাদের দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। এ জন্য সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণ আবশ্যক। আমরা চাই ২০২১ সাল নারীর জন্য শান্তি ও কল্যাণ বয়ে আনুক। নতুন বছরের প্রতিটি দিন হোক সবার জন্য আনন্দময় ও ভালোবাসাপূর্ণ।
বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান সংক্রান্ত একটি অধ্যাদেশে সই করেছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি।
ধর্ষণ এবং যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রতিবাদ এবং বিক্ষোভের পর সোমবার আইনের সংশোধনীটি অনুমোদন করে বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা।
রাষ্ট্রপতির জারি করা নতুন এই অধ্যাদেশে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ধর্ষণ, ধর্ষণ জনিত কারণে মৃত্যু শাস্তি ইত্যাদি প্রসঙ্গে ৯ (১) ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি এতদিন ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
তবে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে বা দল বেধে ধর্ষণের ঘটনায় নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে বা আহত হলে, সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। সেই সঙ্গে উভয় ক্ষেত্রেই ন্যূনতম এক লক্ষ টাকা করে অর্থ দণ্ডের বিধানও রয়েছে।
সেই আইনেই পরিবর্তন এনে ধর্ষণ প্রমাণিত হলেই মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবনের বিধান রাখা হয়েছে। সেই সঙ্গে অর্থদণ্ডের বিধানও থাকছে।
প্রথমে ২০০০ সালে জারি করা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৩৪টি ধারার মধ্যে ১২টি ধারাতেই বিভিন্ন অপরাধের শাস্তি হিসাবে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার বিধান ছিল।
তবে পরবর্তীতে অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ ও মানব পাচার সংক্রান্ত দুইটি আইনের অংশ আলাদা হয়ে যাওয়ার পর এই আইন থেকে বাদ দেয়া হয়।
ফলে এই আইনের সাতটি ধারায় মৃত্যুদণ্ডের বিষয়টি বহাল থাকে।
নতুন অধ্যাদেশে ৯ (১) ধারাটি সংশোধন করে যাবজ্জীবন অথবা মৃত্যুদণ্ডের বিধান আনা হয়েছে।[বি বি সি নিউজ বাংলা]
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত