সন্দেশখালিতে 'মধ্যযুগীয় বর্বরতা' মমতার রাজনীতির প্রতিচ্ছবি : পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি

  অভিজিৎ বড়ুয়া অভি

প্রকাশ: ৩ মার্চ ২০২৪, ১২:১১ |  আপডেট  : ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৪৬

বর্তমানে কলকাতায় অবস্থান করার কারণে বিভিন্ন জনের সাথে সাক্ষাৎ হয়। দেখা যাচ্ছে সর্বত্র সন্দেশখালি বিষয়ে আলোচনা। সকলের সাথে কথা বলে মনে হলো, পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার পর বামদের (সিপিআই (এম)/ বামফ্রন্ট) জন্য সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম যে পরিণতি ডেকে এনেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য একই পরিণতি বয়ে আনতে পারে সন্দেশখালি। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রধান বিরোধীশক্তি তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে কার্যত খড়কুটোর মতো সাফ হয়ে যায় টানা ৩৪ বছরের বাম শাসন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছে সন্দেশখালির ঘটনা বিজেপির তৈরি । কিন্তু বাস্তবতা হলো মমতা’র তৃণমূল কংগ্রেস দলের নেতা-পাতি নেতাদের তাণ্ডবে পশ্চিমবঙ্গের সহিংসতার চাপ অবিরাম অব্যাহত রয়েছে। এদিকে পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক আবেগকে জাগিয়ে তুলে এবং তৃণমূলের দূর্নীতি, অত্যাচারের বিষয়কে সামনে এনে সামাজিক এবং রাজনৈতিক শক্তিকে জোরদার করে বিজেপি সামনের নির্বাচনে জয়ী হতে চাইছে। পশ্চিমবঙ্গে ১৩ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও যদি তিনবার নির্বাচিত তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার আসন্ন নির্বাচনে ব্যর্থ হয়, তবে এর অন্যতম কারণ পূর্ববর্তী বামফ্রন্ট সরকারের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সহিংসতার কাঠামো ভাঙতে ব্যর্থতা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্য জুড়ে অপরাধের নেটওয়ার্ককে উপড়ে ফেলতে অনিচ্ছুক, বরং পৃষ্ঠপোষকতা দিতে আগ্রহী।
 
ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার সন্দেশখালি এলাকার গ্রামগুলির স্থানীয় লোকজন, বিশেষ করে মহিলারা, মমতার তৃণমূল কংগ্রেস নেতাদের দ্বারা মহিলাদের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতন এবং জমি দখলের অভিযোগে প্রতিবাদ শুরু করে৷ ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের এক স্থানীয় নেতার বিরুদ্ধে রেশন কেলেঙ্কারির অভিযোগ দিয়ে এই জনঅসন্তোষ শুরু। বিষয়টি আরও গুরুতর হয় যখন বেশ কয়েকজন মহিলা, তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা শাহজাহান শেখ এবং তার সহযোগীদের দ্বারা যৌন নির্যাতনের অভিযোগ তোলেন। সাথে সাথে সন্দেশখালীর বাসিন্দারাও শেখ ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ তোলেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি, বাসিন্দাদের একটি দল বিক্ষোভ করে এবং একটি মৎস্যশালার গার্ড রুমে আগুন ধরিয়ে দেয়, তাদের দাবি ছিল যে মৎস্যশালার গার্ড রুমটি স্থানীয় তৃণমূল কংগ্রেস নেতাদের দখল করা জমিতে নির্মিত হয়েছিল। সন্দেশখালির গ্রামবাসীরা অভিযোগ করেছে যে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা জোরপূর্বক তাদের জমি দখল এবং ভেরি নামক অগভীর মাছের পুকুর খননের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছে। ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে সন্দেশখালীতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযোগ নিরসন ক্যাম্প শুরু হয়। শত শত গ্রামবাসী অভিযোগ দায়ের করেছে যে তারা তৃণমূল কংগ্রেস নেতাদের কাছে মৎস্য চাষের জন্য যে জমি লিজ দিয়েছিল তার জন্য তারা টাকা ।

কয়েক দশক ধরে নীরবে অসম্মান ও সহিংসতার শিকার হয়ে সন্দেশখালী গ্রামবাসীর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। উত্তর ২৪ পরগনার জলাভূমি থেকে মহিলার পর মহিলারা বর্ণনা করেছেন যে, কীভাবে মমতা সরকারের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের গুন্ডা এবং একসময় সিপিআই(এম)'র 'হার্মাদ' মিলিশিয়ার সদস্য শেখ শাহজাহান এবং তার লোকেরা মহিলাদের জোড় করে তাদের স্বামীদের কাছ থেকে নিয়ে যেত। জোরপূর্বক উচ্ছেদ এবং যৌন শোষণ চালিয়েছে এই শেখ শাহজাহান। সন্দেশখালীতে শেখ শাহজাহানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের জন্য গঠিত একটি সর্ব-মহিলা পুলিশ দল, বিভিন্ন গ্রামে ৭০ টিরও বেশি মহিলার সাথে সাক্ষাত্কারের সময় জোরপূর্বক শ্রম এবং শ্লীলতাহানির সম্ভাব্য ঘটনা চিহ্নিত করেছে। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ এখনও পর্যন্ত সন্দেশখালিতে সহিংসতার ঘটনায় জড়িত স্থানীয় তৃণমূল কংগ্রেস নেতা শিবাপ্রসাদ হাজরা এবং উত্তম সর্দার সহ ১৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। শাহজাহান শেখ, শিবাপ্রসাদ হাজরা এবং উত্তম সর্দার সহ অভিযুক্ত তিনজনের বিরুদ্ধে 'গণধর্ষণ' এবং 'হত্যার চেষ্টা' ধারাও যুক্ত করা হয়েছে। সিআরপিসির ১৬৪ ধারার অধীনে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে একজন ভুক্তভোগী মহিলা তার বক্তব্য রেকর্ড করার পরে ধারাগুলি যুক্ত করা হয়। শাহজাহান শেখ এখনও পলাতক। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ শাজাহান শেখের ভাই শেখ সিরাজের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছে। স্থানীয়রা সিরাজের বিরুদ্ধে সন্দেশখালী থানায় জমি দখলের অভিযোগ দায়ের করলে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। মহিলা বিক্ষোভকারীরা তৃণমূল কংগ্রেস নেতা শঙ্কর সর্দারের বাড়িতে ভাঙচুর চালায়। একদল মহিলা ঝাড়ু ও লাঠি নিয়ে প্রতিবাদ করে। পরিস্থিতি সামাল দিতে মোতায়েন করা হয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী। এদিকে কলকাতা হাইকোর্ট পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছে শাজাহান শেখকে গ্রেপ্তার করার জন্য। পশ্চিমবঙ্গের গভর্নর সিভি আনন্দ বোস পুলিশ মহাপরিচালকের (ডিজিপি) কাছে রিপোর্ট চেয়েছেন।

সামনে সাধারণ নির্বাচনের আগে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার সুন্দরবন ব-দ্বীপের গ্রাম সন্দেশখালি রাজ্য রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। সন্দেশখালির ঘটনাকে ভর করে বিজেপি সামনের নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসকে পরাজিত করে পশ্চিমবঙ্গের মসনদে বসতে চায়। তারই প্রেক্ষাপটে সন্দেশখালির বর্তমান ঘটনাকে বিরোধী দলের নেতা এবং বিজেপি বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী সম্পূর্ণ পরিস্থিতিটিকে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার নন্দীগ্রাম শহরের সাথে তুলনা করেছেন, যেখানে ২০০৭ সালে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার কর্তৃক জোরপূর্বক জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে একটি আন্দোলন ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেসকে ক্ষমতায় নিয়ে গিয়েছিল। পাশাপাশি দিল্লিতে, লোকসভার বিশেষাধিকার কমিটি বিজেপি সাংসদ সুকান্ত মজুমদারের একটি অভিযোগের ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকজন সিনিয়র আধিকারিককে নোটিশ জারি করা হয়েছে, তিনি অভিযোগ করে যে ১৪ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য পুলিশ মমতার নির্দেশে তাকে সন্দেশখালি যেতে বাধা দিলে তিনি আহত হয়েছিলেন। গত দুই সপ্তাহ ধরে, একাধিক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গ এবং মহিলাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থতার জন্য মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বাধীন সরকারকে দায়ি করেছেন। মহিলাদের যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলে, সিনিয়র বিজেপি নেতা এবং প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ অভিযোগ করেছেন যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি মহিলাদের সম্মানের চেয়ে তার রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা বাঁচাতে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন, “একজন মহিলা মুখ্যমন্ত্রী কেন নিজের রাজনৈতিক সুনাম বাঁচাতে নারীদের সম্মান বিপন্ন করছেন? তার বিবেক কোথায়"? তবে ভোটের আগে মমতাকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা, বিজেপির পরিকল্পিত রাজনীতি! সন্দেশখালি নিয়ে সন্তব্য করেছেন তৃণমূলের রাজ্যসভা ভোটের অন্যতম প্রার্থী সাংবাদিক সাগরিকা ঘোষ। তাঁর কথায়, দেশের একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবসময় মহিলাদের এগিয়ে রাখেন, তাঁদের সুযোগ করে দেন। তিনি নিজে মহিলা হয়ে এই ব্যাপারটি নিয়ে গর্বিত, মন্তব্য সাগরিকার। 

সন্দেশখালির সঙ্গে এবার ইরাক, ইরান, পাকিস্তানের তুলনা করলেন বিজেপি সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়। দিল্লিতে সাংবাদিক বৈঠক করে লকেট চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘আপনারা ভাবতেই পারবেন না এখন সন্দেশখালির অবস্থা কি! আমরা আইসিএস জঙ্গিগোষ্ঠীর কথা শুনেছি। আমরা ইরাক, ইরানের কথা শুনছি, আমরা পাকিস্তানের কথা শুনেছি। সেখানে কী ভাবে মহিলাদের উপর অত্যাচার করা হয়। আজ সেটাই পশ্চিমবঙ্গে হচ্ছে।’ তাঁর কথায়, ওই এলাকায় হিন্দু মহিলাদের বেছে বেছে তুলে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করা হয়েছে। তাঁরা সেই কারণে কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে তাঁদের অত্যাচারের কথা যাচ্ছে। তাঁদের পরিচয় মানুষের সামনে আনতে পারছে না ভয়ের কারণে। এমনকি, পুলিশ ইচ্ছে করেই শেখ শাহজাহানকে খুঁজে বের করছে বা বলে দাবি লকেটের। লকেটের কটাক্ষ, ‘ ওখানে দুই জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু, শেখ শাহজাহানকে কেন পুলিশ খুঁজে পাচ্ছে না? কারণ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আঁচলের তলায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে তাঁকে। সামনেই লোকসভা নির্বাচন আছে? ওঁর তো ৩০ শতাংশ মহিলা ভোট দরকার। তাতে, হিন্দু মহিলাদের যা কিছু হয়ে যাক। তাঁদের তো ওঁরা পাঁচশো টাকা দিচ্ছে। ৫০০ টাকা দিয়ে হিন্দু মহিলাদের কিনে নেওয়া হচ্ছে।’ সন্দেশখালির ঘটনায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিরোধী মঞ্চ ‘ইন্ডিয়া’কে এক বন্ধনীতে রেখে আক্রমণ শানাচ্ছে বিজেপি। সন্দেশখালি-কাণ্ডে প্রধান অভিযুক্ত শাহজাহান শেখকে কেন মমতা এখনও রক্ষা করছেন, সেই প্রশ্ন তুলেছেন বিজেপি নেতা তথা সাংসদ রবিশঙ্কর প্রসাদও।

আগামী মাসে পশ্চিমবঙ্গ সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেই সন্দেশখালীতে নারী অভিযোগকারীদের সাথে দেখা করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। তবে বিজেপি সীমাবদ্ধতা হলো, প্রধান বিরোধী দল হওয়া সত্ত্বেও তারা কার্যকরভাবে সন্দেশখালির জনরোষকে সংহত করতে পারেনি। অভ্যন্তরীণ বিভাজন এবং সাংগঠনিক সংহতির অভাব তারা এই সুযোগকে তৃণমূলের বিরুদ্ধে কাজে লাগতে এখনো পর্যন্ত ব্যর্থ। তাছাড়াও বিজেপিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপুল জনপ্রিয়তাকে স্বীকার করতে হবে। জনগণের সাথে তার সংযোগ রাজ্যের যেকোনো বিজেপি নেতার থেকে বেশী। শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ক্যারিশমার উপর নির্ভর করে এই রাজ্যে নির্বচনে জেতা যথেষ্ট নাও হতে পারে। বলা যায়, বাংলায় বিজেপির বর্তমান কৌশল অপর্যাপ্ত। সন্দেশখালি ঘটনায় বিজেপির সাম্প্রতিক সময়ে রাজ্য জুড়ে তৃণমূল কংগ্রেসের ব্যর্থতা তুলে ধরা, পশ্চিমবঙ্গ জয়ের জন্য অপর্যাপ্ত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শক্তি গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম জনসংখ্যা (প্রায় ৩০% ভোটার) সহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সাথে তার গভীর সংযোগের মধ্যে নিহিত। তাকে সত্যিকার অর্থে চ্যালেঞ্জ করতে, বিজেপির একটি বিস্তৃত পদ্ধতির প্রয়োজন।

পরিশেষে, সন্দেশখালিতে তৃণমূল কংগ্রেসের গুন্ডাদের অত্যাচার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রামে বামফ্রন্ট সরকারের পরিণতি হয়ে উঠতে পারে। মমতার তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিম বাংলায় ইতিমধ্যে নিজেদেরকে দুঃশাসনের স্বর্গ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আগের নির্বাচনে ভোট-পরবর্তী সহিংসতা আদালতে রয়েছে, টিভি পর্দা জুড়ে বেপরোয়া দুর্নীতির সংবাদ, জ্বলে উঠেছে বেকারদের ক্ষোভ যা রাস্তায় ছড়িয়ে পড়েছে এবং রাজ্যের ঋণ ৬ লক্ষ কোটি টাকা ছুঁয়েছে।

 

লেখকঃ কথা সাহিত্যিক, কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক। 

 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত