মুন্সীগঞ্জে রাসেল ভাইপার সাপ : জনমনে আতঙ্ক

  কাজী আরিফ

প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২৩, ২০:৩৪ |  আপডেট  : ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০১:৩৬

পৃথিবীর সব সাপ মানুষকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে কিন্তু একমাত্র কিলিংমেশিন খ্যাত রাসেল ভাইপারের সে বৈশিষ্ট্য নেই। বিষধর সাপ হিসেবে পৃথিবীতে রাসেল ভাইপারের অবস্থান ৫ নম্বরে কিন্তু হিংস্রতা আর আক্রমণের দিক থেকে তার অবস্থান প্রথমে। এরা আক্রমণের ক্ষেত্রে এতই ক্ষিপ্র যে, ১ সেকেন্ডের ১৬ ভাগের ১ ভাগ সময়ের ভেতরে কামড়ের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে।

পৃথিবীতে প্রতিবছর যত মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়, তার উল্লেখযোগ্য একটি অংশ এই রাসেল ভাইপারের কামড়ে মারা যায়। এদের বিষদাঁত বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৃহৎ। এরা প্রচণ্ড জোরে হিস হিস শব্দ করতে পারে। রাসেল ভাইপারের বিষ হোমটক্সিন, যার কারণে কামড় দিলে মানুষের মাংস পচে যায়।

রাসেল ভাইপার যে মানুষকে কামড়ায় তাকে বাঁচানো খুবই কষ্টকর। অনেক সময় বিষ নিস্ক্রিয় করা গেলেও দংশিত স্থানে পচন ধরে। তারপর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই রোগী মারা যান। পচা অংশ কেটে ফেলার পরেও জীবন বাঁচানো যায় না। দ্রুত পচন ধরে সারা শরীরে। এর অসহিষ্ণু ব্যবহার ও লম্বা বিষদাঁতের জন্য অনেক বেশি লোক দংশিত হন। সাপটির বিষক্রিয়ায় অত্যাধিক রক্তক্ষরণ ঘটে এবং অনেক যন্ত্রণার পর মৃত্য হতে পারে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভয়ে হার্ট অ্যাটাকে অনেকের মৃত্যু হয়।

বাংলাদেশে বিলুপ্ত প্রায় এই রাসেল ভাইপার সাপটি গত ৪/৫ বছর ধরে মুন্সীগঞ্জে উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ধারনা করা হয় ২০১৮ সালে পদ্মা নদীতে ভেসে ভয়ঙ্কর বিষধর ফিমেল রাসেল ভাইপার সাপ এসেছে মুন্সিগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায়। 

২০১৮ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে পদ্মার চর থেকে রাসেল ভাইপারকে অজগর ভেবে এক ব্যক্তি বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। এরপর রাসেল ভাইপারের কামড়ে তিনি মারা যান। মুন্সিগঞ্জে রাসেল ভাইপারের কামড়ে এটিই প্রথম মৃত্যু বলে ধারণা করা হচ্ছে।

২০১৯ সালে নভেম্বরে লৌহজংয়ের মালিরঅংক গ্রাম থেকে উদ্ধার করা হয় ৪ ফুট  দৈর্ঘ্যের একটি বিষধর রাসেল ভাইপার সাপ । লৌহজং থেকে এই সাপ এটিই প্রথম উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত সাপটি লৌহজং বন বিভাগ ঢাকার আগারগাঁও এর বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট, বন বিভাগের কার্যালয়ে দিয়ে আসেন। এছাড়া ঐ বছর এই উপজেলায় আরো দু'টি রাসেল ভাইপার সাপের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এর মধ্যে একটি স্থানীয়রা মেরে ফেলেছে এবং আরেকটি নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল।

২০২০ সালের নভেম্বরে  টঙ্গীবাড়ি উপজেলায় একটি রাসেল ভাইপার পাওয়া গিয়েছিল। উপজেলার দীঘিরপাড় ইউনিয়নের মিতারা গ্রামে অপু মণ্ডল নামে এক ব্যক্তি পুকুরে মাছ ধরতে গিয়ে কচুরিপানার ৪/৫ ফিটের একটি বিষধর রাসেল ভাইপার সাপ দেখতে পায়। পরে স্থানীয়দের সহযোগিতায় বিষধর সাপটি উদ্ধার করে খাচায় ভরে বন্দি করে রাখা হয়।

অপু মণ্ডল জানান, পুকুরে মাছ ধরতে গিয়ে সাপটিকে দেখতে পাই। প্রথমে মনে হয়েছিল অজগর সাপ। এর পর ইন্টারনেটের মাধ্যমে চট্টগ্রাম ভেনম রিসার্চ সেন্টারের কর্মকর্তা বোরহান বিশ্বাসের কাছে ছবি পাঠিয়ে জানতে পারি এটি রাসেল ভাইপার (চন্দ্রবোড়া) বিষধর সাপ। পরে সাপটিকে চট্টগ্রাম ভেনম রিসার্চ সেন্টারে পাঠানো হয়, এন্টি ভেনম তৈরির কাজে ব্যবহারের জন্য। 

এছাড়া ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে শ্রীনগরে পদ্মার পারে বিষাক্ত রাসেল ভাইপার সাপ জেলেদের দোয়াইর জালে আটকা পরেছিল। উপজেলার বাঘড়া বাজার সংলগ্ন পদ্মা নদীর পারে স্থানীয় জেলেদের দোয়াইর জালে আটকা পরে এ বিষধর রাসেল ভাইপার সাপ। পরে বাঘড়া পুলিশ ফাঁড়ির এ.এস.আই জাহিদ হোসেন উক্ত স্থানে উপস্থিত হয়ে কার্যত পদক্ষেপ গ্রহন করেন।

২০২৩ সালের জুলাই মাসে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে বিষধর সাপ রাসেল ভাইপারের কামড়ের পর প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন টিংকু বর্মন (৩২) নামে এক যুবক। উপজেলার কনকসার গ্রামে নিজ বাড়িতে মন্টু বর্মনের ছেলে টিংকু রাসেল ভাইপারের কামড়ের শিকার হন। পরে রাতেই অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হলে সুস্থ হন টিংকু।

গত ১ নভেম্বর [২০২৩] রাসেল ভাইপার সাপের কামড়ে আহত হন বাবু শেখ (২৮) নামে এক যুবক। সে লৌহজং উপজেলার বেজগাঁও গ্রামের মোসলেম শেখের পুত্র। বাবুকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে চার দিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর অবশেষে  মারা যান। স্থানীয়দের সাথে আলাপ করে জানা যায় লৌহজংয়ে এই সাপের দংশনে কমপক্ষে চার জন মারা গিয়েছে। 

রাসেল ভাইপার সাপের কারণে মুন্সীগঞ্জে এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিশেষ করে জেলার পদ্মাপাড় সংলগ্ন গ্রামগুলোর জনমনে বেশি আতঙ্ক বিরাজ করছে। পূর্বে এখানকার জনসাধারণের রাসেল ভাইপার সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না, এখন সাধারণ মানুষ সচেতন হয়েছে।

 

          কাজী আরিফ 

বার্তা সম্পাদক, গ্রামনগর বার্তা

 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত