দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া: নেতৃত্ব, সংগ্রাম ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়
ড. মোহাম্মদ ফয়েজ উদ্দিন
প্রকাশ: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭:৩৬ | আপডেট : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০১:০৩
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস আজ এক গভীর শূন্যতার মুখোমুখি। আমাদের সকলের প্রিয় দেশনেত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান প্রতীক বেগম খালেদা জিয়া আর আমাদের মাঝে নেই। আজ বাংলাদেশ সময় সকাল ৬টায় তিনি ইহলোক ত্যাগ করে পরলোকগমন করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন তাঁর ইন্তেকালে জাতি হারাল এক দৃঢ়চেতা নেতৃত্ব, আর রাজনীতি হারাল এক দীর্ঘ সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি।
বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী এবং মুসলিম বিশ্বের নির্বাচিত নারী সরকারপ্রধানদের অন্যতম পথিকৃৎ। তাঁর জীবন কেবল ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছানোর গল্প নয়; এটি ছিল প্রতিকূলতা, আত্মত্যাগ, রাজনৈতিক দৃঢ়তা ও নেতৃত্বের এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট দিনাজপুর জেলার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন খালেদা জিয়া। তাঁর পিতা মরহুম ইস্কান্দর মজুমদার ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা খালেদা জিয়ার প্রারম্ভিক জীবনে রাজনীতির কোনো প্রত্যক্ষ পরিকল্পনা ছিল না। তবে ইতিহাস তাঁকে ভিন্ন এক পথে নিয়ে যায়। তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে, যিনি ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর ইতিহাসের এক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব।
১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড বেগম খালেদা জিয়ার জীবনে এক গভীর মোড় পরিবর্তন আনে। ব্যক্তিগত শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে তিনি রাজনীতির কঠিন ময়দানে অবতীর্ণ হন। ১৯৮৪ সালে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন এবং ধীরে ধীরে একজন আপসহীন রাজনৈতিক নেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
আশির দশকে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল সাহসী ও দৃঢ়। গ্রেপ্তার, নিপীড়ন ও রাজনৈতিক চাপ সত্ত্বেও তিনি আপস করেননি। ১৯৯০ সালের গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বৈরশাসনের পতন এবং গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠায় তাঁর নেতৃত্ব ছিল ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর নেতৃত্বে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনরায় প্রবর্তিত হয়, যা বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, নারী উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বিশেষ করে নারী শিক্ষা ও গ্রামীণ উন্নয়নে তাঁর সরকারের নীতিমালা উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে।
২০০১ সালে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এই সময়ে অবকাঠামো উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক সংস্কারে তাঁর সরকার নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, মতপার্থক্য ও বিতর্ক তাঁর শাসনামলকে জটিল করে তোলে। তবুও সমর্থকদের কাছে তিনি ছিলেন গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের এক অটল প্রতীক।
বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন ছিল সংগ্রামে ভরপুর। কারাবরণ, অসুস্থতা ও রাজনৈতিক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তিনি কখনোই নেতৃত্বের দাবিতে নীরব হননি। তাঁর জীবন প্রমাণ করে—রাজনীতি কেবল ক্ষমতার বিষয় নয়, এটি আদর্শ, বিশ্বাস ও আত্মত্যাগের নাম।
আজ তাঁর প্রস্থান একটি যুগের অবসান ঘটাল। বেগম খালেদা জিয়া ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন একজন সাহসী নারী নেতা হিসেবে, যিনি কঠিন বাস্তবতার মধ্যেও নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতায়নের এক শক্তিশালী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর জীবন ও কর্ম ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
আল্লাহ তায়ালা তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন। আমিন।
লেখক: ড. মোহাম্মদ ফয়েজ উদ্দিন এমবিই
ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস অর্গানাইজার, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
চেয়ারম্যান, নিউ হোপ গ্লোবাল
বার্মিংহাম, যুক্তরাজ্য
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত