জেমসের কনসার্ট হওয়ার কথা ছিল মেহেরপুরে, তবে অনুমতি দেইনি প্রশাসন

প্রকাশ: ২ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৫৯ | আপডেট : ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ১৭:২৮

প্রশাসনের অনুমতি না পাওয়ায় মেহেরপুরে জেমসের কনসার্ট স্থগিত করা হয়েছে। ‘সূর্য ক্লাব’ নামের একটি ক্লাবের উদ্বোধন উপলক্ষে তারা এ কনসার্টের আয়োজন করে। তবে অনুমতি না মেলায় কনসার্ট স্থগিতের বিষয়টি ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে নিশ্চিত করে ক্লাব কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে জানায়, ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে কনসার্টের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
আগামী ১০ অক্টোবর কনসার্ট হওয়ার কথা ছিল। এদিকে জেমসের কনসার্ট স্থগিত করার খবর ছড়িয়ে পড়লে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুমুল সমালোচনা সৃষ্টি হয়। নেপথ্যে অজানা মুরব্বিদের ইন্ধনের কথা চাউর হয়েছে। তারা কারা মুবব্বি বিষয়টি কেউ পরিষ্কার করতে পারেননি।
তবে ক্লাব কর্তৃপক্ষ বিষয়য়টি নিয়ে উচ্চ আদালতে যাবেন বলে জানিয়েছেন। কনসার্টের আয়োজক ‘সূর্য ক্লাব’-এর সভাপতি নাহিদ মাহবুব সানী এবং সাধারণ সম্পাদক নাসিম রানা বাঁধন জানান, রাজনৈতিক চাপে মুরব্বিদের খুশি করতে না পারায় জেমসের কনসার্টের অনুমতি দেয়নি প্রশাসন। তবে মুরব্বি কারা সে বিষয়ে স্পষ্ট না বললেই তাদের ধারণা, মেহেরপুর জেলা বিএনপির একটি অংশ, এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামীর আপত্তি থাকায় জেমসের কনসার্ট সম্মতি দিচ্ছে না প্রশাসন।
সূর্য ক্লাব’ -এর ক্লাবের সভাপতি নাহিদ মাহবুব সানী বলেন, কনসার্ট-এর অনুমতি না দেওয়ায় এবং আর্থিক ক্ষতিপূরণের জন্য আমরা পূজার পর হাইকোর্টে রিট করব।
‘সূর্য ক্লাব’-এর সাধারণ সম্পাদক নাসিম রানা বাঁধন বলেন, “আমরা জেমসের কনসার্টের অনুমতি চেয়ে ১০ সেপ্টেম্বর মেহেরপুর ডিসি মহোদয়ের কাছে লিখিত আবেদন করি। তিনি আমাদের বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি। মেহেরপুর সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা নেই। আপনাদের অনুষ্ঠানটি যদি পুলিশ প্রশাসন থ্রেট মনে না করে তাহলে কোনো আপত্তি নেই।’ তার থেকে আশ্বাস পাওয়ার পর আমরা মেহেরপুরের ওসি, এসপি, সার্কেল এসপি মহোদয়ের সঙ্গে দেখা করি।
তারাও আমাদের আশ্বস্ত করেন। এসপি মহোদয় বলেন, ‘এটি একটি মহৎ উদ্যোগ। তোমরা এগিয়ে যাও। আমি আমার জায়গা থেকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করব।’ সেই আশ্বাসের ভিত্তিতেই আমরা কার্যক্রম শুরু করি। কিন্তু প্রচারণা চলাকালীন একদিন ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয় আমাদের প্রচার মাইকের অটোচালককে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে নিয়ে যেতে উদ্যত হন। লোকটা হাত-পা ধরে বেঁচে ফেরে। এ ঘটনা শোনার পর আমরাও প্রচারকার্য স্থগিত করি। কিন্তু আবেদনের ১৫ দিন কেটে গেলেও প্রশাসন থেকে হ্যাঁ বা না কিছু জানাচ্ছিল না।”
বাঁধন আরো বলেন, মেহেরপুর জেলা স্টেডিয়ামকে জেমসের কনসার্টের ভেন্যু হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছিল। ভেন্যুকে কেন্দ্র করেই কনসার্টের বিরোধিতা শুরু। তিনি বলেন, ‘আমাদের ভেন্যু ছিল মেহেরপুর জেলা স্টেডিয়াম। কিন্তু দেখলাম কয়েকজন খেলোয়াড়কে উসকে দিয়ে সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবাদ করানো হচ্ছে। তারা স্টেডিয়ামে কনসার্টের ভেন্যুর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন। আমরা ঝামেলায় জড়াতে চাই না বলে বিকল্প ভেন্যু হিসেবে গোভীপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠ ভেবে রাখি। এমনকি আমরা গোভীপুর মাঠ দেখতে যাওয়ার সময় সদর থানার ওসিও আমাদের সাথে ছিলেন।
সাধারণ সম্পাদকের দাবি, ‘আমাদের জেলা ক্রীড়া কমিটির অ্যাডহক কমিটিতে এনসিপির কয়েকজন নেতৃবৃন্দ আছেন। তারা কনসার্টের ব্যাপারে সরাসরি ডিসির কাছে গিয়ে দ্বিমত পোষণ করেন। যার কয়েকটি স্ক্রিনশট আমাদের কাছে রয়েছে।’
বাঁধন জানান এনসিপির ওই নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগসাজশ রয়েছে মেহেরপুরের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা বিএনপির সভাপতি মাসুদ অরুণের ভাই আইনজীবী ও বিএনপি নেতা মারুফ আহমেদ বিজনের। তাকে কনসার্টে প্রধান অতিথি করা হয়নি বলেই বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
‘সূর্য ক্লাব’-এর সাধারণ সম্পাদকের কথায়, ‘বিজন সাহেব আকার-ইঙ্গিতে বোঝাতেন তাকে অতিথি করা হলে কনসার্টে বাধা আসবে না। এর আগে আমরা দুটি কনসার্ট করেছি। সে সময় লক্ষ করেছি তাকে অতিথি করা হলে বাধার সৃষ্টি হয় না। সে কারণে তাকে অতিথি করেই প্রোগ্রামগুলো সামলেছি। কিন্তু জেমসের প্রোগ্রামটি অনেক বড়। আমরাও একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। চাইছিলাম না কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিকে প্রধান অতিথি করতে।’
এবার প্রশাসনের আচরণ তুলে ধরে বাঁধন বলেন, ‘২৫ সেপ্টেম্বরের পর আমরা এসপি মহোদয়ের কাছে গেলে তিনি বলেন, এখনকার বাতাসটা একটু অন্য রকম। আমি যেহেতু এখানে নতুন তাই বুঝতে পারছি না। তোমরা একটু ম্যানেজ করো। আমরা কাকে ম্যানেজ করব জানতে চাইলে তিনি আবার বলেন যে তোমরা ম্যানেজ করো।’
পরে আমরা ডিসি স্যারের কাছে যাই। তাকে না পেয়ে এডিসি মহোদয়ের সঙ্গে দেখা করি। তিনি বলেন, ‘তোমরা কি তোমাদের মুবব্বিদের খুশি করতে পারোনি?’ কোন মুবব্বিদের খুশি করতে হবে জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যান। বলেন, ‘ব্যাপারটি আমার হাতে নেই। এটি ডিসি স্যার ও এসপি মহোদয়ের ওপর নির্ভর করছে।’
কনসার্টে বাধায় এনসিপির জড়িত থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে বাঁধন বলেন, ‘মেহেরপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যে কমিটি ছিল আমি সেই কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলাম। আহ্বায়ক ছিলেন ইমতিয়াজ আহমেদ। কনসার্ট বিষয়ক শেষ সংবাদ সম্মেলনে তিনি আমাদের সঙ্গে ছিলেন। উনিও চেয়েছিলেন প্রোগ্রামটি হোক। কিন্তু সংবাদ সম্মেলনের পর তিনি আমাকে ফোন দিয়ে জানান, তাকে শাকিল (শাকিল আহমেদ) ভাই ভাই ফোন দিয়েছিলেন। ইমতিয়াজ ভাই আমাকে বলেন, ‘মেহেরপুর এনসিপির জেলা সমন্বয়কারী শাকিল আহমেদ ভাই আমাকে ফোন দিয়ে বলেছেন, আমি কেন ওখানে গেছি। মেহেরপুর জামায়াতের লোকজন শাকিল ভাইকে ফোন দিয়ে বলেছেন, তোমরা বলেছ কনসার্টের সঙ্গে তোমরা নেই অথচ ইমতিয়াজকে সংবাদ সম্মেলনে পাঠাচ্ছ। তোমরা আড়ালে ওদের সাথে আছ।’ এরপর শাকিল ভাই ইমতিয়াজ ভাইকে বলেন ফেসবুকে বিবৃতি দিয়ে জানাতে যে এই কনসার্টে পক্ষে কিংবা বিপক্ষে আমরা নেই।’’
বাঁধন বলেন, কনসার্টটি যাতে হয় সে কারণে যার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি সেই সাংবাদিক তুহিন আরন্যর কাছেও গিয়েছি। তিনি বলেছেন, আমিও জেমসের ভক্ত। তাকেও অনুরোধ করি যাতে কনসার্টটি হয় একটু যদি উপরমহলে কাউকে বলা যেত।
বাঁধন বলেন, ‘কনসার্ট নিয়ে শেষবার সংবাদ সম্মেলনের পরের দিন প্রশাসন থেকে আমাদের জানানো হয়, গোয়েন্দা সংস্থার অনাপত্তি পত্র না পাওয়ায় এবং স্টেডিয়ামের অ্যাডহক কমিটির সম্মিলিত সিদ্ধান্ত মোতাবেক এ ধরনের আয়োজনে তারা অনুমতি প্রদান করবে না।’
বাঁধন সবশেষ বলেন, ‘কে বা কারা যে এটা বন্ধ করল, তা আমরা এখনো বুঝতে পারিনি। ফলে এককভাবে কাউকেই দায়ি করতে পারছি না। আমরা যা বলেছি সব অনুমাননির্ভর বলেছি।’
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে মারুফ আহমেদ বিজন বলেন, ‘জেমসের কনসার্ট কারা করছে এ ব্যাপারে কিছুই জানতাম না। কয়েক দিন আগে তিনজন ছেলে এসে আমাার চেম্বারে এসে বলছিল আমি যাতে ডিসি-এসপিকে একটু বলে দিই। আমি বলেছি আমাদের এখন তারা বিরোধী দল মনে করে, তাদের সাথে আমাদের ভালো সম্পর্ক নেই। এমনকি আমি বললে তারা অনুমতিই দেবে না হয়তো।’
এনসিপির মেহেরপুর জেলা সমন্বয় কমিটির সদস্য ইমতিয়াজ আহমেদ কনসার্টের প্রথম থেকেই সূর্য ক্লাবের সাথে ছিলেন বলে বাঁধন দাবি করলেও তা অস্বীকার করেন ইমতিয়াজ। তিনি বলেন, তারা হঠাৎ করে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করলে আমি সেখানে উপস্থিত হই। পরে এনসপির জেলা সমমন্বয়ক শাকিল ভাই ফোনে আমাকে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিতে বললে, কোনো পক্ষেই আমার অবস্থান নেই বলে স্ট্যাটাস দিয়েছি।’
মেহেরপুর জেলা জামায়াতের আমির তাজ উদ্দিন আহমেদের সাথে যোগাযোগ করে না পাওয়া গেলে কথা হয় সেক্রেটারি ইকবাল হোসেনের সাথে। তিনি বলেন, ‘একবার শুনলাম জেমসের কনসার্ট হচ্ছে, আরেবকবার শুনলাম প্রশাসন অনুমতি দেয়নি বলে বন্ধ করা হয়েছে। তবে জেলা জামায়াতের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো আলাপ-আলোচনা হয়নি। এমনকি প্রশাসন থেকেই কেউ কিছু জানতে চায়নি।’ অভিযোগের প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, আমাদের নামের দোষ।
মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) ড. মোহাম্মদ আব্দুল ছালাম বলেন, জেমসের কনসার্টকে ঘিরে অনেক লোকসমাগম হবে, যার ফলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিঘ্ন ঘটতে পারে এ আশঙ্কায় অনুমতি দেওয়া হয়নি। তবে জেলা প্রশাসন থেকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, কোর কমিটির সিদ্ধান্ত এবং গোয়েন্দা সংস্থার অনাপত্তি না থাকায় কনসার্ট অনুমোদন দেওয়া গেল না।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত