প্রিয় নায়িকা কবরীর মহাপ্রয়াণ

  বিপুল কৃষ্ণ দাস

প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল ২০২১, ০৯:১২ |  আপডেট  : ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:২৯

আজ করোনা যুদ্ধে পরাজিত চিত্র নায়ীকা কবীর মৃত্যুর সংবাদ শুনে বাইশ বছর আগের একটি পুরনো ঘটনার কথা স্মৃতিকে নাড়া দিয়ে গেল। 

আমি তখন মুম্বাইতে। এক বিকেলে পালি হিলের একটি হোটেল থেকে বেরিয়ে ইকবাল ভাইয়ের সাথে রাস্তায় হাঁটছিলাম। হঠাৎ আমাদের সামনে একটি গাড়ি এসে দাঁড়ালো। ইকবাল ভাইয়ের বিশেষ পরিচিত, বন্ধু স্থানীয়নায়ক একজন গাড়ির উইণ্ডো খুলে ডাকলেন। আমিও সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। নায়ক প্রসেনজিতের পিতা বিশ্বজিৎ! 

ইকবাল ভাই আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বেশ কিছুদিন পর প্রাণ খুলে বাংলায় কথা বলতে পেরে আমিও মহা খুশি। আড্ডা জমে উঠলো। আমার হিন্দী জগাখিচুরি অবিস্থা। এই ক'দিন ইংরেজি হিন্দি মিলিয়ে ককটেল ভাষায় কথা বলতে বলতে আমি হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। বিশ্বজিতের আলোচনার বিষয় ঘুরে ফিরে বাংলাদেশ। তাঁর সেই দিনের স্মৃতিচারণের সিংহভাগ জুড়ে ছিল অভিনেতা গোলাম মোস্তফা ও নায়িকা কবরীর কথা। তাঁদের সঙ্গে নায়ক বিশ্বজিতের বিশেষ বিশেষ মুহূর্ত, এবং বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা কথা বলেছেন। বলেছেন, "কবরী এবং গোলাম মোস্তফাকে অবশ্যই আমার শুভেচ্ছা বার্তা পৌঁছে দেবেন। তাঁদের স্মরণ করিয়ে দেবেন আমারে এই স্মৃতি কথা।"

বাংলাদেশ স্বাধীনতার হওয়ার পরে "রক্তাক্ত বাংলা : যুদ্ধদিনের ছবি" মুক্তি পায়। ছবিতে শাহেদের চরিত্রে  নায়ক বিশ্বজিৎ এবং সন্ধ্যা চরিত্রে কবরী অভিনয় করেন। মাসুদ চরিত্রে অভিনয় করেছেন গোলাম মুস্তাফা। সেই সময়ের কথা বলতে বলতে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছিলেন নায়ক বিশ্বজিত। বিশ্বজিতের সেই দিনের সেই কথাগুলো ধারণ করতে না পেরে আজ নিজেকে খুব লজ্জিত মনে হচ্ছে। দীর্ঘকাল পর নায়িকা কবরী সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়নও আজ আমার স্মৃতিতে ধোঁয়াশা।

সেই যোগাযোগ  আর হয়ে ওঠেনি কোনদিন। তাঁদের কাছে পৌঁছাতে পারিনি নায়ক বিশ্বজিতের সেই বার্তা। খ্যাতিমান অভিনেতা গোলাম মুস্তাফা লোকান্তরিত হয়েছেন ২০০৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। আর আজ প্রয়াত হলেন নায়ক বিশ্বজিতের কাছের মানুষ, প্রিয়জন নায়িকা কবরী।

দ্বিতীয় ঘটনাটিতে প্রথম ঢাকা দর্শন এবং প্রথম সিনেমা দেখার সূত্রে নায়িকা কবিরীর সাথে পরিচয়। বলা বাহুল্য, ঢাকা শহরে আমাদের কোনো আত্মীয়-স্বজন ছিলো না। যে কারণে রাজধানী ঢাকা শহর দেখা হয়নি। বন্ধুদের কাছে ঢাকার গল্প শুনি। সিনেমার গল্প। রাজ্জাক-কবরী, ববিতা সাবানার নামও বন্ধুদের কাছে শুনা। তারপর একদিন ঢাকা শহর দেখার স্বপ্নও পূরণ হয়। আমার জামাইবাবু লৌহজংয়ের ওষুধ ব্যবসায়ী, "সোমেন ব্রাদার্স" কর্ণধার সুধীর দাস তখন প্রতি সপ্তাহে ঢাকা যেতেন অসুধ কিনতে। সেবার আমাকে এবং ভাগিনা কমলকে নিয়ে গেলেন ঢাকায়। আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। সম্ভবতঃ ১৯৭৮ সালের কথা।

লঞ্চে দীর্ঘসময়-- ডহরি হয়ে ঢাকার সদরঘাট পৌঁছলাম। জীবিনের প্রথম ঢাকা শহর দেখার সেই রোমাঞ্চকর দিনের কথা এখনো উজ্জ্বল হয়ে আছে স্মৃতিতে। 

জামাই বাবু শংকর বোর্ডিংয়ে আমাদের খাইয়ে-দাইয়ে শীতাতপ নিয়ত্রিত মুন সিনেমা হলে ঢুকিয়ে দিয়ে তিনি চলে যান মিডফোর্ড। সেটাই ছিল জীবনের প্রথম হলে বসে সিনেমা দেখা। ছবির নাম "সারেং বৌ।" ফারুক-কবরী। শহীদুল্লাহ কায়সারের উপন্যাস অবলম্বনে রচিত চিত্রনাট্য, পরিচালক, আবদুল্লাহ আল মামুন। 

সেই প্রথম দেখা সিনেমার নায়িকা কবরী। তার পর থেকে কবরীর অসংখ্য ছবি দেখেছি। মুগ্ধতার ঘোর কাটেনি। পাশাপাশি অনেক সিনেমাই দেখেছি,  সেখানে অনেক বৈচিত্র্য ছিল। ভালো লেগেছে। কিন্তু কবরী থেকে আর কোনদিন বেরিয়ে আসতে পারিনি। বাংলা চলচ্চিত্রে কবরী এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। অভিনয় জগতে ও সংস্কৃতি অঙ্গনে তার অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

 'সুতরাং’ দিয়ে আবির্ভাব। বরেণ্য পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ চলচ্চিত্রে কাজ করে খ্যাতি। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। স্বনামধন্য অভিনেত্রী কবরী বাংলা চলচিত্রের অমূল্য সম্পদ হয়ে রয়ে গেলেন। শুধু অনিবার্য নিয়মের দাসত্ব মেনে নেয়াটাই মৃত্যু।

"ছেমড়ি, তোর মুখখান যে কত বড় সম্পদ তা তুই নিজেও জানস না। " কথাটা কবরীকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন কিংবদন্তীতুল্য চিত্রনির্মাতা ঋত্বিক কুমার ঘটক। 

ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে তাঁর সম্পর্কে 'দ্য ডেইলি স্টার' পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে কবরী বলেছেন, "ঋত্বিক দা’র প্রতিটি ফ্রেম এক একটি শিল্পকর্ম। অনেক কিছু শিখেছি এবং আত্মবিশ্বাসও জন্মেছে। কাজ করার সময় বুঝতে পারিনি। যখন সিনেমা হলে ছবিটা দেখেছি, তখন দেখলাম একটি মালো জাতির সুখ-দুঃখের যে মানবিক দলিল চিত্রায়ন হতে পারে সিনেমায় তিনি তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। এক বিশাল ক্যানভাসকে তিনি আড়াই ঘণ্টার ছবির মধ্যে নিয়ে এসেছেন।"

যাঁদের হাত ধরে বাংলা চলচ্চিত্রের সাবালক হয়েছে,  সেই কিংবদন্তিতুল্য নির্মাতা ঋত্বিক ঘটক, -- তাঁর নায়িকা কবরীর আজ মাহাপ্রয়াণ।  বাংলা চলচ্চিত্র হারালো তার চিরকালীন বাঙালি নারীর প্রতিচ্ছায়া কবরীকে। 

প্রিয় নায়িকা কবরীর মহাপ্রয়াণে শোকস্তব্ধ। করোনার অতিমারীতে অনেক আত্মীয়, বিশিষ্ট জন, বন্ধুবান্ধব হারিয়েছি। আজ মৃত্যুর মহামিছিলে শামিল হলেন প্রিয় নায়িকা কবরী। এই মৃত্যু-মিছিল কোথায় গিয়ে শেষ হবে জানি না।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত