পাঠ্যবই সরবরাহে সংকট কাটবে কবে?
প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৪৩ | আপডেট : ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১৬:২৪
শিক্ষা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়েছে গত ১ জানুয়ারি। তবে এখনও বেশিরভাগ শিক্ষার্থী পাঠ্যবই পায়নি। এই পরিস্থিতিতে অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন। কারণ পাঠ্যবই না থাকায় শিক্ষার্থীদের পড়ার টেবিলে বসানো যাচ্ছে না।
পরিস্থিতি বিবেচনায় ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের প্রথম থেকে নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যবই চলতি জানুয়ারির মধ্যেই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছাতে চায় সরকার। এনসিটিবি জানায়, জানুয়ারির মধ্যে পাঠ্যবই সরবরাহ করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে মুদ্রণ মালিকরা বলছেন, চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। কতটুকু দেওয়া সম্ভব তা নির্ভর করছে কাগজ ও ছাপা শেষ হওয়ার ওপর।
সব পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানোর বিষয়ে গত ১৩ জানুয়ারি শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘ফেব্রুয়ারির মধ্যে শিক্ষার্থীরা সব পাঠ্যবই হাতে পাবে’।
এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের প্রথম থেকে নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যবই চলতি জানুয়ারির মধ্যেই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানো হবে। আর এ লক্ষ্যে মুদ্রণ মালিকদের সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
কিন্তু জানুয়ারির মধ্যে সব পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানো নিয়ে এখনও অনিশ্চয়তা কাটছে না। মুদ্রণ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেরিতে টেন্ডার আহ্বান করার কারণে মুদ্রণ মালিকদের শত চেষ্টার পরও সরকারের চাহিদা মতো সময়ে পাঠ্যবই সরবরাহ করা যাচ্ছে না।
যে কারণে পাঠ্যবই সরবরাহে সংকট
প্রথম দফা টেন্ডারের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির পাঠ্যবই সরবরাহের জন্য মুদ্রণ মালিকদের শেষ সময় ছিল গত ২১ জানুয়ারি। দ্বিতীয় দফায় মুদ্রণ মালিকদের প্রথম শ্রেণির পাঠ্যবই সরবরাহের শেষ সময় রয়েছে আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি। একইভাবে মুদ্রণ মালিকদের চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যবই সরবরাহের নির্ধারিত সময় ছিল ১৬ জানুয়ারি।
প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণি: সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে ২০২৪ সালের ৮ মে, টেন্ডার উন্মুক্ত করা হয় ২০ জুন, নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড (নোয়া) দেওয়া হয় ১৪ অক্টোবর। আর চুক্তির শেষ সময় ১১ নভেম্বর এবং বই সরবরাহের সময় দেওয়া ছিল ৭০ দিন। প্রথম ৪০ দিনের মধ্যে ৫০ শতাংশ এবং পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে শতভাগ বই দেওয়ার কথা রয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী প্রাথমিকের প্রথম টেন্ডারের পাঠ্যবই সরবরাহ করার নির্ধারিত সময় শেষ হয়েছে ২১ জানুয়ারি।
প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির দ্বিতীয় টেন্ডার আহ্বান করা হয় ১৭ অক্টোবর। টেন্ডার ওপেন করা হয় ২৮ অক্টোবর, নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয় ৯ ডিসেম্বর, চুক্তি করার শেষ সময় ২০২৫ সালের ৬ জানুয়ারি। বই সরবরাহের সময় ৪০ দিন। ৫০ শতাংশ প্রথম ২৫ দিনে আর পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে বাকি বই।
চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি: টেন্ডার হয় ২৬ সেপ্টেম্বর, টেন্ডার ওপেন করা হয় ৭ অক্টোবর, নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয় ৯ ডিসেম্বর। চুক্তির শেষ সময় ২০২৫ সালে ৬ জানুয়ারি। বই সরবরাহের সময় ৪০ দিন। অর্থাৎ সব বই সরবরাহের শেষ সময় ১৬ জানুয়ারি।
ষষ্ঠ শ্রেণি: ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের জন্য টেন্ডার হয় ৩০ সেপ্টেম্বর, টেন্ডার ওপেন করা হয় ২০ অক্টোবর, নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয় ২৫ নভেম্বর, চুক্তি করার শেষ সময় ২৩ ডিসেম্বর। বই ছেপে সরবরাহের সময় ৪০ দিন। প্রথম ২৫ দিনে ৫০ শতাংশ এবং পরবর্তী ১৫ দিনে বাকি ৫০ শতাংশ। সেই হিসেবে মুদ্রণ মালিকদের পাঠ্যবই সরবরাহের শেষ সময় ৫ ফেব্রুয়ারি।
সপ্তম শ্রেণি: টেন্ডার হয় ২ অক্টোবর, টেন্ডার ওপেন হয় ২০ অক্টোবর আর নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয় ২৫ নভেম্বর এবং চুক্তির শেষ সময় ২৩ ডিসেম্বর। বই সরবরাহের সময় ৪০ দিন। প্রথম ২৫ দিনে ৫০ শতাংশ এবং পরবর্তী ১৫ দিনে বাকি ৫০ শতাংশ। সেই হিসেবে মুদ্রণ মালিকদের বই সরবরাহের শেষ সময় ৫ ফেব্রুয়ারি।
অষ্টম শ্রেণি: টেন্ডার হয় ১৬ অক্টোবর, টেন্ডার ওপেন করা হয় ২৮ অক্টোবর, নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয় ৯ ডিসেম্বর, চুক্তির শেষ সময় ৬ জানুয়ারি। বই সরবরাহের সময় ৪০ দিন। প্রথম ২৫ দিনে ৫০ শতাংশ এবং পরবর্তী ১৫ দিনে বাকি ৫০ শতাংশ। সেই হিসেবে মুদ্রণ মালিকদের বই সরবরাহের শেষ সময় ১৬ ফেব্রুয়ারি।
নবম শ্রেণি: টেন্ডার হয় ২৪ নভেম্বর, টেন্ডার ওপেন করা করা হয় ৫ ডিসেম্বর, নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয় ১৯ ডিসেম্বর, চুক্তির শেষ সময় ১৬ জানুয়ারি। বই সরবরাহের সময় ৪০ দিন। প্রথম ২৫ দিনে ৫০ শতাংশ এবং পরবর্তী ১৫ দিনে বাকি ৫০ শতাংশ। সেই হিসেবে মুদ্রণ মালিকদের পাঠ্যবই সরবরাহের শেষ সময় ২৬ ফেব্রুয়ারি।
দশম শ্রেণি: দশম শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপতে টেন্ডার আহ্বান করা হয় ১৩ নভেম্বর, টেন্ডার ওপেন করা হয় ২৫ নভেম্বর, নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয় ১৯ ডিসেম্বর। চুক্তির শেষ সময় ১৬ জানুয়ারি এবং বই সরবরাহের সময় ৪০ দিন। প্রথম ২৫ দিনে ৫০ শতাংশ এবং পরবর্তী ১৫ দিনে বাকি ৫০ শতাংশ। সেই হিসেবে মুদ্রণ মালিকদের পাঠ্যবই সরবরাহের শেষ সময় ২৬ ফেব্রুয়ারি।
শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন পাঠ্যপুস্তক (ফাইল ছবি)
শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন পাঠ্যপুস্তক (ফাইল ছবি)
বই সরবরাহের সর্বশেষ পরিস্থিতি
রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত প্রি-প্রাইমারির বই পায়নি শিক্ষার্থীরা। বছর শুরুর দিন প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত সব বই শিক্ষার্থীরা পেয়েছে। আর ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত রাজধানীর বেশির ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চতুর্থ শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি ও গণিতসহ চারটি বই পেয়েছে। পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বাংলা, ইংরেজি ও গণিতসহ ছয়টি বই পেয়েছে। নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বাংলা, ইংরেজি ও গণিত এবং দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বাংলা, ইংরেজি ও গণিতসহ ছয়টি বই পেয়েছে। এছাড়া অন্য ক্লাসের কিছু বই পেয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। কবে নাগাদ বাকি বই পাওয়া যাবে তার নিশ্চয়তা দিতে পারেনি প্রতিষ্ঠানগুলো।
ডিসেম্বর মাসে এনসিটিবি জানিয়েছিল, শিক্ষার্থীদের হাতে বছরের প্রথম দিন বই দেওয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আর্মি প্রিন্টিং প্রেস থেকে মাধ্যমিকের এক কোটি বই ছেপে নেওয়া হয়েছে ডিপিএম পদ্ধতিতে। তবে নবম ও দশম শ্রেণির বই ছাপার কাজ শুরু করতে হয় ডিসেম্বরের শেষ সময়ে। ফলে শিক্ষার্থীদের হাতে কিছু বই জানুয়ারি শুরুর দিকে দিতে পারলেও সব বই জানুয়ারিতে দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন মুদ্রণ মালিকরা।
এনসিটিবির বক্তব্য
পাঠ্যবই কবে নাগাদ দেওয়া সম্ভব হবে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, ‘২৫ জানুয়ারি মধ্যে পঞ্চম শ্রেণির বই যাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। দশম শ্রেণির সব বই চলে যাবে ২৭-২৮ জানুয়ারির মধ্যে। তাহলে তো ৫০ শতাংশ বই চলে গেলো। বাকি বইগুলো পরবর্তী ১৫-২০ দিনের মধ্যে চলে যাবে।’
সরবরাহ করা হবে ৪০ কোটি বই
এনসিটিবি জানায়, এবার মোট বইয়ের সংখ্যা ৪০ কোটির মতো। এর মধ্যে মাদ্রাসার এবতেদায়ি এবং মাধ্যমিক স্তরের জন্য প্রায় দুই কোটি ৩১ লাখ এবং প্রাথমিক স্তরের জন্য ৯ কোটির বেশি। ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমে (২০১৩ সাল থেকে পাঠ্যবই) ফেরত যাওয়ায় মাধ্যমিকের বইয়ের সংখ্যা এবার বেশি। কারণ স্থগিত হওয়া নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতি শ্রেণিতে একজন শিক্ষার্থীকে ১৪টি করে বই পড়তে হতো। আর ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ২২টি করে এবং নবম-দশম শ্রেণিতে একজন শিক্ষার্থীর বিপরীতে ৩৩টি করে বই ছাপতে হতো। এর মধ্যে শিক্ষার্থীদের পড়তে হতো ১৪টি করে পাঠ্যবই। এসব কারণেও পাঠ্যবই পৌঁছানোর ক্ষেত্রে দেরি হচ্ছে।
সঠিক সময়ে বই পৌঁছানোর বিষয়ে জানতে চাইলে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি ও বিপণন সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, ‘দেরিতে কাজ পাওয়ার কারণে সরকারের প্রত্যাশিত সময়ে পাঠ্যবই দিতে পারেনি মুদ্রণ মালিকরা। অনেকের জানুয়ারি পর্যন্ত এবং আরও পরেও সরবরাহের সুযোগ রয়েছে। তাহলে বছরের শুরুতে কীভাবে বই দেবে এনসিটিবি?’
সৌজন্যে : বাংলা ট্রিবিউন
কা/আ
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত