খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থাপনা থেকে গুণীজনদের নাম বাদ দেওয়ায় তীব্র প্রতিক্রিয়া

  খুলনা প্রতিনিধি

প্রকাশ: ৪ মার্চ ২০২৫, ১১:৫৮ |  আপডেট  : ৫ মার্চ ২০২৫, ২৩:৪২

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

 

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) বিভিন্ন স্থাপনা থেকে প্রখ্যাত রসায়নবিদ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জীববিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, পদার্থ বিজ্ঞানী ও শিক্ষক সত্যেন্দ্রনাথ বসু, কবি জীবনানন্দ দাশসহ গুণীজনদের নাম বাদ দেওয়ায় তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ খুলনার সাধারণ মানুষ এ বিষয়টি মেনে নিতে পারছেন না। তারা বলছেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় গুণীজনদের নাম স্থাপনা থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি।

জানা গেছে, ২০১৬ সালের ২২ অক্টোবর তৎকালীন উপাচার্য ফায়েক-উজ-জামানের সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের সভায় ১৯টি ভবন ও স্থাপনার নতুন নামকরণ করা হয়। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর গত বছরের ২৮ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কার ও অধিকার আদায়ে ৩৭ দফা দাবি উত্থাপন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সেসব দাবির মধ্যে অন্যতম ছিল ক্যাম্পাসের সব স্থাপনা থেকে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নাম বাদ দেওয়া।

জানা যায়, শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত ৪ ডিসেম্বর হল ও বিভিন্ন ভবনের নতুন নামকরণ প্রস্তাবনা কমিটি গঠন করে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। গত ৮ ডিসেম্বর ওই কমিটি রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট নামসংবলিত হল ও ভবনের নতুন নাম প্রস্তাবের জন্য শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। বিজ্ঞপ্তিতে শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা হল, জয় বাংলা ভবন, সুলতানা কামাল জিমনেসিয়াম, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ প্রশাসনিক ভবন ও শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভবনের নাম পরিবর্তন প্রস্তাব হয়। ৮ ফেব্রুয়ারি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় নতুন নামকরণের অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে ১২ ফেব্রুয়ারি নাম পরিবর্তনসংক্রান্ত অফিস আদেশ জারি করা হয়।

আদেশে সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রশাসনিক ভবনের নাম পরিবর্তন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য গোলাম রহমানের নামে রাখা হয়। এ ছাড়া সত্যেন্দ্রনাথ বসু একাডেমিক ভবনের নাম একাডেমিক ভবন-১, জগদীশচন্দ্র বসু একাডেমিক ভবনের নাম একাডেমিক ভবন-২, কবি জীবনানন্দ দাশ একাডেমিক ভবনের নাম একাডেমিক ভবন-৩, জয় বাংলা ভবনের নাম একাডেমিক ভবন-৪, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের নাম বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন হল, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের নাম বিজয়-২৪ হল, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ প্রশাসনিক ভবনের নাম প্রশাসনিক ভবন, লালন সাঁই মিলনায়তনের নাম টিএসসি ভবন, শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরী চিকিৎসাকেন্দ্রের নাম খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টার, সুলতানা কামাল জিমনেসিয়ামের নাম খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় জিমনেসিয়াম এবং আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় কেন্দ্রীয় গবেষণাগারের নাম খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গবেষণাগার করা হয়। শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা আবাসিক ভবনের নাম প্রফেসরস কোয়ার্টার, শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. সুখরঞ্জন সমাদ্দার আবাসিক ভবনের নাম অ্যাসোসিয়েট প্রফেসরস কোয়ার্টার, শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব আবাসিক ভবনের নাম অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসরস কোয়ার্টার এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী এস এম এ রাশিদুল হাসান আবাসিক ভবনের নাম লেকচারার্স কোয়ার্টার রাখা হয়েছে। স্থাপনা থেকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের নাম বাদ দেওয়া হয়নি।

শিক্ষকরা বলেন, ১৯৯১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকারের সময় কোনো স্থাপনাই রাজনৈতিক ব্যক্তির নামে হয়নি। ২০১৬ সালে এই ধারার ছন্দপতন ঘটান তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ফায়েক-উজ-জামান। ওই সময় ছাত্রদের নতুন হল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ছাত্রীদের নতুন হল বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের নামে করা হয়। দ্বিতীয় দফায় অধ্যাপক ফায়েক-উজ-জামান ২০১৬ সালের ২২ অক্টোবর সিন্ডিকেটের ১৮৮তম সভায় ১৯টি ভবন ও স্থাপনার নতুন নামকরণের সিদ্ধান্ত নেন। তখন একাডেমিক ভবন-১-কে ড. সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামে, একাডেমিক ভবন-২-কে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর নামে, একাডেমিক ভবন-৩ কবি জীবনানন্দ দাশের নামে, নির্মাণাধীন ১০ তলা চতুর্থ একাডেমিক ভবনকে জয় বাংলা ভবন, প্রশাসনিক ভবনকে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের নামে এবং পুরনো প্রশাসনিক ভবন সৈয়দ নজরুল ইসলামের নামে করা হয়। এ ছাড়া টিএসসিকে লালন সাঁই মিলনায়তন, অতিথি ভবনকে মাইকেল মধুসূদনের নামে, কেন্দ্রীয় গবেষণাগারকে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের নামে, মেডিকেল সেন্টারকে শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীর নামে, জিমনেশিয়ামকে সুলতানা কামালের নামে, আইইআর ভবনকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে, আবাসিক ভবনগুলোর মধ্যে প্রফেসরস কোয়ার্টারকে শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার নামে, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসরস কোয়ার্টারকে শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. সুখরঞ্জন সমাদ্দারের নামে, অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসরস কোয়ার্টারকে শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব এবং লেকচারারস কোয়ার্টারকে শহীদ বুদ্ধিজীবী এস এম এ রাশিদুল হাসানের নামে করা হয়। চতুর্থ একাডেমিক ভবন, টিএসসি ও জিমনেশিয়ামের কাজ তখন শুরুই হয়নি।

সূত্রটি জানায়, গণ-অভ্যুত্থানের পর গত ২৮ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কারে ৩৭ দফা দাবি উত্থাপন করেন শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ক্যাম্পাসের সব স্থাপনা থেকে রাজনৈতিক ব্যক্তির নামবদল।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন খুলনা মহানগরের সদস্যসচিব জহুরুল তানভীর এর প্রতিক্রিয়ায় ফেসবুকে লিখেন, ‘মাথাব্যথা করতেছে, তাই মাথাটাই কেটে ফেললাম—এই হলো খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবনের নাম পরিবর্তনের অবস্থা!’

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. এস এম মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘ছাত্রদের দাবির মুখে অধ্যাপক ড. এ টি এম জহির উদ্দিনকে প্রধান করে কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি গত ১২ ডিসেম্বর গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে নামের প্রস্তাব চায়। এরপর কমিটির প্রস্তাব বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে উত্থাপন করা হলে তারা সেটির অনুমোদন দিয়েছে। পরে গত ১২ ফেব্রুয়ারি অফিস আদেশ জারি করা হয়।’

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) খুলনার সাবেক সভাপতি অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, ‘এটা খুবই নিম্ন মানসিকতা ও নিম্ন রুচির পরিচয়। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের এ ধরনের মানসিকতা চিন্তায়ও আসে না।’

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ডিসিপ্লিনের শিক্ষার্থী আয়মান আহাদ বলেন, ‘যেসব ভবন বা স্থাপনা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নামে সেগুলো পরিবর্তন করার জন্য শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল। কিন্তু অরাজনৈতিক ব্যক্তির নামে থাকা ভবনের নামও পরিবর্তন করা হয়েছে, যা শিক্ষার্থীরা ভালোভাবে গ্রহণ করেননি।’

নাম পরিবর্তন কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক এ টি এম জহিরউদ্দিন বলেন, ‘ছাত্রদের দাবির প্রেক্ষিতে কমিটি করা হয়। দাবি ছিল পলিটিক্যালি বায়াসড নামগুলো পরিবর্তন করা। শুধু ওই নামগুলো পরিবর্তনের বিষয়ে নতুন নামের প্রস্তাব চেয়ে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যে নামগুলো পেয়েছিলাম, সেগুলো শুধু কম্পাইল (সংকলন) করে কর্তৃপক্ষের কাছে দিয়েছি।’

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক মো. মুজিবর রহমান বলেন, ‘হল ও বিভিন্ন ভবনের নতুন নামকরণ প্রস্তাবনা কমিটি যে রিপোর্ট দিয়েছে, সিন্ডিকেটের সদস্যরা কোনো অভিমত-অভিপ্রায় ব্যক্ত না করে শুধু সেটি পাস করেছেন। সিন্ডিকেট থেকে নতুন করে কিছু চাপিয়ে দেওয়া হয়নি।’

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘আমরা আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে গেছি। ছাত্রদের দাবি ছিল এগুলো। তাদের লিখিত দাবির বিষয়ে একটা কমিটি করা হয়, এটা একক কোনও সিদ্ধান্ত না। আমরা আলোচনার দ্বার উন্মুক্ত রেখেছি।’

কা/আ 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত