ইতিহাস গড়া জোহরান মামদানির ‘বাংলা-প্রীতি’, নেপথ্যে কী?

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৭ জুন ২০২৫, ১১:০৭ |  আপডেট  : ২৭ জুন ২০২৫, ১৫:১৪

ডেমোক্রেটদের প্রাইমারিতে জেতার পর মা ও বাবার সঙ্গে জোহরান মামদানি

বিবিসি: নিউ ইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনের জন্য ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাইমারিতে দলের মনোনয়ন জিতে নিয়ে মার্কিন রাজনীতিতে হইচই ফেলে দিয়েছেন জোহরান কে মামদানি। মূলত ইংরেজি ভাষাভাষী হলেও ৩৩ বছরের এই মার্কিন যুবকের সঙ্গে রয়েছে বাংলারও সংযোগ। যার প্রমাণ মিলেছে ভোটের প্রচারণার সময় বিভিন্ন ভাষার সঙ্গে বাংলায় তৈরি তার একটি ভিডিও ক্যাম্পেইন।

সেই ভিডিওতে লিটল বাংলাদেশ কেনসিংটনের বাঙালি কাউন্সিল মেম্বার শাহানা আরিফকে সঙ্গে নিয়ে তাকে ভাঙা ভাঙা বাংলায় ‘র‍্যাংক চয়েস ভোটিং’ পদ্ধতিটা সাধারণ ভোটারদের কাছে বাঙালি মিষ্টির প্লেট নিয়ে ব্যাখ্যা করতেও শোনা গেছে।

ভিডিওর শেষ দিকে এসে হাসতে হাসতে মামদানি বেশ ঝরঝরে ভঙ্গিতেই শাহানা আরিফকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আমার বাংলা ভালোই, না?’ জবাবে শাহানা একটু ইতস্তত করে বলেন, ‘খারাপ না!’

এই চমকজাগানো ক্যাম্পেইন যে নিউ ইয়র্কের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ভোটারদের আকৃষ্ট করতেই, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।সেই সঙ্গে ভারতীয় অরিজিনের মামদানি যে হিন্দি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাতেও মোটামুটি কথাবার্তা বলতে পারেন, এটা অনেককেই অবাক করেছে।

নিউ ইয়র্কে জ্যাকসন হাইটস-সহ বাংলাদেশি অধ্যুষিত বিভিন্ন এলাকায় প্রচারের সময় তাকে বাঙালি ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গেও হালকা-পাতলা বাংলায় কথা বলতেও দেখা গেছে।

ডেমোক্রেটিক প্রাইমারিতে হেভিওয়েট প্রার্থী অ্যান্ড্রু কুয়োমোকে হারিয়ে নিজের মনোনয়ন (খুব সম্ভবত মেয়র পদও) নিশ্চিত করার পর মামদানি যে ‘অ্যাকসেপ্টেন্স স্পিচ’ দিয়েছেন, তাতেও কিন্তু এই সাফল্যে ‘বাংলাদেশি আন্টি’দের ভূমিকার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে ভোলেননি!

অনেকেই হয়তো ভাবছেন, জোহরান মামদানির এই বাংলা-প্রীতি কি শুধু ভোটের জন্যই– নাকি এর পেছনে অন্য কারণও আছে?

এক কথায় এর সহজ উত্তর হলো, মামদানির বাংলা কানেকশনের পেছনে সবচেয়ে বড় ‘ক্যাটালিস্ট’ হলেন তার মা– আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রপরিচালক মীরা নায়ার।

মীরা নায়ারের জন্ম ভারতের ওড়িশার বাঙালি অধ্যুষিত শহর রাউরকেল্লাতে। আর তিনি বড় হয়েছেন রাজধানী ভুবনেশ্বরে। সেখানেও জনসংখ্যার একটা বড় অংশ বাঙালি।

মীরা নায়ারের ঝলমলে ফিল্মোগ্রাফিতে খুব উজ্জ্বল একটা নাম হলো ‘নেমসেক’ – যেটা তিনি তৈরি করেছিলেন বাঙালি পরিবারের আমেরিকান লেখিকা, পুলিৎজার-জয়ী ঝুম্পা লাহিড়ির লেখা উপন্যাস অবলম্বনে।

সেই সিনেমাটাও ছিল আবার আমেরিকায় পাড়ি দেওয়া এক প্রথম প্রজন্মের অভিবাসী বাঙালি দম্পতিকে নিয়েই। এ সিনেমাটা বানাতে ছেলে জোহরানই যে তাকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন, সেটাও তিনি পরে একাধিকবার জানিয়েছেন।

মীরা নায়ার ও তার সিনেমা, সংস্কৃতি

ভারতীয় চিত্রপরিচালক মীরা নায়ার আর উগান্ডা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আসা ভারতীয় বংশোদ্ভুত লেখক-শিক্ষাবিদ মাহমুদ মামদানি দম্পতির একমাত্র সন্তান হলেন জোহরান কে মামদানি।

বাবার দিক থেকে তার বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয়ের কোনো সুযোগ না থাকলেও মা মীরা নায়ার যে সেটা কড়ায়-গন্ডায় পুষিয়ে দিয়েছেন, সটা মেনে নেওয়ার যথেষ্ঠ কারণ আছে।

সিভিল সার্ভেন্ট বাবা ও সমাজকর্মী মায়ের কন্যা মীরা নায়ারের জন্ম, বেড়ে ওঠা ও স্কুলের পড়াশুনা বাংলা লাগোয়া ওড়িশাতেই। সেখানে তার অনেক বাঙালি বন্ধুবান্ধবও ছিল। তার নিজের গানের শিক্ষকও ছিলেন একজন বাঙালি।

তিনি যে ভালো বাংলা বোঝেন এবং বলতেও পারেন– কলকাতায় প্রায় দুই যুগ আগে এক অনুষ্ঠানের দর্শকরাই তার সাক্ষী।

১৯৮৮ সালে মুক্তি পাওয়া মুম্বাইয়ের পথশিশুদের নিয়ে তৈরি ‘সালাম বোম্বে সিনেমার সূত্র ধরেই মীরা নায়ার আন্তর্জাতিক পরিচিতি পান। সেরা বিদেশি সিনেমার ক্যাটাগরিতে সালাম বোম্বে সেবার অস্কার, বাফটা ও গোল্ডেন গ্লোব– সবগুলো অ্যাওয়ার্ডেই নমিনেশন পায়।

ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘গোল্ডেন লায়ন’ ও কানে ‘ক্যামেরা ডি’ওর’ জেতা এই পরিচালক ‘মিসিসিপি মসালা’ ও ‘মনসুন ওয়েডিং’-এর মতো অনেক কাল্ট মুভিও বানিয়েছেন– তবে বাঙালি দর্শক তাকে মনে রেখেছে মূলত নেমসেক সিনেমার জন্যই!

বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি মীরা নায়ার যে অন্যরকম একটা টান অনুভব করেন, তিনি সেটাও জানিয়েছেন বিভিন্ন সাক্ষাৎকারেই।

‘এবিসিডি’ প্রজন্মের হয়েও ব্যতিক্রমী?

অথচ ‘নেমসেক’ সিনেমাটি হয়তো মীরা নায়ারের বানানোই হতো না– যদি না এর পেছনে তার কিশোর ছেলে জোহরানের একটা বড় ভূমিকা থাকতো!

২০১৮ সালে জয়পুর লিটারেচার ফেস্টিভ্যালে সাংবাদিক বীর সাংভি-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মীরা নায়ার জানিয়েছিলেন, তিনি যখন নেমসেক বানানোর পরিকল্পনা শুরু করেছেন– ঠিক তখনই বিখ্যাত হ্যারি পটার ফ্র্যাঞ্চাইজির পঞ্চম পর্ব ‘অর্ডার অব দ্য ফিনিক্স’ মুভিটা পরিচালনার প্রস্তাব আসে তার কাছে।

যথারীতি সেটা খুবই মোটা অঙ্কের লোভনীয় প্রস্তাব ছিল– আর দ্বিধান্বিত মা নিজের ছেলের কাছেই জিজ্ঞেস করেন, তার কোন কাজটা করা উচিত হবে।

সময়টা ছিল ২০০৭ সাল। জোহরান মামদানির বয়স তখন মাত্রই ১৪ এবং সে নিজেই হ্যারি পটার সিরিজের বিরাট ভক্ত। কিন্তু মাকে সে নাকি বলেছিল, ‘আরও অনেক ভালো ভালো পরিচালক আছেন যারা হ্যারি পটার বানাতে পারবেন– কিন্তু নেমসেক একজনই বানাতে পারবে, আর সেটা তুমি!’

আর এভাবেই শেষ পর্যন্ত সেলুলয়েডের পর্দায় প্রাণ পেয়েছিল নেমসেক।

জোহরান মামদানির মতো দক্ষিণ এশিয় অরিজিনের বাবা-মার যে সন্তানরা আমেরিকায় দ্বিতীয় প্রজন্মের অভিবাসী হিসেবে বেড়ে ওঠেন, তাদের দুটো সংস্কৃতির জাঁতাকলের মাঝে যে আত্মপরিচয়ের সঙ্কট বা বিভ্রান্তিতে ভুগতে হয়– সেই জন্য অনেকে তাদের ‘আমেরিকা বর্ন কনফিউজড দিশি’ বা এবিসিডি প্রজন্ম বলেও বর্ণনা করেন।

নেমসেকের মুখ্য চরিত্র গোগল গাঙ্গুলিও ছিল এরকমই এক তরুণ। আর মজার ব্যাপার হলো- মায়ের সিনেমাতে এই ভূমিকায় যাতে গুজরাটি অরিজিনের মার্কিন অভিনেতা এবং তার অতি প্রিয় কল পেন-কে কাস্ট করা হয়, সে জন্যও কিশোর জোহরান এক রকম জেদ ধরে বসেছিল!

যুক্তরাষ্ট্রে ইতিহাস সৃষ্টি করা এই জোহরান মামদানির জন্ম যদিও আফ্রিকাতে। কয়েক বছর আগেই তিনি মার্কিন নাগরিকত্ব নিয়েছেন এবং এযাবতকালের সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক জীবনেই তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন পরিচয়ে ‘এবিসিডি’ হলেও তার জীবনদর্শন বা রাজনৈতিক ভাবনায় কোনো বিভ্রান্তির অবকাশ নেই!

সোজা কথায় তার রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়ে প্রবল বিতর্ক থাকতে পারে– কিন্তু অস্পষ্টতা নেই একেবারেই! আর এর পেছনে তার ফিল্মনির্মাতা মায়ের ভূমিকাও অনস্বীকার্য।সূত্র: বিবিসি বাংলা

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত