অলোক বসু
বাউল রণেশ ঠাকুরের কথা আমরা সবাই জানি। সাধারণ এক বাউল। একদা আউলবাউল মরমী সংগীতসাধকের পূণ্যভূমি নামেখ্যাত বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জের বাসিন্দা। সম্প্রতি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খবরের বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছেন এই প্রান্তীয় বাউলশিল্পী রণেশ ঠাকুর।
রণেশ ঠাকুরের বসত বাড়ির আঙিনায় ছিলো আলাদা একটা ঘর। বাউলতত্ত্ব মতে তাকে আখড়া বলা যেতে পারে। সেখানে তিনি বাউল গানের সাধনা করতেন, চর্চা করতেন। বাউল সাধনের সতীর্থ ও তার অনুসারী, ভক্তদের নিয়ে আলাপ করতেন, গানবাজনা করতেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী এমনটাইতো চলে আসছে। এটাই বাংলার চিরচেনা এক দৃশ্য। বাউল, ফকির, বয়াতি, মরমী সাধকরা তাদের সাধন এভাবেই করে আসছেন হাজার হাজার বছর ধরে।
তারা তাদের মতো করে যুক্তি দিয়ে মুক্তির পথ খোঁজেন। তারা যুক্তির চর্চা করেন, জ্ঞানের সাধন করেন কিন্তু কারো সাথে বিবাদে জড়ান না। তাদের সাধনায় ভিন্ন-ভিন্ন মত ও পথ থাকলেও তারা অন্যের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন না। এরা নিজের সাধনা আর চর্চা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। নির্বিবাদী জীবন যাপন করেন।

এদের ইহজাগতিক স্বার্থচিন্তা কিংবা লোভ-লালসা নাই বললেই চলে। অথচ মৃত্তিকা-সংলগ্ন এসব প্রান্তিক বাউল বয়াতীদের ওপর আজকাল নানারকম নিপীড়ন নির্যাতনের ঘটনা দেখতে পাই আমরা।
সাম্প্রতিক সময়ে তা যেন ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটলো রণেশ ঠাকুরের ওপর। তার বাউল সাধনা বা চর্চার আসর ঘরটি পুড়িয়ে দেওয়া হলো। কারা পোড়ালো, কেন পোড়ালো এখনও আমরা কিছুই জানতে পারলাম না। শুনেছি সন্দেহভাজন একজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। কিন্তু আমরা কি সত্যি সত্যি জানতে পারবো আসল অপরাধী কে বা কারা?
কেনইবা পুড়িয়ে দেওয়া হলো আসরঘর বা আখড়াটি। হয়তো জানতে পারবো না কোনদিনই। কারণ এমনটাই চলছে এখন আমাদের বাংলাদেশে।রণেশ ঠাকুর বলেছেন তার কোনো শত্রু নাই। সহজিয়া বাউল দর্শন তাই বলে। যারা মৃত্তিকা সংলগ্ন থেকে, বাউল গানের ভাবকে অনুধাবন করেে এর চর্চা করেন তারা অনেক বড় মনের শিল্পী হন, মানুষ হন।
উদারতা, মানবিকতা, অসাম্প্রদায়িকতাকে তারা অন্তরে ধারণ করেন। তারতো কারো ক্ষতি করেন না, তাই তাদের শত্রু নাই ভাবেন তারা। আর সমস্যাটাতো ওখানেই।
আমাদের সমাজ কি সেই উদারতা, মানবিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা বুঝে ওঠার জন্য তৈরি হয়েছে? হয়নি বরং উল্টোপথে হাঁটার সব আয়োজন চলে আমাদের সমাজে। তাইতো বার বার বাউল বায়াতিরা আক্রান্ত হন। আক্রান্ত হয় মুক্তচিন্তা, অসাম্প্রদায়িকতা, মানবতা, উদারপন্থা।
এসব কিন্তু চলতেই থাকবে। কারণ আমাদের রাষ্ট্র-সমাজ আজ আর এসব ধারণ করে না। ধারণ করলে ভোটের রাজনীতিতে বিপদ। ফলে বাউলরা মার খেতে খেতে একদিন নিঃশেষ হয়ে যাবে লালন, হাসন, শাহ আব্দুল করিমদের দেশ থেকে। এদের নাম নিশানাও একদিন উবে যাবে। এক একটা ঘটনার পর প্রশাসন, সাংস্কৃতিকর্মী, রাজনৈতিককর্মীদের নির্লিপ্ততা প্রতিপক্ষকে আরও উৎসাহিত করে। ফলে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
এর প্রতিকারে এখনই সম্মিলিতভাবে রুখে না দাঁড়াতে পারলে বাংলাদেশ নামের দেশটি থাকলেও তার আত্মাটি খুঁজে পাওয়া যাবে না ভবিষ্যতে।আমরা কি তেমন বাংলাদেশই চাইবো?