ফাহমিদা লুমা
চলছে পবিত্র রমজান মাস। রাত তিনটা সাড়ে তিনটার দিকে অদ্ভুত সুরেলা কন্ঠের কিছু পাখি ডেকে উঠে। নাম জানিনা। নতুন শুনছি! অথবা আগে খেয়াল করিনি। সেহরির পর সাথে সাথে ঘুম আসেনা। জানালার দিকে তাকিয়ে ভোরের আলো ফুটে উঠা দেখি। প্রায় দুমাস থেকে গৃহবন্দি। দিন তারিখের খেয়াল থাকে না আজকাল। ক্যালেন্ডার দেখে মিলিয়ে নিতে হয়। আমার বেডরুম লাগোয়া পাশের ছাদে মে লিলি ফুটেছে। মে মাসেই ফোটে। আগুনের গোলকের মতো দেখতে তাই হয়তো এর নাম ফায়ার বল লিলি। পাশেই সাদা শুভ্র স্পাইডার লিলি। মৃদুমন্দ বাতাসে সেই ঘ্রাণ বয়ে নিয়ে আসে।
ধীরে ধীরে নরম আলো ফুটে উঠে। অসংখ্য পাখির ডাকে মুখর হয়ে উঠে চারপাশ। সামনেই একটা গাছে কামরাঙা পেকে হলুদ হয়ে আছে। গাছ বেয়ে কাঠবিড়ালিদের হুটোপুটি। কদিন আগে বুদ্ধ পূর্ণিমা ছিল। জ্যোৎস্নাও কি আগের চেয়ে এখন বেশি উজ্জ্বল? দুধে ধোয়া চাদরে যেন ভেসে যাচ্ছিল। তারপর সকাল বেলা ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা। হঠাৎ গাঢ় কুয়াশার ঢেকে গেল চারপাশ । বৈশাখ মাসে কুয়াশা? মনে পড়ে না কখনও দেখেছি! ব্যাখ্যা জানলাম, প্রকৃতি বিশুদ্ধ হচ্ছে। বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমান কমে যাওয়ায় ঠান্ডা আবহাওয়ার কারণে এই কুয়াশা।
মাঝখানে বেশ গরম গেল। বৃষ্টি হওয়ায় কাল থেকে আবার ঠান্ডা। তিন চারদিন আগে শেষ বিকেলে যখন ইফতারির আয়োজনে ব্যাস্ত জাইমার হুলস্হূলে জানালার পাশে গিয়ে দেখি বানর যুগল। সিলেটে বানর এমনিতেও দেখা যায়। কলা নিয়ে জাইমা অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করলো। বাচ্চারাই বা কি করবে? কতদিন থেকে ঘরে বন্দি। ও আজকাল আমাদের ছোটবেলার গল্প শুনতে খুব আগ্রহী।
ছোটবেলার বানর নিয়ে স্মৃতি মনে পড়ল। তখন সাপের খেলা, বানরের খেলা দেখাতে লোক আসত। আম্মার প্রচন্ড নিষেধাজ্ঞায় সাপের খেলা কখনও দেখা হয়ে উঠে নি। তবে বানরের চমৎকার খেলা দেখেছি। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বানর একে একে পাঠশালায় যাওয়া, ছাতা নিয়ে শ্বশুর বাড়ি যাওয়া, বাজারে যাওয়ার অভিনয় করত। বিনিময়ে চাল বা টাকা বখশিস নিতো। এটাই ছিল বানরের খেলা দেখানো লোকটির উপার্জন। আরও কিছু চমৎকার পেশা ছিল। একে একে বেশিরভাগই এখন হারিয়ে গেছে। হজমিওয়ালা! বেতের ঝাঁপি নিয়ে আসতো। কালো ছাই রঙের সেই অদ্ভুত স্বাদের খাবারটি কি এখনও টিকে আছে! কে জানে? হাওয়াই মিঠাই এখনকার মতো বিশাল সাইজের ছিল না। কাঁচের বাক্সে ছোট ছোট আকারে পাওয়া যেত। বাতাসে কিছুক্ষণ থাকলেই মিলিয়ে যেত। স্বাদও ছিল অনেক ভালো। ঘি চমচম বা কটকটি নামে আরেকটি খাবার ছিল। পুরনো লোহালক্কড় নিয়ে বিক্রি করতো। গরমের মধ্য দুপুরে আইসক্রিমওয়ালার ঘন্টা সব নিস্তব্ধতা ভেঙে দিত। এখনকার এতো এতো ফ্লেভারের আইসক্রিমের ভিড়েও সেই সস্তা দামের আইসক্রিমের আনন্দটুকু যেন নেই। আর ছিল লেইসফিতা লেইস! যেন জাদুর বাক্স। ডালা খোলার সাথে সাথেই সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ত। তখন হয়তো মানুষের আনন্দ পাওয়ার অনুভূতি ছিল বেশি। জীবন এত জটিল হয়ে উঠে নি। খুব বেশি দিন আগের কথা তো নয়। মাঝখানে খুব দ্রুত পরিবর্তনগুলো ঘটেছিল। মানুষ অনেকটাই যান্ত্রিক হয়ে গিয়েছিল।
ডিজিটাল জীবনে অভ্যস্ত বাচ্চারা ফুলের গন্ধ, চাঁদের আলো, বৃষ্টির সুর, পাখির ডাক খুব খেয়াল করে দেখেছে কি? মাথার উপর অসংখ্য তারা জ্বলা কোন নক্ষত্র রাতে দাঁড়িয়ে কি সৃষ্টি রহস্য নিয়ে ভেবেছে? অন্ধকার রাতে আকাশের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত বয়ে যাওয়া মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গা কি দেখেছে? কালপুরুষ, সপ্তর্ষিমন্ডলের অবস্থান কি জানে? সেই অন্ধকার রাতই বা কই এখন? ইলেকট্রিসিটি যাওয়ার সাথে সাথে জেনারেটর আর আইপিএসের আলোয় সেই নক্ষত্র খচিত আকাশ দেখার সুযোগই বা কই? আমি নিজেই বহুদিন পর টাঙ্গুয়ার হাওরে মিল্কিওয়ে দেখলাম।
ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে কলকাতা গিয়েছিলাম। সেখানে সাইন্স সিটি, বিড়লা প্লানেটোরিয়ামে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে মহাকাশ আর বিভিন্ন গ্রহ দেখানো হচ্ছিল। অত্যাধুনিক থ্রিডি প্রযুক্তির মাধ্যমে মহাকাশে ভেসে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা, চাঁদের দেশে, মঙ্গল গ্রহে পৌছে যাওয়ার মতো জীবন্ত অনুভূতি। কিন্তু এখন অনুধাবন করার সময় এসেছে ভিনগ্রহ নিয়ে গবেষণা করা, ফ্লাইং সসার নিয়ে কল্পকাহিনী আর মঙ্গল গ্রহে বেঁচে থাকার উপযোগী পরিবেশ তৈরি করার জন্য ব্যতিব্যস্ত না হয়ে আমাদের নিজেদের গ্রহ পৃথিবীকে বেঁচে থাকার উপযোগী করতে হবে। বিনিয়োগ করতে হবে এই খাতে। বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে। দূষণ কমাতে হবে। পাহাড় কাটা, নদী ভরাট বন্ধ করতে হবে। প্রকৃতিকে টিকিয়ে রাখতে হবে।
মানুষকে হতে হবে আরও মানবিক। লকডাউনের এই সময়ও দুঃখজনকভাবে আমাদের দেখতে হয়েছে পিটিয়ে ডলফিন মারার দৃশ্য। বিষ খাইয়ে বানর মারার ঘটনা। প্রকৃতি শুধু মানুষের নয়। এরা সবাই প্রকৃতির সন্তান।
আমাদের মানবিক হতে হবে। প্রকৃতির মতো মানুষকেও বিশুদ্ধ হতে হবে। তবেই হয়তো খুলে যাবে প্রকৃতির অবরুদ্ধ দ্বার। দূর দিগন্তে দেখা যাবে সোনালি রেখা। আমরা সেই আলোর প্রত্যাশায়।