আবু সাঈদ লীপু
পুরো বিশ্বই প্রশ্নটার উত্তর খুঁজছে- ‘কোথা থেকে ভাইরাসটা এলো?’ দুঃখের বিষয় সঠিক উত্তরটি এখনও অজানা। তবে বেশ কিছু তত্ত¡ ডাল-পালা মেলেছে। করোনাভাইরাসের আতুরঘর চীনের গোপনীয়তা এবং অ¯^চ্ছতার কারণে ভয়ংকর কিছু ষড়যন্ত্র তত্ত¡ও মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।
পাঁচ মাসের অধিক হয়ে গেলো। অফিসিয়ালি প্রায় অর্ধকোটি আক্রান্ত আর ৩ লক্ষের অধিক লাশের উপর দাঁড়িয়ে এই প্রশ্নটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রশ্নটা ঘিরেই দুই পরাশক্তি আমেরিকা এবং চীনের মধ্যে ভয়ংকর কথা চালাচালি চলছে। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে প্রচলিত এবং জনপ্রিয় তত্ত¡টি হচ্ছে করোনাভাইরাস লাফ দিয়ে বাদুড় থেকে মানবে প্রবেশ করেছে। সম্ভবত লাফ দিয়ে মানবদেহে আসার পথে ভাইরাসটি বনরুই জাতীয় প্রাণীর দেহে অবস্থান করেছে। এই লাফালাফির ঘটনাটি ঘটেছে চীনের উহান শহরের একটি বাজারে, যেখানে জীবিত প্রাণী কেনা-বেচা করা হয়। এই ধরণের বাজারকে বলে ‘ওয়েট’ মার্কেট। অন্যদিকে ‘ড্রাই’ মার্কেটে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, কাপড়চোপড় ইত্যাদি বিকিকিনি হয়।
যাহোক, যড়যন্ত্র তত্ত¡গুলোর একটি হচ্ছে, ভাইরাস উহান শহরের কোন একটি গবেষণাগার থেকে দূর্ঘটনাবশতঃ ছড়িয়ে পড়েছে। উহান শহরে কমপক্ষে দু’টি ল্যাব আছে যেখানে সংক্রামক ব্যাধি নিয়ে গবেষণা করা হয়। কিছু আমেরিকান রাজনীতিবিদ, এমনকি খোদ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভাইরাসের উৎস নির্ণয়ে তদন্ত চান। কিন্তু চীন বলছে এই তদন্ত চাওয়া বিদ্বেষপূর্ণ। উল্টো মার্চ মাসে চীন অভিযোগ করেছিলো, এই ভাইরাস যুক্তরাষ্ট্র থেকে ছড়িয়েছে। এই উৎস-বিতর্ক বিশ্বব্যাপী রোগ-নিরাময় সম্পর্কিত গবেষণা এবং গবেষণাগার সম্পর্কে মানুষের আস্থা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। চীনের কর্তাব্যক্তিদের অ¯^চ্ছতা এবং একপেশে প্রচারণা যে বিশাল এক দূর্বলতা তাও এই ভাইরাস পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
করোনাভাইরাস এখন পর্যন্ত মানুষের ইচ্ছাকৃত ভুলে সৃষ্টি হয়েছে তার কোন প্রমান নেই। বরঞ্চ বিজ্ঞানীদের কোনো রকম সন্দেহ নেই যে, ভাইরাস সম্পূর্ণভাবে প্রাকৃতিক সৃষ্টি। তারপরও সন্দেহ থেকে যায় যে, দূর্ঘটনা ঘটতেই পারে। রোগ-জীবানু নিয়ে বিশ্বের অনেক গবেষণাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। সেখান থেকে ক্ষতিকর জীবানু ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা অতীতে ঘটেছে। সার্স নামক ভাইরাসটি বেইজিং-এর গবেষণাগার থেকে ছড়িয়ে পড়েছিলো ২০০২-০৩ সালে। যার ফলে ৭৭৪ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছিলো। ভাইরাসটি দ্বিতীয়বারও ছড়িয়েছিলো ২০০৪ সালে। বৃটেনে ২০০১ সালে গবাদি পশুর খুড়া এবং মুখ রোগে ৬০ লক্ষ পশু মরে গিয়েছিলো। যার ফলে ১১০০ কোটি ডলারেরও বেশী ক্ষতি হয়েছিলো। পরবর্তীতে ২০০৭ সালে আরও একবার এই রোগ ছড়িয়েছিলো। অবশ্য সেবার কোনো রকম ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই তা মোকাবেলা করা সম্ভব হয়েছিলো। আমেরিকায় ২০০০ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে মোট ৩৪ বার গবেষণাগার থেকে রোগ ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। সেসময় ৪ জন মারা গিয়েছিলো। সাম্প্রতিক সময়ে অ্যানথ্রাক্স, বার্ড ফ্লু, এবোলা সবই আমেরিকার গবেষণাগার থেকে ভুলক্রমে ছড়িয়ে পড়েছিলো। এসব গবেষণাগারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিলো ত্রুটিপূর্ণ। সাম্প্রতিক স্বাস্থ্য-নিরাপত্তা সূচক জরীপ বলছে, চার ভাগের তিনভাগ দেশেই জৈব-নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্যন্ত দূর্বল।
এই মুহুর্তে করোনাভাইরাসের উৎস সংক্রান্ত বিতর্ক শেষ হওয়া খুব জরুরী। বিজ্ঞানের বর্তমান অগ্রগতিতে এই কাজটি কঠিন নয় নিশ্চয়। বিশ্বব্যাপী অতি উন্নত নিরাপত্তা সম্বলিত জৈব-গবেষণাগার সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে এখন। সারা বিশ্বে ৩০টি দেশে ৭০টির মত গবেষণাগার আছে যারা ‘জৈব-নিরাপদ স্তর ৪’-এ উন্নীত। এই গবেষণাগারে অত্যন্ত ক্ষতিকর রোগের চিকিৎসা এবং টিকা সম্পর্কে গবেষণা হয়। আমেরিকায় এক ডজনেরও বেশী এরকম গবেষণাগার আছে। চীনে আছে দু’টি যার একটি উহানের ভাইরাসবিদ্যা প্রতিষ্ঠানে। আগামী ৫ বছরের মধ্যে আরও পাঁচটি গবেষণাগার বানানোর পরিকল্পনা আছে চীনের। এসব গবেষণাগারে জীবানু ঘাটাঘাটি করা, জীবন-বিনাশী কাজ এবং কাজশেষে নিজেকে সম্পূর্ণ জীবনুমুক্ত করা ঝুঁকিপূর্ণ। জীবানু নিয়ে গবেষণার একটা শাখা সবচেয়ে বেশী ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, এখানে জীবানুবাহিত রোগকে বিপদজনক করে ফেলা হয়। যাতে মানবদেহে এসব রোগের প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠে। চীনের উহান শহরের বিজ্ঞানীরা এরকম বিপদজনক গবেষণাই করে থাকেন। চীনের সাথে আমেরিকা এবং ইতালির বিজ্ঞানীরা যৌথভাবে কাজ করছেন এখানে। এদের গবেষণাকে বলে গেইন অব ফাংশন যা সংক্ষেপে জীবনের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান প্রোটিনের নতুন করে তৈরী বা বর্ধিতকরণ বলা যায়। এর বিপরীতে লস অব ফাংশন নামে বহুল পরিচিত আরেকটি গবেষণা আছে, যা প্রোটিন কমায় বা ধ্বংস করে।
ব্যাপারটা শুনতে গা ছমছমে লাগে। কিন্তু এই জাতীয় গবেষণা বিজ্ঞানীদের জন্য খুবই মর্যাদাকর। গবেষণা থেকে বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন যে, নতুন রোগগুলো কেমন আচরণ করবে। রোগের ধরণ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ঔষধ তৈরী করতে পারবে যাতে মানুষের জীবন রক্ষা করা যায়। একদিকে প্রচন্ড ঝুঁকি এবং অন্যদিকে মানব কল্যাণ, এই বিবেচনায় বিভিন্ন দেশের সরকার অত্যন্ত নজরদারীর মধ্যে এসব গবেষণার অনুমতি দেয়। গবেষণার নিরাপত্তা এবং স্বচ্ছতা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হয়। এই নীতিমালা কঠোরভাবে অনুসরণ করার কথা।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় বর্তমান নীতিমালার ধরণ উল্টোদিকে বইছে। ২০১৭ সাল থেকে আমেরিকার গবেষণাগারগুলো নিয়মনীতি পর্যবেক্ষণের জন্য একটি প্যানেল নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই প্যানেলের সদস্য এবং এদের কার্যপ্রণালী অস্বচ্ছতায় পরিপূর্ণ। এপ্রিলের ২৭ তারিখে আমেরিকা বাদুড় থেকে কীভাবে করোনাভাইরাস মানবদেহে চলে আসে এ সংক্রান্ত বৃহৎ গবেষণায় অনুদান বন্ধ করে দেয়। ধারণা করা হয়, চীনের সাথে যৌথভাবে উহানে গবেষণা করাই এর কারণ।
ইতোমধ্যে বিশ্বের অনেক দেশ চীনকে করোনাভাইরাস ছড়ানোর অভিযোগে অভিযুক্ত করতে থাকে। চীনও করোনাভাইরাস সম্পর্কে নিজেদের প্রচারণা এবং ভয়ভীতি প্রদর্শন বৃদ্ধি করে। অস্ট্রেলিয়ার সরকার করোনাভাইরাসের উৎস নির্ণয়ে আন্তর্জাতিক নিরপেক্ষ তদন্ত করার প্রস্তাব দেয়ায় চীন অস্ট্রেলিয়ার পণ্য আমদানী কমিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। চীন ইউরোপীয় কমিশনের প্রস্তাবকেও প্রচারণার মাধ্যমে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। চীনের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, ইউরোপীয় কমিশনের কর্মকান্ড সহযোগিতার ক্ষেত্রে খারাপ ফল বয়ে আনবে যা চীনকে ক্রুদ্ধ করে তুলবে।
তথাপি বিশ্ব পরিস্কারভাবে জানতে চায়, কীভাবে করোনাভাইরাস বাদুড় থেকে মানবদেহে চলে আসলো। বৈজ্ঞানিক তথ্য-প্রমান দিয়ে তা গ্রহণযোগ্য হতে হবে। অন্যথায় ষড়যন্ত্রতত্ত¡ মাথা চাড়া দিয়ে উঠবেই; যা ভবিষ্যতে সব ধরণের কাক্সিখত বৈজ্ঞানিক আবিস্কারগুলোকে বিপদে ফেলে দেবে। সেজন্যে সকল দেশের বিচারবুদ্ধি, সহযোগিতা এবং পুরো ¯^চ্ছতা খুবই প্রয়োজনীয়। অথচ অত্যন্ত দুঃখের বিষয় পৃথিবী এখন ঠিক বিপরীত অবস্থানে আছে।
(দ্য ইকোনমিষ্ট অবলম্বনে)
লেখক: কানাডার জিওটেকনিক্যাল বিভাগে কর্মরত।