শ্যামল কুমার রায়
করোনা পরিস্থিতি নিয়ে দেশের গণমাধ্যম ও স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসক ও গবেষকরা বলছেন এখন থেকেই আমাদের আরও শতর্ক ও কড়াকড়ি ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে সামনের দিনগুলোতে এর প্রভাব আরও ব্যপক হতে পারে। এদিকে মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী গতকাল তার পূর্বদিনের বক্তব্যকে একটু ঘুরিয়ে বলেছেন করোনা আক্রান্তের হার বৃদ্ধি পেলেও আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ বাংলাদেশ এখনও বিশ্বের অন্যন্য করোনা আক্রান্ত দেশের চেয়ে ভাল অবস্থানে রয়েছে।
মাননীয় মন্ত্রীর এই বক্তব্যটি বিনয়ের সাথে দ্বি-মত পোষণ করে বলতে চাই আমাদের ১৬ কোটি মানুষের দেশে দৈনিক মাত্র ৭-৮ হাজার মানুষ পরীক্ষা করার সুযোগ পাচ্ছে যা খুবই অপ্রতুল। জনসংখ্যা ঘনত্বের বিবেচনায় দৈনিক ৫০ হাজার বা তারও বেশী পরীক্ষা করার সুযোগ থাকলে প্রকৃত চিত্র হয়তো জানা যেত। আইডিসিইয়ারের পরিচালক ডা. মুশতাক আহাম্মেদ গতকালও বলেছেন করোনা রোগী শনাক্তকৃত সংখ্যার ৪০ গুণ বেশী হবে। স্পেন বা ইতালির জনসংখ্যা আমাদের জনসংখ্যার ৩০% এর ও কম। অপরদিকে আমাদের পরীক্ষা হার তাদের পরীক্ষার হারের ২০% এর ও কম সেজন্যই আক্রান্তের সংখ্যাটি কম। কিন্তু এটি মোটেও স্বস্তির কোন খবর নয়। ঢাকা শহরে এখনো দেড় কোটি মানুষ রয়েছে। ফলে নমুনা পরীক্ষার যে হার তাতে ঢাকাবাসীর পরীক্ষা করতেই প্রায় ৪ বছর লাগার কথা। সে কারণেই বলছি আমরা অনেক দেশের চেয়ে অনেক ভাল অবস্থানে আছি এটা বলার বা ভাবার কোন অবকাশ নেই।

এ পর্যন্ত পরীক্ষা করা হয়েছে মোট ১,৪৭,৫৬৬ জন তার মধ্যে করোনা শনাক্ত হয়েছে ২০,০৬৫ জনের এবং মৃত্যুবরণ করেছে ২৯৮ জন। অর্থাৎ পরীক্ষাকৃত সংখ্যার ১৩.৬০% মানুষ আক্রান্ত বা করোনা পজেটিভ পাওয়া গেছে এবং মৃত্যুর হার হচ্ছে ১.৪৯%। এই সংখ্যার শতকরা ৮০ ভাগ ঢাকা বিভাগে বাকিটা সারা দেশে। এখানে গত ৫ দিনের একটি তথ্যচিত্রের ছঁক তুলে ধরা হলো, যা থেকে পাঠকবন্ধুগণ সহজেই একটা ধারণা পেতে পারেন।
তারিখ পরীক্ষা শনাক্ত শনাক্ত % মৃত মৃত %
১১মে ৭২০৮ ১০৩৪ ১৪.৩৪% ১১ ১.০৬%
১২ মে ৬৭৭৩ ৯৬৯ ১৪.৩০% ১১ ১.৪০%
১৩ মে ৭৯০০ ১১৬২ ১৪.৭১% ১৯ ১.৬৪%
১৪ মে ৭৩৯২ ১০৪১ ১৪.১০% ১৪ ১.৩৪%
১৫ মে ৮৫৮২ ১২০২ ১৪.০০% ১৫ ১.৪৯%
উল্লেখিত ছঁক থেকে দেখা যাচ্ছে দৈনিক গড় আক্রান্তের হার ১৪% এর উপরে এবং গড় মৃত্যুর হার ১.৩৮%। এই হিসাব অনুযায়ী যদি আমরা ধরে নেই আমাদের মোট জনসংখ্যার ২৫% করোনা আক্রান্ত হতে পারে তাহলে কি চিত্র দাঁড়াবে তা খুব সহজেই অনুমান করা যায়।

ঈদকে সামনে রেখে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে যাতায়াত ব্যবস্থায় কড়াকড়ি কিছুটা শিথিল করা হলে ঢাকার প্রবেশমুখগুলোতে প্রচন্ড যানজট লক্ষ্য করা গেছে গত কয়েক দিনে। ইতোপূর্বে গার্মেন্টস কারখানা খোলা ও বন্ধ করার পরস্পর বিরোধী সিদ্ধান্ত গোটা জাতিকে আশাহত করেছে। এখন কিছু কিছু মার্কেট খোলার ঘোষণা দিয়েও ব্যবসায়ীরা শেষ পর্যন্ত না খোলার সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানাই কিন্তু ফুটপাতের মার্কেটগুলোতে দেখা গেছে ক্রেতা বিক্রেতাদের উপচেপড়া ভীর। মহিলারা ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে দলবেঁধে ফুটপাত মার্কেটে যেন হুমরী খেয়ে পড়ছে।মাওয়া শিমুলিয়া ঘাটে ও আরিচায় পাটুরিয়া ঘাটে ঢাকামুখি মানুষের উপচে পড়া ভীর লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এমতাবস্থায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বার বার সাবধানতা বাণী দেয়া হচ্ছে ঘরে থাকার জন্য। কিন্তু বাহিরের পরিস্থিতি গণমাধ্যমে দেখলে মনে হচ্ছে এসব সতর্কতার কথা বিরাট সংখ্যক মানুষ যেন আমলেই নিচ্ছে না। ফলে করোনা নিয়ে আতঙ্ক বা আশঙ্কার জায়গাটি সেখানেই।
যে কোন জাতীয় দুর্যোগে কোন কিছুই স্বাভাবিক চলমান থাকার কথা নয় সেজন্য দেশের মানুষকে খুবই সংযতভাবে কিছু দুঃখ কষ্টকে মোকাবেলা করেই একটা নির্দিষ্ট সময় অতিক্রমের জন্য অপেক্ষা করার কথা। কিন্তু জাতি হিসেবে আমাদের সেই শিক্ষা এখনো অর্জিত হয় নি। বর্তমান সময় যুদ্ধকালীন সময়ের চেয়েও ভয়াবহ কাজেই দেশের মানুষকে তা বুঝতে হবে। আমরা উন্নত বিশ্বের রাষ্ট্র নই বলেই রাষ্ট্রীয় অনেক সীমাবদ্ধতা আমাদের রয়েছে। ফলে এই সার্বিক বিষয়টিকেও কিছু মানুষ চেচ্ছাচারিতার দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখছে বলে প্রতিয়মান হয়। ফলে রাষ্ট্রকে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্বার্থে প্রয়োজনে কারফিউর মত কঠোর অবস্থান নেয়া ছাড়া কোন বিজল্প আছে বলে মনে করি না।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামগঞ্জে এখনো করোনার প্রভাব খুব বেশী লক্ষ্য করা যায়নি, আগামী এক সপ্তাহ পরেই ঈদের ছুটি হয়ে যাবে তখন ঢাকা থেকে বিরাট সংখ্যক গার্মেন্টস শ্রমিকরা আবার প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামের বাড়ীতে বানের স্রোতেরমত ফিরে যাবে। ফলে সেই অবস্থাটির মাধ্যমে করোনা গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। কয়েকদিন আগে পঞ্চগড় থেকে মাঝ বয়সী একজন লোক তার মাকে সাথে নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন গার্মেন্টসে কর্মরত তার স্ত্রীর সাথে দেখা করতে ফিরে যাবার সময়ে সেই হতভাগ্য লোকটি করোনা উপসর্গ নিয়ে বাসের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করলে অন্যান্য যাত্রীরা মৃতব্যক্তির মাকে পুত্রের লাশসহ পথিমধ্যে জোড় করে নামিয়ে দেয়। ফলে ঈদ উপলক্ষ্যে কয়েক লক্ষ মানুষ যখন ঢাকা ছেড়ে যাবে সেই বিষয়টি কি ধরণের ম্যানেজমেন্টের আওতায় নেয়া হবে সেটিও আগে থেকেই ঠিক করে গণমাধ্যমে প্রচার করা হলে ভাল হবে।

দেশের বাইরে থেকে আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত কেউ কেউ বলছেন আক্রান্ত ও মৃতের হার বা পিক টাইম জুলাই পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে, জুলাইয়ের পরে এটি আস্তে আস্তে আবার নীচের দিকে নামতে থাকবে।
এমতাবস্থায় দেশের ক্ষুদ্র কর্মজীবী গোষ্ঠির মানুষ ও নিন্ম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ সবচেয়ে কঠিন অবস্থার মুখমুখি হচ্ছে। ফলে এই পরিস্থিতি যদি জুন জুলাই পর্যন্ত অব্যাহত থাকে তাহলে যে পরিস্থিতি হতে পারে তা মোকাবেলায় এখন থেকেই আরও কঠিন পদক্ষেপ নেয়া দরকার বলে মনে করি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিরলস প্রচেষ্টায় যদিও নানা ধরনের সহায়তা প্রোগ্রাম ইতোমধ্যেই নেয়া হয়েছে কিছু চাহিদার তুলনায় তা অতি অপ্রতুল। তাই পরিস্থিতি সম্ভাব্য দীর্ঘায়িত আশংকার মোকাবেলায় সামরিক বেসামরিক ও শীর্ষস্থানীয় এনজিও দের সমন্বয়ে একটি ইমারজেন্সি টাস্কফোর্স গঠন করার বিষয়টি ভেবে দেখা যেতে পারে। পরিস্থিতি অবনতির দিকে ধাবিত হলে তা মোকাবেলায় সম্ভাব্য কি কি পদক্ষেপ নেয়াযেতে পারে তারও একটি অগ্রিম ধারণা আগে থেকেই প্রচার প্রচারণা থাকলে সামাজিক সংগঠনগুলো তাতে সহযোগীতা সংযোজন করতে পারবে।
সর্বোপরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ রাখতে চাই এই মর্মে প্রাণঘাতী করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় ইমার্জেন্সি টাস্কফোর্সের একটি এ্যাকশন প্ল্যান টিম শহরে ওয়ার্ড পর্যায়ে এবং গ্রামে ইউনিয়ন পর্যায়ে পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে থাকলে সরকারের গৃহিত কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়নে যেমন সহায়ক হবে তেমনি সাধারণ মানুষের মনেও আস্থার জায়গাটি সুদৃঢ় হবে বলে মনে করি।
লেখকঃ সাবেক ছাত্রনেতা ও রাজনীতি বিশ্লেষক।