হাসান তৌফিক ইমাম
মহামারির সাথে মানুষের যুদ্ধ এমন এক সময়ে শুরু হল যখন বিশ্ব অর্থনীতির চাঙ্গা ভাবের সুফল প্রায় সব দেশই লাভ করতে শুরু করেছিল। উন্নয়নশীল দেশের মানুষজন উচ্চহারে এবং টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন করছিল।এই কাতারে বাংলাদেশ অনেক শক্ত অবস্থান নিয়ে এগিয়েছিল। এই সময়ে বাংলাদেশর ৮.১% প্রবৃদ্ধিসহ শুদ্ধ হিসাবে জিডিপি কমবেশি ৩১৭ বিলিয়নমার্কিন ডলার। বিদেশে বাংলাদশের রপ্তানি ৪৫.৭ বিলিয়ন ইউএস ডলার, প্রবাসীরা দেশে পাঠায় ১৮.৩২ বিলিয়ন ইউ এস ডলার আর বাংলাদেশ আমদানি করে প্রায় ৫০.৪ বিলিয়ন ইউ এস ডলারের পণ্য ও সেবা। এছাড়া আছে বাম্পার উৎপাদনশীল কৃষিখাত, দেশি পর্যটন ও পরিবহন যোগাযোগ আর উর্ধ্বমুখী সেবা খাত। প্রায় ১০ মিলিয়ন বাংলাদেশি বিদেশে চাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে জড়িত। আজ এ সবকিছু মারাত্মক ক্ষতির মধ্যে পড়ে গেছে। এদেশের নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষ তাদের সামাজিক বৃত্ত ভাঙার দিশেহারা সংগ্রামে যুক্ত হয়েছিল। খেটে খাওয়া মানুষ অন্তত নিয়মিত কাজ করে ভালই চলছিল। বেসরকারি খাতে লাখ লাখ উচ্চশিক্ষিত তরুণ শ্রম ও মেধা দিয়ে দেশকে এগিয়ে নেয়ার কাজে ক্লান্তিহীন পরিশ্রম করে যাচ্ছিল। দেশের মানুষের আয় বেড়েছিল। ব্যয় করার সামর্থ কমবেশি সবার ছিল। স্বপ্ন আর আশা যখন শিখরে পৌছে গেল, আক্রমণ করে বসলো করোনাভাইরাস। আমদানি, রপ্তানি ও রেমিটেন্স সব কমতে শুরু করেছে। তাই সবাই চেষ্টা করছে কীভাবে ক্ষতি কমানো যায়।
দেশে তালাবন্দি জারি করা হয়েছিল ২৫ মার্চ ২০২০। সেদিন করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল পাচ জন। এখন (১০ মে পর্যন্ত) তা দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৬৫৭ জনে। মৃতের সংখ্যা ২২৮। একদিনে সর্বোচ্চ শনাক্ত ৮৮৭জন। শতকরা ১২ জনেরও বেশি জন করোনা পজিটিভ ধরা পরছে যাদের পরীক্ষা করা হচ্ছে তাদের মধ্যে। দেশ জুড়ে মোট ৩৩ টি ল্যাবে ভাইরাস পরীক্ষা হয়। সাধারণ হিসাবে দৈনিক প্রায় ১২ হাজার টেস্ট করা সম্ভব। দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তির দিকে। ঠিক এই সময়ে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জ হল লকডাউন বা তালাবন্দি দেশ জুড়ে জারি থাকবে না শিথিল করা হবে। ইতোমধ্যে খুলে দেয়া হয়েছে পোশাক করাখানা, শপিং মল দোকান পাট। এ সিদ্ধান্তকে সচেতন মহল আখ্যায়িত করছেন অপরিনামদর্শী ও আত্মঘাতি হিসিবে। কেননা, ইতালি, স্পেন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র ঢিলেঢালা লকডাউন পালন করতে যেয়ে জনজীবনে ডেকে এনেছে সর্বনাশ। শেগুলোতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যার দিকে তাকালে এ নিয়ে কেউ আর বিতর্ক তুলতে আগ্রহী হবেন বলে মনে হয় না। সরকারের অসতর্কতা নাগরিকদের উদাসীনতর কারণে বেঘোরে জীবন দিয়েছে অনেক মানুষ। বিশ্বে বেশি এখন করোনায় মৃতের সংখ্যা তিন লাখের ঘর ছুঁই ছুঁই করছে। । তাই বয়স্ক নাগরিকদের এই সময়ে অবশ্যই ঘরে রাখতে হবে। প্রয়োজনে বয়স্ক ভাতা বাড়িয়ে দেয়া দেয়া পারে। একদিকে মহামারী প্রতিরোধ অন্যদিকে ব্যবসা বাণিজ্যের লাভ-লোকসান সামাল দেয়া আর দেশের প্রবৃদ্ধির গতি ধরে রাখা, আয় ধরে রাখা আমাদের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ।
বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা অনেক মানুষ এই সময়ে শ্রম বাজারে চাকুরি প্রার্থী ছিল। তারা এখন আশাহত। বেকারত্ব নিয়ে ঘরে বসে থাকবে বেশ কিছুদিন। অন্যদিকে বেসরকারি খাতে ইতিমধ্যে অনেকে চাকরি হারিয়েছেন বা বেতন পাচ্ছেন না। সামনের দিন তাদের কেমন যাবে বলা মুশকিল। কোটি কোটি স্বল্প আয়ের শ্রমজীবী মানুষ শুধু হাত পা নিয়ে বসে আছে। দান-খয়রাত দিয়ে এইসব মানুষের জীবন জীবিকা চালানো মোটেও সম্ভব নয়। তাই চাকরি বহাল রাখতে হবে আর অর্থনীতির চাকা চালু রাখতে আরো বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। আয় বাড়লে মহামারী প্রতিরোধে মানুষের অংশগ্রহণ বেড়ে যাবে। কোন প্রকার হতাশা সৃষ্টির সুযোগ যেন থাকে।
এরই মধ্যে ঈদ সামনে রেখে ১০ মে থেকে সীমিত আকারে বিপনি-বিতান খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত এসেছে।আগামী ১৬ ই মে’র পর তালাবন্দি কিভাবে কতটুকু কার্যকর থাকবে তার রূপরেখা সময়ে জেনে যাব আশা করছি। কিন্তু, লোক চলচল সীমিত অবশই রাখতে হবে। তবে কিছু বিষয় মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। তা হল কেমন হবে এই করোনা পরবর্তী রুজি-রোজগারের অবস্থা? শুরু থেকেই বিজ্ঞানীরা বলে আসছেন, করোনার প্রকোপ কমে গেলেও আমাদের সমাজে আরো কয়েক বছর থাকবে এই ভাইরাস। আমাদের দেশ অধিক জনঘনত্বের দেশ। কর্মপরিবেশ ঠিক আগের মত করে ভাবতে পারবনা। যেসব দেশ ইতিমধ্যে লকডাউন শিথিল করেছে বা তুলে নেয়ার পদক্ষেপ নিয়েছে তারা কাজের সময়কে দুই ভাগ করে কাজ করছে। যাতে দরত্ব বজায় রাখা যায়। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত, ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান সব লোকজনে ঠাসা থাকে। আমরা কিভাবে দুরত্ব বজায় রেখে কাজ করবো তা ঠিক করতে হবে। আমরা তাদের পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারি। তবে সত্যি কথা হল সরকারি বা বেসরকারি সব জায়গায় কাজের গুণগত মান বাড়াতে হবে সবার আগে। সবাইকে অনেক বেশি দিতে হবে।
২০২০ সালে বা তারপরে ভাইরাসের টিকা বাজারে এলে প্রায় ১৬ কোটি মানুষকে টিকা দিতে হবে ভাইরাস থেকে সুরক্ষার জন্য। মাস্ক, স্যানিটাইজার বা পোষাক দিয়ে কত দিন চালানো যাবে। এই টিকা বা টিকার ফরমুলা সময় মত সংগ্রহ করে আমাদের সবাইকে ভাইরাস সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেয়ার আগাম প্রস্তুতি থাকা জরুরি।
সারাদেশে গণপরিবহনের ভবিষ্যত আমাদেরকে না ভাবিয়ে পারে না। শারীরিক দুরত্ব কতটুকু বজায় রেখে আমরা যাতায়াত করবো সে ব্যাপারে সচেতনতা ও নিয়ম নীতি দরকার। শহরের ফুটপাথের দোকানিদের ব্যবসার সুযোগ না থাকলে তাদের অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। শারিরীক দুরত্ব বজায় রেখে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার উপযুক্ত পদক্ষেপ একান্ত জরুরি। আর কার্যকর ও ফলপ্রসু পাঠদান দরকার। এখন সময় হয়েছে শিক্ষর্থীদের মাধ্যমিক পর্যায়ে বার তেরটা বিষয় না পড়িয়ে জরুরি দক্ষতা নির্ভর বিষয়গুলো পড়ানো। তাতে স্কুল সময় কমিয়ে শিফটিং করে ক্লাশে পাঠদান করা যায়। আর দীর্ঘদিনের আবদ্ধতার পর ঘর থেকে বের হওয়া মানুষের আচরণ নিশ্চয় আগের মত থাকবেনা। আমাদের সুযোগ সংকুচিত হলে অনেকে বেপরোয়া হয়ে যাবে। মানুষ এতদিনে অনেক কিছু ছাড়া বাচতে শিখে গেছে। বলতে গেলে অধিকাংশ মানুষের আয় কমে গেছে বা যাবে। অনেকে হাতে টাকা ধরে রাখতে চাইবে। ফলে বাজারে পণ্যের কার্যকর চাহিদা আগের মত থাকবে কি না তা দেখার বিষয় হবে। তাই সহজ ঋণের যোগান আর অধিক কর্মসংস্থানের কোন বিকল্প নেই। যুব ও উঠতি বয়সের মানুষের মধ্যে অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে। পরিবার বা সমাজকে ধৈর্যের সাথে সামাল দিতে হবে। আমাদের অর্জন ধরে রাখতে হবে। সাধারণ মানুষের জীবন ধারণ সহজ ও স্বাভাবিক করতে আমাদের সবার মানবিক ও কার্যকর ভূমিকা প্রয়োজন ।