কানাডা থেকে আবু সাঈদ লীপু
ইলোন মাস্ক বলছেন অনেক কিছু। বেশ ক’বছর তো হয়েই গেলো। খুব বেশী অগ্রগতি তার কিন্তু ঐ ইলেকট্রিক কার আর স্পেসএক্স। তিনি স্টিভ জবস নন, কিংবা নন বিল গেটস বা জেফ বেজোস। এরা বলার সাথে করছেনও দ্রুত। অ্যামাজন, মাইক্রোসফট কিংবদন্তী এখন। যদিও স্টিভ জবসকে হারিয়ে অ্যাপল সাময়িক গতি হারিয়েছে। কিছুটা বেসামাল। এদের সাথে তুলনা করলে ইলোন মাস্ক তার টেসলা নিয়ে অনেক কিছু যে করছে তা নিশ্চিত। বিদ্যুৎচালিত গাড়িকে বেশ জনপ্রিয় করে তুলছে সে। বিশ্বজুড়ে গিগাফ্যাকটরি করছে। কিন্তু আসল জিনিস যেটা করছে টেসলার ইলোন মাস্ক, তা হচ্ছে ভবিষ্যৎ স্বপ্ন তৈরি; স্বপ্নের ফেরিওয়ালা।
লিওনার্ডো দ্য ভিঞ্চি কিন্তু উড়ে যেতে পারেন নি তার জীবদ্দশায়। অথচ ভদ্রলোকের বিশেষ একটা ইচ্ছে ছিলো আকাশ ভ্রমণের। বাতাসের গতিপথ এবং আকাশযানের কর্মকান্ড নিয়ে তিনি বিস্তর ভেবেছেন। সোয়া পাঁচশ বছর আগে লিওনার্ডোর আঁকা হেলিকপ্টারের চিত্র নিশ্চয় তার অনন্য স্বাক্ষর। তাই বলে সবাই ওই সময় তা বিশ্বাস করেছে তা কিন্তু নয়। দ্য ভিঞ্চিকে নির্ঘাৎ পাগল ঠাউরেছেন কেউ কেউ। রাইট ভাইরাও কম টিকা-টিপ্পনি হজম করেননি!
স্বভাবতই বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর জনক হারবার্ট জর্জ ওয়েলসও চলে আসেন। তার কল্পিত টাইম মেশিন, ইনভিজিবল ম্যান ভবিষ্যতের বৈজ্ঞানিক আবিস্কারের খোরাক। কল্পনায় তিনি ১৯০১ সালেই মানুষকে চাঁদে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ২১০০ সাল পর্যন্ত পৃথিবীতে যা যা হবে তার একটা ভবিষ্য-তালিকও দিয়ে গেছেন তিনি। তার কিছু কিছু ফলেও গিয়েছে ইতোমধ্যে। যেমন, আকাশ থেকে বোমা মেরে শহর গুড়িয়ে দেয়া, আকাশে যুদ্ধ, ব্যপক বিধ্বংসী মারণাস্ত্র আবিস্কার।
আরেক দিকপাল লেখক আইজাক আসিমভ ১৯৪০ সালেই পজিট্রনিক রোবট নিয়ে লেখা শুরু করেছেন। রোবোটিকস এর তিন মহান নিয়ম কিন্তু এই আসিমভই দিয়ে গেছেন। রোবট মানুষের ক্ষতি করতে পারবে না, রোবট অবশ্যই মানুষের আদেশ মেনে চলবে, রোবট নিজেকে রক্ষা করতে পারবে যে পর্যন্ত আগের দুই নিয়ম ভঙ্গ না হয়। রোবোটিকস এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই যুগে উপরোক্ত নিয়ম অবশ্যম্ভাবী।
আমরা ইলোন মাস্কের কথা বলছি। ইলেকট্রিক গাড়ি টেসলার কর্ণধার মাস্ক কিছু স্বপ্নের কথা বলছেন। তিনি স্বপ্নগুলো বাস্তাবায়নে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কোন কোনটা আট-দশ বছরের মধ্যেই হয়ে যাবে বলে তার বিশ্বাস। পরিবহনের মানুষ । সেসব নিয়েই ভেবেছেন বেশী। যেমন, আকাশ পথে পরিবহন। সিঙ্গাপুর থেকে নিউ ইয়র্কের সরাসরি ফ্লাইট এখন ১৮ ঘন্টা। এতটা সময় আকাশে বসে থাকার মানুষ কমে যাবে ভবিষ্যতে। কেমন হয় যদি মাত্র ৩০ মিনিটে এই পথ অতিক্রম করা যায়। ইলোন সে কথাই বলছেন। জেট এঞ্জিনের যুগ বিদায় নিবে। রকেট প্রযুক্তি এগিয়ে আসবে। মানুষ রকেটে চড়ে মহাশূন্যে যাবার পাশাপাশি শহর থেকে শহরে যাবে। সকালে লস এঞ্জেলস থেকে নাস্তা করে সিডনিতে মিটিং সেরে পুনরায় সিয়াটলে এসে লাঞ্চ করবে।
ব্রিটিশ প্রকৌশলী ব্রুনেল ১৮০০ সালে সংকুচিত বাতাস ব্যবহার করে রেলের বগি চালানোর পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। তার বানানো প্রোটোটাইপটা ব্রিটেনের ব্রুনেল জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। অনেক বছর পর বিষয়টা আবার জনসম্মুখে এনেছেন সেই ইলোন মাস্ক। এবার নামটা হয়েছে হাইপারলুপ। এ বছরই দুবাইতে প্রথম হাইপারলুপ ট্রেন চালু হবার কথা। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে বিপ্লব ঘটে যাবে পরিবহন প্রযুক্তিতে। ঘন্টায় আটশ-নয়শ কিলোমিটার বেগে যান চলবে। মানুষ প্লেনের চেয়েও আগে গন্তব্যে পৌঁছে যাবে।
বেশ কয়েকটি কোম্পানি হাইপারলুপ নিয়ে কাজ করছে। ইলোন মাস্কের স্পেসএক্স আছে, ভার্জিন হাইপারলুপ ওয়ান আছে, কানেইডিয়ান ট্রান্সপডও আছে। একটা স্টিলের টিউবের মধ্যে দিয়ে সংকুচিত বাতাসের সাহায্যে ক্যাপসুলের মত যান চলবে। রেল লাইনের মত কোন ট্রাকের উপর দিয়ে চলবে না সেটা। ফলে চাকার ঘর্ষণ থাকবে না, টিউবের মধ্যে থাকায় বাতাসের বাঁধাও থাকবে না। বাইরের ঝড়-বৃষ্টি কোন ব্যঘাত ঘটাবে না। ভ্রমণ হবে গতিময় এবং মসৃন।
স্পেসএক্স সমানে রকেট বানাচ্ছে। বাংলাদেশের নিজস্ব স্যাটেলাইটটিও এই স্পেসএক্সের রকেট দিয়ে পৃথিবীর কক্ষপথে পাঠানো হয়েছিলো। স্পেসএক্স মঙ্গলে বসতির কথা বলে আসছে। সেই পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে পুরোদমে। ইতোমধ্যে, রকেটের প্রোটোটাইপ তৈরী করা হয়েছে। শীঘ্রই পরীক্ষামূলক চলন শুরু হবে রকেটের। ইলোন মাস্ক ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে সহজলভ্য করতে কক্ষপথে বারো হাজার স্যাটেলাইট পাঠানোর পরিকল্পনা করেছেন। স্টারলিংক নামক এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য পৃথিবীর সব জায়গায় ওয়াইফাই সংযোগ দেয়া।
এদিকে, শহরের মধ্যেও গণপরিবহনে পরিবর্তন আসছে বিস্তর। প্রচলিত রাস্তার ধারণা বাদ দিয়ে ভূগর্ভে ছোট আকারের টানেল বানানো হবে। যার মধ্যে দিয়ে একটা করে গাড়ি স্বচ্ছন্দে চলাচল করবে। মজার বিষয় হচ্ছে এসব গাড়ির কোন ড্রাইভার থাকবে না। পুরো শহর জুড়ে অসংখ্য টানেল থাকবে। এমনকি একটার নীচে আরেকটা করে পঁঞ্চাশ তলা পর্যন্ত হতে পারে। মাস্কের ধারণা হলো উড়ন্ত গাড়ির চেয়ে ভূমির নীচের গাড়ি অনেক কার্যকরী হবে। সেই গাড়িগুলো ব্যাটারি চালিত হবে। টেসলার গিগাফ্যাক্টরিতে অসংখ্য ব্যাটারি সেল তৈরি হচ্ছে প্রতিদিন। আমেরিকাতেই টেসলার তিনটি গিগাফ্যাক্টরি আছে। ইউরোপ আর চীনে একটি করে তৈরি হচ্ছে। ফসিল ফুয়েলের যুগ শেষ হলো বলে।
সিএনএন এর সাথে এক সাক্ষাৎকারে ইলোন মাস্ককে প্রশ্ন করা হয়েছিলো মানুষ কীভাবে মঙ্গলের বৈরী পরিবেশে বাস করবে। মাস্কের জবাব ছিলো- উষ্ণতা বাড়িয়ে দিলেই মঙ্গল পৃথিবীর মতই একটি গ্রহ হয়ে যাবে। পরবর্তী প্রশ্ন ছিলো, কীভাবে উষ্ণ হবে মঙ্গল? মাস্কের জবাব, দু’টি পদ্ধতি আছে – একটা দ্রুত আরেকটি দীর্ঘ। কোন শুনতে চাও? সিএনএন এর স্টিফেন কোলবার্ট বললেন, দ্রুতটাই শুনি। মাস্কের চটপট জবাব, কিছু নিউক্লিয়ার বোমা ফেলে দিলেই হবে। স্টিফেন সাথে সাথেই বলে উঠেন, তার মানে ইউ আর আ ভিলেন! ইলোন মাস্ক হাসেন।
ভবিষ্যৎই বলে দিবে, ইলোন মাস্ক হিরো না ভিলেন। তখন পর্যন্ত মাস্কের স্বপ্নগুলো বাস্তবে দেখার অপেক্ষায় থাকি।
লেখক: কানাডায় জিওটেকনিকাল বিভাগে কর্মরত।