মণিদীপা দাশ
মৃত্যু শূন্যস্থান তৈরি করে। শূন্য দিয়ে যাই গুণ করা হোক তা যেমন শূন্য হয় তেমনি কোন কিছুর বিনিময়ে মৃত্যুর শূন্যতা পূর্ণ হয় না। কষ্টের শূন্যস্থান শূন্যই থাকে। অনুকূল পরিবেশ পেলে ঠিকই কষ্টগুলো ডালপালা মেলে দেয়। তাই প্রিয়জন হারানোর শূন্যতা কোনো গুণে পূর্ণ হয়না বা ভাগ করেও খুব প্রশমিত করা যায় না। কখনও কখনও হিসাব মেলেনা মৃত্যু সমীকরণেরও। এটি অসীমের পানে ধায়। এই শূন্যতা বা অসীম শূন্যেতা মহাকাল থেকে মহাকালে প্রবাহিত হচ্ছে প্রকৃতির নিগূঢ়তম লীলায়।
যখন দেহ থেকে আত্মার বিচ্ছেদ ঘটে সেটিই মৃত্যু। যা অবশ্যম্ভাবী এবং অবধারিত সত্য। যা প্রকৃতির বিচিত্র খেলায় ভরা। নজরুল বলেছেন,
” খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে।
প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা নিরজনে প্রভু নিরজনে “।
যদি অন্তরে স্রষ্টা প্রোথিত থাকে, তবে চিরবিচ্ছেদর কষ্টও তুচ্ছজ্ঞান করা যায়। মৃত্যুর মাধ্যমে অসীমের পানে আত্মার যে যাত্রা সেখানে রবীন্দ্রনাথ খুঁজে পেয়েছেন এক মহামিলনের আবহগীত–
“তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি ধাই-
কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই।”
আমাদের মনে করিয়ে দেয় সেই শাশ্বত সত্য –
‘জন্মিলে মরিতে হবে’
আর এভাবেই গুহাবাসী মানুষ কোটর থেকে বেরিয়ে এসে ক্রমে ক্রমে গড়ে তুলেছে এই তিলোত্তমা সভ্যতা, এগিয়ে নিয়েছে এই পৃথিবীকে। ছুরি, ব্যান্ডেজ, কাঁটাচামচ হাতে নিয়ে সেবার অর্ঘ্য সাজিয়েছে। মানুষকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে মানুষ। ভালোবাসার জন্য মৃত্যুকেও বরণ করতে পিছপা হয়নি এই মানুষ। মানুষের মধ্যে যে অসীমের বাস রয়েছে তার শক্তি অপ্রতিরোধ্য। অপ্রতিরোধ্য এই শক্তি দিয়ে মানুষ মানুষের জন্য উপহার দিয়েছে আধুনিকতম চিকিৎসা ব্যবস্থা, যা জীবনকে এনে দিয়েছে জীবনের বিচরণের জন্য আরও কিছু বাড়তি সময়। বৈশ্বিক যোগাযোগের উৎকর্ষতায় সৃষ্টি হয়েছে পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ার অপরিসীম সুযোগ।
তবে এর বিপরীতে চিত্রও রয়েছে, রয়েছে সভ্যতার সংকট। এই সংকট পৃথিবীতে এনে দিয়েছে যুদ্ধের বিভীষিকা, পারমাণবিক মারণাস্ত্র। কালে কালে পৃথিবী দেখেছে অকারণ মৃত্যুর মিছিল। সৃষ্টি হয়েছে লোভ ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব । বৃদ্ধি পেয়েছে ধনী ও ধনহীনের ব্যবধান। মানুষের হাতে মরছে মানুষ। কিন্ত এমন অকাল মৃত্যুতো কামনা করেনা কেউ!
অকাল মৃত্যু অনেকগুলো সংযোগবিন্দুকে অকস্মাৎ স্থবির করে দেয়। যেমন, একজন ব্যক্তি পরিবার, কর্মস্থল, সমাজ, রাষ্ট্র, এমনকি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সম্পৃক্ত থাকেন। আকস্মিক মৃত্যু সেই সকল সংযোগ বিন্দুগুলোকে শূন্যতা তৈরি করে। যা নির্ভরশীলদের সংকটে ফেলে, ফলে তারা মুষড়ে পড়েন।
বিজ্ঞান মহামারিসহ প্রাকৃতিক কারণে মানুষের অকাল মৃত্যু রোধে বিরামহীন কাজ করছে। ইতিমধ্যে আবিষ্কৃত হয়েছে কলেরা, যক্ষা, গুটি বসন্ত, পোলিও, চিকেন পক্সসহ বিভিন্ন মহামারির টিকা। হয়তো অচিরেই আবিষ্কার হবে করোনার টিকা। কিন্তু বিজ্ঞান আবিষ্কার করতে পারেনি হিংসা, বৈরিতা, বৈষম্য, বিভেদ, দম্ভ, ধর্মান্ধতা, লোভ ও ঘৃণার কারণে মানুষের অকাল মৃত্যুর বিরুদ্ধে কোন টিকা। বিজ্ঞানের অপব্যবহারের সৃষ্ট পারমানবিক অস্ত্রের বিস্তারও রুখতে পারেনি বিজ্ঞান। প্রকৃতি ও বন্য প্রাণীর ধ্বংসযজ্ঞও প্রতিরোধের ক্ষমতা নেই বিজ্ঞানের।
এগুলো মানুষের হাতে। এর সবকিছুতেই এগিয়ে আসতে হবে মানুষকে। শোধরাতে হবে নিজেকে। খুলে ফেলতে হবে সকল অন্যায়ের খোলস, দম্ভের রাজবেশ। মনের আয়নায় দেখতে হবে নিজের স্বরূপ। দেখতে হবে বাড়ির পাশেই রয়েছে আরশিনগর।
“বাড়ির পাশে আরশিনগর
সেথা পড়শি বসত করে
আমি একদিন না দেখিলাম তারে।”
আরশি নগরের পড়শিকে আর কবে দেখবে বিশ্ববিবেক? এখনই সময়, মনের দর্পণে স্বরূপ দেখে নেওয়ার ; এখনই সময় নিজেকে শোধরে নিয়ে, হিংসা ভুলে আরও উন্নত মানুষরূপে আবির্ভূত হওয়ার।
এখনি সময় অকাল মৃত্যুকে জয় করে এক মানবিক পৃথিবী গড়ার ;
যে পৃথিবীতে থাকবে –
“লোভহীন শান্তির বাস,
মানবতা-ভালোবাসা এক হয়ে দুঃখ বিনাশ।”
লেখকঃমণিদীপা দাশ— কণ্ঠশিল্পী ও পোশাক ডিজাইনার