বিভুরঞ্জন সরকার
এ বিষয়ে ২৫ এপ্রিল কিছু লিখেছিলাম। সাংবাদিক বন্ধুদের কাছে যেমন প্রতিক্রিয়া আশা করেছিলাম, তেমন পাইনি। সবাই নিশ্চয়ই ঝুঁকিপূর্ণ পেশাগত দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত। আমার লেখায় হয়তো মন্তব্য করার মতো কোনো উপাদানও ছিল না। যাক, একই প্রসঙ্গে আরো কিছু কথা। আমাদের দেশে গণমাধ্যমের অবস্থা যে খুব ভালো নয়, সেটা বোঝার জন্য কোনো গবেষণার দরকার নেই।
সামরিক ডিক্টেটর এরশাদের পতনের পর গণতন্ত্রের পালে হাওয়া লাগে। সেই সুবাদে গণমাধ্যমেরও ব্যাপক প্রসার ঘটে। অনেক দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ হয়। এর পাশাপাশি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলেরও সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। শত ফুল ফোটার আনন্দে আমরা বগল বাজাতে থাকি। অনেকের কর্মসংস্থান হয়। সাংবাদিকের সংখ্যা বারে।
তবে এখন আমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছি যে, দেশে গণমাধ্যমের সংখ্যা বাড়লেও গুণগত মান বাড়েনি। গণমাধ্যমের মালিকদের সুবিধা হলেও সাংবাদিকদের সমস্যা বেড়েছে। গণতন্ত্রের সুবাদে আমাদের দেশের রাজনীতি যেমন চলে গেছে ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে, তাতে রাজনীতির বারোটা বেজেছে, তেমনি গণমাধ্যমের মালিকরাও মূলত ব্যবসায়ী-শিল্পপতি হওয়ায় গণমাধ্যমেরও ‘সর্বনাশ’ হয়েছে। ‘
মুক্ত’ গণমাধ্যমের জন্য যারা হাহাকার করেন, তারা বুঝতে চেষ্টা করেন না, ব্যবসায়ীরা নিজেদের ‘মুক্ত’ লাভের বিষয় ছাড়া অন্য কোনো মুক্তি বোঝেন না। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এখন কার্যত মালিকদের স্বাধীনতা। মালিকরা যেভাবে চান সেভাবেই সব কিছু চলে। সাংবাদিকদের কোনো স্বাধীন বা স্বতন্ত্র অবস্থান নেই বললেই চলে। পেশাজীবী সম্পাদক নেই তা বলা যাবে না, তবে তারা মূলত মালিকের স্বার্থ দেখভালের জন্যই নিয়োজিত হন। মালিকের হয়ে লবিং করা অনেক সম্পাদকের অন্যতম কাজ।
একসময় বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শের বাহক হিসেবে সংবাদপত্র প্রকাশিত হতো। তখন বড় শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরা পত্রিকা প্রকাশের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়তেন না। মোটামুটি স্বচ্ছল এবং রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকেই পত্রিকা বের করা হতো। দৈনিক আজাদ ছিল মুসলিম লীগের কাগজ। এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মওলানা আকরম খাঁ সক্রিয় মুসলিম লীগ করতেন। তবে পত্রিকায় সংবাদ পরিবেশনে পক্ষপাত কম থাকতো।
বঙ্গবন্ধু ‘কারাগারের রোজনামচা’য় ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬-দফা আন্দোলনের সময় আজাদের সংবাদ পরিবেশনের প্রশংসা করেছেন। আজাদ মুসলিম লীগের কাগজ হলেও এখানে কাজ করেছেন বামপন্থী চিন্তার সন্তোষ গুপ্ত। কোনো সমস্যা হয়নি। এখন এটা ভাবা যায়?
দৈনিক ইত্তেফাক আওয়ামী লীগের কাগজ হিসেবে পরিচিত ছিল। আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর ক্ষেত্রে ইত্তেফাকের ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না।
ইত্তেফাকের সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন ছিলেন না। কিন্তু ইত্তেফাকে কাজ করেছেন সুপরিচিত কমিউনিস্ট আহমেদুর রহমান (ভীমরুল), আলী আকসাদ। কোনো সমস্যা হয়নি। দৈনিক সংবাদ ছিল বামপন্থীদের কাগজ (যদিও প্রথমে মুসলিম লীগেরই ছিল)। এই যে রাজনৈতিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে কাগজগুলো চলতো, তাতে কি পাঠকের কোনো আপত্তি ছিল?
আমাদের যারা প্রবাদপ্রতীম সাংবাদিক তারা সবাই কোনো না কোনো রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। মওলানা আকরম খাঁ, শামসুদ্দিন আবুল কালাম, আব্দুস সালাম, মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরী, শহিদুল্লাহ কায়সার, আবু জাফর শামসুদ্দিন – কেউ রাজনীতি-নিরপেক্ষ ছিলেন না। বরং রাজনীতির প্রতি তাদের সবারই বিশেষ পক্ষপাত ছিল। কিন্তু সবাই ছিলেন পেশাগত ক্ষেত্রে সৎ এবং নিষ্ঠাবান। ভালো সাংবাদিক হওয়ার জন্য ‘রাজনীতি’ যে কোনো সমস্যা নয়, সেটা বলা যায়। তাহলে এখন আমরা সব কিছুর জন্য রাজনীতিকে কেন দায়ী করি?
কারণ সম্ভবত এটাই যে রাজনীতি এখন আগের মতো নেই। ভালো রাজনীতি পরাজিত হয়েছে। খারাপ রাজনীতির উত্থান ঘটেছে। ভালো রাজনীতি ভালো সাংবাদিকতাকে উৎসাহিত করেছে, পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। এখন খারাপ রাজনীতি ‘প্রমোট’ করছে মন্দ সাংবাদিকতাকে। যারা সৎ, যারা নিষ্ঠাবান – তারা এখন অযোগ্য বলে বিবেচিত। ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে। তবে সেটা আলোচনায় আসার মতো নয়।
বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকারহীনতা নিয়ে অনেক কথা বলা হয়। এর জন্য সরকারকে দায়ী করা হয়। অবশ্যই নাগরিকের কণ্ঠরোধের দায় সরকারেরই। সরকার আনুগত্য চায়। প্রশংসা চায়। তবে বিরোধিতা করলেই তাকে জেলফাঁসি দেওয়ার ঢালাও অভিযোগ করাও যুক্তিহীন।
প্রশ্ন হলো, স্বাধীন গণমাধ্যমের বিকাশের পথে মালিক-সম্পাদকদের কী কোনো ভূমিকা নেই? গণমাধ্যমকে নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে ব্যবহারের জন্য আগ বাড়িয়ে কর্তাভজা কীর্তন কী মালিকরা গাইতে বাধ্য করেন না চাকরিজীবী সাংবাদিকদের ?( চলবে)
লেখকঃ বিভুরঞ্জন সরকার সিনিয়র সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক ও লেখক।