তৃপ্তি সাহা
টুং টাং শব্দ তুলে দু’একটা রিক্সা যেত। তারই ফাঁকে আইসক্রিম বিক্রেতা ঘন্টি বাজিয়ে আ- ই-সক্রিম আ-ই-সক্রিম বলে বলে পাড়া-মহল্লার মধ্যে দিয়ে সাদা, হলুদ, কমলা রংয়ের আইসক্রিম বিক্রি করতো। একটা সাধারণ আইসক্রিম ছিল, অন্যটা দুধ মালই ছিল । দুধমালাই আইসক্রিমের অসাধারণ স্বাদ ছিল। দামও একটু বেশি ছিল।
সাধারণ আইসক্রিম পাঁচ পয়সা হলে, দুধমালাই আইসক্রিমের দাম দশ পয়সা ছিলো। তখন দোকানপাঠ ছিলো সীমিত। কিছু মানুষের হাতে টাকা থাকলেও বাহুল্য ছিলো না মননে। তখন মানুষের নীতিবোধ আজকের সাথে কিছুতেই কোন ভাবে মিলানো যাবে না।
বাংলাদেশ মাত্র স্বাধীন হয়েছে। নদী, নালা, পুকুর, খাল-বিল ছড়া কিছুই ঠিকঠাক ছিলো না। মাটির ঘর, টিনের ঘর, ছনের ঘর, দালান বাড়ি, কলকারখানা, রেললাইন সব সব পুড়িয়ে দিয়েছে হানাদার বাহিনী।
সেই পোড়া মাটির উপর দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গড়ার জন্য জাতীয় চার নেতাকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। চারটি স্তম্ভের উপর দাঁড় করাতে চাইলেন বাংলাদেশকে। বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গড়ার জন্য বদ্ধকর। অসাধারণএকটা স্বপ্নদেখতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।
সবুজেশ্যামলে ভরে উঠলো বাংলাদেশ। বিশ্বের মানচিত্রে জ্বলজ্বল করে উঠলো বাংলাদেশের নাম। শুরুতেই সকল নিয়ম ভঙ্গ করে জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়ে বিশ্ব দরবারে বাঙ্গালির চিরআসন করে দিলো জাতির পিতা।
‘আয় বুঝে ব্যয়’ এই ছিলো মানুষের মুল মন্ত্র। ইংরেজিতে বলে ‘কাট ইউর কোট ,এর্কোডিং ইউর ক্লথ’। সেখানে মানুষ কিছু খরচ কিছু সঞ্চয় করেছে, করেছে কিছু দান। বঙ্গবন্ধু আরও চাইতেন সব শ্রেণীপেশার মানুষের মেলবন্ধন। বিভেদ কমিয়ে মানুষকে ‘মানুষের’ মর্যদা দেওয়া। কারন মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। মানুষ একা বাস করতে পারেনা।
এক পেশার মানুষ অন্য পেশার মানুষের উপর নির্ভরশীল। একটা খুব সহজ কথা বলি, একজন কৃষকের জীবনে কোনদিন কোন আমলার কাছে না গেলে কোন ক্ষতি হবেনা , কিন্তু একজন আমলা কৃষকের কাছ থেকে তার অন্নের সংস্থান করার জন্য সারাজীবন ঋণী থাকতে হবে। তাই বঙ্গবন্ধু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতো সমাজ রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে আছে এই শ্রমজীবি মানুষকে ঘিরে। কিন্তু কিছু মানুষের বঙ্গবন্ধুর এই কথাগুলো পছন্দ হলো না।
আর তাই অতি অল্প সময়ে হত্যা করা হলো তাঁকে, করা হলো তাঁর সহোযোদ্ধাদের। সেদিন থেকেই বাঙ্গালির মরণ হলো। আমরা ‘পিতৃহন্তা’ র খাতায় নাম লিখালাম। কথায় আদর্শে আমাদের কে শিখানো হলো ভুলে ভরা নৈতিকতা দিয়ে। আমরা হাঁটলাম পিছনের পথে। সামাজিক আভিজাত্য বাড়ানোর জন্য ধর্মের লেবাস পড়ে আমাদের সচেতন , গতিশীল সংস্কৃতি, মূল্যবোধকে গলাটিপে হত্যা করা হলো ‘সুকৌশলে’।
প্রসাধনীর আড়ালে ঢাকা পড়লো আমাদের সত্যিকারের সৌন্দর্য, ইটপাথরের নীচে ঢাকা পড়ে গেল সবুজশ্যামলীমার বাংলাদেশ। যে কথায় ছিলাম — এখন কী বলা হচ্ছে ? বলা হচ্ছে ‘ব্যায় বুঝে আয় কর’। এখন কথা হলো ব্যয় কতটুকু—-পরিমান নির্ধরিত নয়? তার কোন সীমাবদ্ধতা নেই। তাই মানুষ ছুটছে আর ছুটছে। যার যোগ্যতা আছে সেও ছুটছে, যার যোগ্যতা নেই সেও ছুটছে। ফলে হলো কী যার যোগ্যতা নেই সে অবৈধ পথে ছুটছে। কারন ব্যয় বুঝে আয়ের যোগান দিতে হবে।
বেড়ে গেলো চোরের সংখ্যা। আগে ঘরের সিদ কেটে চুরি করতো চোরের মত। আর এখন চোরেরা বলে ‘বিশেষ যোগ্যতা ’ থাকতে হয় চুরি করার জন্য এবং পুরুষ্কৃত হতে থাকলো।
এজন্য এই মহামারির মধ্যে যখন এই শ্রমজীবি মানুষগুলো বেকার হয়ে গেলো, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বয়স, ঘুম সমস্ত কিছু উপেক্ষা করে তাদেরকে দু’মুঠো খাবার এর জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে, তখন একর পর এক চাল চোরের খবর আসছে। চালচোর এতদিনও ছিলো । বিভিন্ন কিসিমের চোর তৈরি হয়েছে।
আজ এই মহামারি করোনা ভাইরাসের জন্য সব গৃহবন্দী। রাস্তাঘাট ফাঁকা। চোরেরা এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করতে পারছে না। ফাঁকা জায়গায় চুরি করা বিপদজনক। এর মধ্যেও আছে কিছু নজরদারি। আছে সজাগ মিডিয়া কর্মীরা। করোনার এই মহামারির সময় আমাদের উচিত শিক্ষা নেওয়া। আমরা একা বাঁচতে পারবোনা। সকল শ্রেণীপেশার সকল লোক যেন সমঅধিকার নিয়ে বাঁচতে পারি। এই যুদ্ধ সকল যুদ্ধের ভয়াভয়তাকে পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। বেঁচে থাকুক নৈতিকতা, সহমর্মিতা, আদর্শ সংস্কৃতি, ঐতিহ্য। কৃষিনির্ভর হয়েউঠুক বাংলাদেশ।
এদেশ সম্পর্কে শাশ্বত কাব্যিক উক্তি: ‘সুজলাং সুফলাং মলয়জশীতলাং শষ্যশ্যামলাং’। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে উঠার এই মোক্ষম সময়। ভালো থাকুক বাঙ্গালি , ভালো থাকুক বাংলাদেশ।
তৃপ্তি সাহা
গ্রন্থাগারিক ও লেখক