আজ ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। আজ থেকে ঊনপ াশ বছর আগে এই দিনে বাংলাদেশের পূর্ব দিগন্তে যে সূর্যটি উদিত হয়েছিল, তা বয়ে এনেছিল এক নতুন বার্তা, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুখবর। ২৩ বছরের সীমাহীন শেষণ-ব না এবং নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর এদিন আমরা মুক্তিলাভ করি পাকিস্তানী শাসকদের নির্মম অত্যাচার-নির্যাতন ও শোষণের কবল থেকে। এদিনেই বাংলা নামের এ দেশটি আমাদের হয়।
আমাদের জাতীয় জীবনে ১৬ ডিসেম্বরের গুরুত্ব অপরিসীম। এ দিবসটি শুধু আমাদের স্বাধীনতার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় না, সে সাথে মনে করিয়ে দেয় আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথাও। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব ও আহ্বানে যে মুক্তিযুদ্ধে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, ত্রিশ লাখ মানুষের প্রাণ ও দুই লাখ নারীর সম্ভ্ররমের বিনিময়ে আমরা তা অর্জন করতে সক্ষম হই। এ স্বাধীনতা কারো দয়ার দান নয়, কারো অনুগ্রহে প্রাপ্ত নয়। এক সাগর রক্তের দামে আমরা স্বাধীনতা কিনেছি। তাই এ স্বাধীনতার গুরুত্ব আমাদের কাছে সবকিছুর ঊর্ধ্বে।
আজ ঊনপ াশ বছর পরে আমাদেরকে হিসাব মিলাতেই হবে, যে আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে আমরা দেশকে একদিন স্বাধীন করেছিলাম, তার কতটুকু আমরা অর্জন করতে পেরেছি। এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, স্বাধীনতার যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম, তার অনেকটাই এখনও অপূর্ণ রয়ে গেছে। এই অপূর্ণতা, এই অক্ষমতার দায় কারো একার নয়, পুরো জাতির। আমরা নাগরিকরা আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারিনি বলেই আজও স্বাধীনতার অনেক স্বপ্নই অপূর্ণ রয়ে গেছে। এর মূলে রয়েছে রাজনৈতিক বিভক্তি। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক মতভেদ অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে, জাতীয় স্বার্থে কোনো কোনো বিষয়ে ঐকমত্য অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় বা সঙ্কটের সময়েও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না। জাতীয় স্বার্থকে তারা বড় করে না দেখে দলীয় সংকীর্ণ স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয়। এর অবশ্যাম্ভাবী প্রতিক্রিয়ায় গোট জাতি হয়ে পড়ে বিভক্ত, যা কখনোই একটি দেশ বা রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না।
একটি সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম আমরা। কিন্তু তা যে আজো সোনার হরিণ রয়ে গেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আজও সন্ত্রাসীদের হাতে মানুষ খুন হয়, দুর্বৃত্তের হাতে সম্ভ্রম হারিয়ে চিৎকার করে অসহায় নারী। দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে বিদেশে পাচার করছে একদল অর্থগৃধœু। সমাজবিরোধীরা অবৈধ পথে টাকার পাহাড় গড়ার লোভে দেশকে বানিয়ে ফেলেছে মাদকের স্বর্গরাজ্য। যে যুবকরা আগামীতে দেশকে নেতৃত্ব দেবে, তাদের একটি অংশকে নির্জীব ও পঙ্গু করে দেয়া হচ্ছে নেশার ছোবলে। আর সেজন্যই সমাজচিন্তকরা উদ্বিগ্ন জাতির ভবিষ্যত নিয়ে। দুর্নীতি, অনিয়ম, মাদকের বিস্তার, সামাজিক ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন আমাদের অগ্রগতির সামনে যে পাহাড়সম গাতিরোধাক, সে কথা বিশিষ্টজনেরা বরাবর বলে আসছেন। কিন্তু শত চেষ্টাতেও অবস্থার উন্নতি করা যাচ্ছে না। শঙ্কার বিষয়টি এখানেই।
আগামী বছর আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করতে যাচ্ছি। একটি রাষ্ট্রের জন্য তার জন্মের অর্ধশতবার্ষিকী পালন কম কথা নয়। দীর্ঘ এই পথ পরিক্রমায় আমরা অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে এসেছি। নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে আমরা উন্নয়নের মহাসড়কে হাঁটতে শুরু করেছি। প্রবেশ করতে যাচ্ছি মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে। এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হলে আমাদের সবার জাতীয় চেতনাবোধকে আরো শানিত করতে হবে। ব্যক্তি, গোষ্ঠী কিংবা দলীয় স্বর্থের ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে জাতীয় স্বার্থকে। তাহলেই যে স্বপ্ন নিয়ে আমরা ১৯৭১ সালে যুদ্ধ কওে দেশকে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত করেছিলাম, সে স্বপ্ন পূরণ হবে। বিজয়ের এই ঊনপ াশতম বার্ষিকীর শুভলগ্নে আমরা সে প্রত্যাশার কথাই পুনর্ব্যক্ত করতে চাই।
সবাইকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।