গত শতাব্দীর আশির দশকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ‘একটি সেতুর গল্প’ নাটকটির কথা অনেকেরই হয়তো মনে অছে। কোনো এক গ্রামীণ জনপদের নদীর ওপর সেতু নির্মানের উগ্যোগের বিরুদ্ধে স্থানীয় স্বার্থান্বেষী মহলের চক্রান্তের বিষয়টি ওই নাটকে অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে তুলে ধরা হয়েছিল। নাটকটিতে দক্ষ অভিনেতা হুমায়ূন ফরিদীর অত্যন্ত সাবলীল অভিনয় সবার প্রশংসা কুড়িয়েছিল। নটকটিতে সেতু নির্মানের একজন প্রকৌশলীকে খুন করা হয়। কিন্তু তারপরও সেতুটি নির্মিত হয়। গল্পের নতুনত্ব এবং অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয় গুণে নাটকটি বিপুল দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল। সম্ভবত দর্শক চাহিদার কারণে নাটকটি পুনঃপ্রচার করেছিল বিটিভি কর্তৃপক্ষ।
আজ প্রায় সাঁইত্রিশ বছর পরে আবার লেখা হলো একটি সেতুর গল্প। হ্যাঁ, আমরা বাংলাদেশের জনসাধারণের স্বপ্নের সেতু ‘পদ্মা সেতু’র কথাই বলতে চাচ্ছি। যে সেতুর সব কয়টি স্প্যান বসানোর সাথে সাথে এদেশের মানুষের সে স্বপ্ন ছুঁয়েছে আকাশ। গতকালে সর্বশেষ স্প্যানটি বসার সাথে সাথে প্রমত্তা পদ্মানদীর দু’পাড়ের অধিবাসীরা ফেটে পড়েছেন উল্লাসে।অমর কণ্ঠশিল্পী মান্না দে’র গাওয়া সেই গান ‘এই কূলে আমি, আর ওই কূলে তুমি/ মাঝখানে নদী ওই বয়ে চলে যায়’- এখন পদ্মার দুই পাড়ের মানুষের কাছে অতীত। এখন দুই পাড়ের মাঝে সেতুবন্ধ রচিত করলো পদ্মা সেতু। এই সেতু এখন আর শুধুই সম্ভাবনা নয়, বস্তবায়িত হওয়াটা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এই সেতুর পেছনের গল্পটি সুখকর নয়। কীভাবে একটি মহল কেবল মাত্র রাজনৈতিক বিভেদের কারণে এটি নির্মানের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করতে চেয়েছিল, সে গল্প সবার জানা। কাদের অপপ্রচারের কারণে বিশ^ ব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মানে অর্থায়নের প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নিয়েছিল, তাও সবাই জানেন। কত কথাই না হয়েছে এই পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে! দায়িত্বশীল (!) কোনো কোনো ব্যক্তির মুখে শোনা গেছে- ‘আওয়ামী লীগের আমলে এ সেতু হবে না। হলেও জোড়াতালি দিয়ে বানানো সেতুতে কেউ উঠবেন না। অনেক রিস্ক আছে’ জাতীয় বালখিল্য কথা।। আজ সেসব অপপ্রচারকে মিথ্যে প্রমাণ করে পদ্মা সেতু তার অস্তিত্ব ঘোষণা করছে সদম্ভে।
আন্তরিক ইচ্ছা এবং দৃঢ়তা থাকলে যে কোনো কঠিন কাজ সম্পন্ন করা যে অসম্ভব নয়, পদ্মা সেতু তার সবচেয়ে জাজ¦ল্যমান উদাহরণ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা বলেছিলেন, কারো সাহায্যের দরকার নেই। আমরাই পদ্মা সেতু বানাবো নিজেদের টাকায়। তিনি কথা রেখেছেন। এখানেই শেখ হাসিনার অনন্য বৈশিষ্ট্য। পিতার মতোই তিনি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ এক নেতা; যিনি জাতিকে কঠিন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে পারেন। তিনি শুধু মুখে বলেন নি, করেও দেখালেন কোনো কাজই কঠিন নয়, যদি তা আন্তরিকতা নিয়ে করা হয়। যদি স্বপ্ন বাস্তবায়নের দৃঢ় ইচ্ছা মনে জাগে, তাহলে স্বপ্ন সহজেই বাস্তব হয়ে ধরা দেয়। ক’বছর আগে কে ভেবেছিল যে, প্রমত্তা পদ্মাকে বশে এনে তার দুই পাড়কে এক করে দেয়া সম্ভব হবে? যেটা ছিল একদিন শুধুই স্বপ্নের বিষয়, আজ তা বাস্তবে রূপ নেয়ার দ্বারপ্রান্তে। আর এজন্য বাংলাদেশের মানুষ চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। তারা অদম্য ইচ্ছা আর ঐকান্তিকতাই যে এ অসাধ্য সাধনের মূল মন্ত্র সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আগামী বছরের বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের মধ্যেই সেতুটি জনসাধারণের চলাচালের জন্য খুলে দেয়া হবে। আমরাও চাই আগামী বছরের বিজয় দিবসে যেন এই সেতুর ওপর দিয়ে এপারের মানুষ ওপা,ওপারের মানুষ এপারে এসে বিজয় দিবসের উৎসবে অংশ নিতে পারে।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে আমরা পেয়েছিলাম এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধের বিজয়, আজ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর প্রাক্কালে তেমনি বিজয়ের এক অনাবিল আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের মানুষ। তারা এখন প্রাণ খুলে বলতে পারছে-‘আমরাও পারি’। আমরা শত্রুকে হটিয়ে স্বাধীনতা আনতে পারি, আমরা সব বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে পদ্মা সেতুর মতো বড় কাজও সম্পন্ন করতে পারি। জাতির এ অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক, আশা জাগানিয়া এই দিনে এটাই আমাদের কাম্য।