২০২৪ সালে আসছে ভয়াবহ এল নিনো
প্রকাশ : 2024-01-16 15:29:25১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
ক্লাইমেট চেইঞ্জ বা গ্লোবাল ওয়ার্নিং এই শব্দ দুটো খুবই পরিচিত । কিন্তু এর ভয়াবহতা নিয়ে আমরা চিন্তিত না। তবে এর ভয়াবহতা প্রখর হতে দেখা যাবে ২০২৪ সালে।.ধারণা করা হচ্ছে এই বছর আসবে এল নিনো। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হবে ভারত, বাংলাদেশ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকা।
২০২৩ সালে এক বছরেই তিন তিনটি ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ে বাংলাদেশে। বর্ষার পরে শীত জাঁকিয়ে বসতে বরাবরই প্রতি বছর কয়েকদিন টানা বৃষ্টি হয়; ঘূর্ণিঝড়ও হয় মাঝে মাঝে। বিষয়টি অনেকে এখন স্বাভাবিকভাবেই দেখছেন। কিন্তু এটি মোটেও এতো সহজভাবে নেয়ার মতো নয়। জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও আবহাওয়াবিদরা বিষয়টি নিয়ে বেশ চিন্তিতই বটে। কারণ, পৃথিবী এল নিনোর ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এল নিনোর কারণেই প্রকৃতির এলোমেলো আচরণ বেশ অস্বাভাবিকভাবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। এক বছরে তিনটি ঘূর্ণিঝড় এই এলোমেলো আচরণের নজির, যা গত ৫০ বছরেও হয়নি। এর সঙ্গে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সম্পর্ক আছে বলেও মনে করেন তারা।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ বরাবরই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকির তালিকায় অন্যতম। সেখানে এল নিনোর প্রভাব আরও শঙ্কা জাগাচ্ছে। ১৬ শতকে দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের একদল জেলে প্রথম খেয়াল করেন এ উষ্ণ সমুদ্রজল। এরপর থেকে দুঃস্বপ্নের মতো পৃথিবীতে প্রায়ই ফিরে আসে এল নিনো দশা। শেষবার ১৯৮২ সালে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয়েসবার, পৃথিবীর এক প্রান্ত ডুবে ছিল পানির নিচে, আর এক প্রান্তে চলছিল খরা, দাবানল ও প্রচণ্ড ঝড়। সে বছর দিনের দৈর্ঘ্য বেড়ে গিয়েছিল ০.০২ মিলি সেকেন্ড।
‘এল নিনো’ সম্পূর্ণ আলাদা একটি প্রাকৃতিক ঘটনা; যা কয়েক বছর পর পর হয়। মূলত এটি হচ্ছে, প্রশান্ত মহাসাগরের নিরক্ষরেখার দক্ষিণের আবহাওয়ার এলোমেলো আচরণ। যা আবহাওয়ার বিশেষ নেতিবাচক অবস্থাকে বোঝায়। প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্য ও পূর্ব অংশে সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা যখন স্বাভাবিকের চেয়ে ছাড়িয়ে যায় তখন তাকে এল নিনো বলা হয়। এর ফলে উপকূলীয় এলাকায় স্বাভাবিক বায়ুপ্রবাহ হারিয়ে যায়। এল নিনো খরা বা অনাবৃষ্টিকে ইঙ্গিত করলেও বিশেষজ্ঞদের মতে সাধারণত এর প্রভাবে ভারত মহাসাগর, ইন্দোনেশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া বরাবর ভূপৃষ্ঠে চাপ বেড়ে যায়। তাহিতি এবং পূর্ব ও মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরের বায়ুচাপ কমে যায়। দণি প্রশান্ত মহাসাগরের বাণিজ্য-বায়ু দুর্বল হয়ে পড়ে বা পূর্বদিকে বইতে শুরু করে। পেরুর সন্নিকটে গরম বাতাস ঘনীভূত হওয়ার কারণে পেরুর উত্তরের মরু-অঞ্চলে বৃষ্টিপাত শুরু হয়। ভারত মহাসাগর এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর থেকে গরম পানি ছড়িয়ে পড়ে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে। সঙ্গে করে নিয়ে যায় প্রচুর পরিমাণ জলীয় বাষ্প অর্থাৎ বৃষ্টি। ফলে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল খরায় পুড়তে থাকে, আর পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে প্রচুর বৃষ্টি হয়। চিলির আকাটামা মরুভূমি পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণ মরুভূমিগুলোর একটি। এল নিনোর প্রভাবে এই মরুভূমিও ফুলে ফুলে সুশোভিত হয়ে উঠেছে।
সাধারণত দুই থেকে সাত বছর পরপর এল নিনো পরিস্থিতি তৈরি হয়। যা ১৮ মাসের বেশি সময় পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে থাকে।বর্তমানে এল নিনোর প্রভাবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে চরম বিপর্যয় বয়ে নিয়ে এসেছে বলে বিজ্ঞানীদের ধারনা। এতে পেরু, ইকুয়েডর ও চিলিসহ উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় প্রচুর বৃষ্টিপাত, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও উপকূলে ভাঙনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ফলে এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার বহু জায়গায় বৃষ্টিপাত কমে আসবে। দেখা দেবে শুষ্কতা। খরা ও দাবানলের মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে বাংলাদেশ-ভারতসহ আশপাশের দেশগুলোতে।
সাধারণত বাংলাদেশে লা নিনার প্রভাব থাকে। যেটি এল নিনোর বিপরীত চিত্র। অর্থাৎ পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলীয় প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা যখন স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকে, তখন তাকে লা নিনা বলা হয়। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে বেশ কয়েকটি এল নিনোর আবির্ভাব ঘটেছে বিশ্বে। এর মধ্যে ২০১৬ সালে এল নিনো সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছিল। ওই বছর তাপমাত্রা বৃদ্ধির রেকর্ড অতিক্রম করে। এছাড়া ১৯৯৭-৯৮ সালে এল নিনোর প্রভাবে সারা বিশ্বে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। ঝড় ও বন্যায় মারা গিয়েছিল প্রায় ২৩ হাজার মানুষ।
চলতি বছরের একেকটি মাস শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বে উষ্ণতর মাস হিসেবে রেকর্ড হয়েছে যা ইতিহাসের উষ্ণতর বছর হতে যাচ্ছে বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন। বাংলাদেশে আবহাওয়ার ওপর মৌসুমি বায়ুর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে এল নিনোর প্রভাব- কোনোটা থেকেই রেহাই পাচ্ছে না বাংলাদেশ। এবার শীত ও গ্রীষ্মকাল দুটোই শুষ্ক। ভারত থেকে মৌসুমি বায়ু দেরিতে প্রবেশ করেছ। ফলে বৃষ্টিপাত কম হবে।
এল নিনোর প্রভাব পড়তে শুরু করায় পৃথিবী জলবায়ু পরিবর্তনের যে সমস্যায় ভুগছিলো সেই সমস্যা আরও বেগবান হয়েছে। আগামী ২০২৪ সাল ইতিহাসের উষ্ণতম বছর হতে পারেও বলে ধারণা করা হচ্ছে। চলতি বছর বাংলাদেশ যে তাপমাত্রার কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে তা আগামী বছর আরও ভয়াবহ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবের সঙ্গে যুক্ত এল নিনোর এই চক্র স্থানীয়ভাবে খরা ও ক্ষুধার পাশাপাশি প্রাণিবাহিত রোগ বাড়াবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। মশার উপদ্রব বাড়বে আরও বহুগুণে। চলতি বছরেই ডেঙ্গুর যে ভয়াবহ অবস্থা তা এখন থেকেই পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি মহাবিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাবে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের। ধানসহ বিভিন্ন ফসল কাটার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে এল নিনো। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশ এরই মধ্যে ফসল মজুত ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিচ্ছে। যেমন- ইন্দোনেশিয়ার কিছু অংশ দ্রুত ফসল কাটার পরিকল্পনা করছে। আশঙ্কার বিষয় হলো, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর গুরুত্বপূর্ণ শহর ও বৃহৎ নগরকেন্দ্রগুলো গড়ে উঠেছে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির আশঙ্কায় থাকা উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে। আর এ কারণে এসব এলাকায় অভিবাসীদের আগমনের হার প্রতিবছরই বাড়তে থাকে। যেহেতু এল নিনোর প্রভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়বে সে হিসেবে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন এলাকায় বাস্তুহারা মানুষের সংখ্যা বাড়বে।
২০০৮ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশের ৪৭ লাখেরও বেশি মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে। ২০১৯ সালের অর্ধবার্ষিকী প্রতিবেদনের হিসাব মতে, দেশের ২৩টি জেলা থেকে প্রায় ১৭ লাখ মানুষকে বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছে। যার বেশিরভাগই ঘটেছে বিভিন্ন উপকূলীয় জেলাগুলোতে। ২০৫০ সাল নাগাদ দেশে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে প্রায় দেড় কোটি। এছাড়াও প্রায় দুই কোটি শিশুর জীবন ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানবপাচারের মতো ঘটনা বাড়ার শঙ্কাও রয়েছে বলে জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক সংস্থা ইউএনওডিসির এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ২০২৭ সালের মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করার সম্ভাবনা রয়েছে ৬৬ শতাংশ। শুধু তাই নয়, জাতিসংঘের আবহাওয়া বিষয়ক সংস্থা ‘ডব্লিউএমও’-এর তথ্য অনুযায়ী আগামী পাঁচ বছর এযাবৎ কালের সবচেয়ে উষ্ণ সময় পার করতে পারে বিশ্ব।
সা/ই