হিমালয়কে ফ্রেমে বাঁধা এক নায়কের গল্প
প্রকাশ : 2022-10-12 12:23:15১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (১২ই অক্টোবর,১৯০২ - ১২ অক্টোবর, ১৯৯৭), একজন বিশিষ্ট ভারতীয় বাঙালি সাহিত্যিক, যাঁর প্রধান বিচরণক্ষেত্রটি হল বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ধারা, ভ্রমণ-কাহিনী। মণিমহেশ নামক ভ্রমণকাহিনীর জন্যে, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে, তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।
উমাপ্রসাদের জন্ম ইংরাজি ১৯০২ সালের ১২ই অক্টোবর (বাংলা ১৩০৯ সালের ২৬শে আশ্বিন) বিজয়াদশমীর দিন; কলকাতার ভবানীপুর অঞ্চলের রসা রোডের বিখ্যাত মুখোপাধ্যায় পরিবারে। তার পিতা ছিলেন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এবং মাতা ছিলেন যোগমায়া দেবী। আশুতোষ এবং যোগমায়ার সাতটি সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। বিজয়াদশমীর দিন জন্ম বলে, তার ডাকনাম ছিল বিজু। মা যোগমায়া দেবী ছিলেন অত্যন্ত সুন্দরী এবং সুরুচি সম্পন্না প্রগতিশীলা নারী, যাঁর প্রভাব অবধারিতভাবেই পড়েছিল সমস্ত সন্তানদের উপরে। শৈশবে উমাপ্রসাদ অত্যন্ত সুশ্রী দেখতে হলেও, তার শরীর স্বাস্থ্য ভালো ছিল না; ৫ বছর বয়সে টাইফয়েডে আক্রান্ত হন তিনি। শিশুকাল থেকেই লেখক ছিলেন মেধাবী, অন্তর্মুখী, পশুপ্রেমী এবং দরদী মনের মানুষ। তার ছেলেবেলার বিবরণ পাওয়া যায় তার রচিত প্রবন্ধ "আমার ছেলেবেলা" তে। হাতেখড়ির পরে, বাড়ির বিশাল লাইব্রেরীতেই শুরু হয় উমাপ্রসাদের প্রথম পাঠ। তার প্রথম শিক্ষক ছিলেন প্রিয়নাথ বসু এবং মহেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।
সাত বছর বয়সে ভবানীপুর মিত্র ইন্স্টিটিউশনে শুরু হয় তার প্রথাগত শিক্ষাজীবন। ১৯১৯ সালে উমাপ্রসাদ এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে। এরপর ১৯২১ সালে প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে আই এ পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করেন। এই পরীক্ষায় বাংলা রচনায় দক্ষতার জন্যে বঙ্কিমচন্দ্র রৌপ্য পদক এবং দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বৃত্তি ও পারিতোষিক, ভাষা ও অঙ্কে ভালো নম্বরের জন্যে ডাফ বৃত্তি, ইংরাজি ও অঙ্কের জন্যে সারদাপ্রসাদ পুরস্কার এবং পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার জন্যে স্টিফেন বিনে পদকপ্রাপ্ত হন। এরপর ঐ কলেজ থেকেই ১৯২৩ সালে ইংরাজিতে অনার্স সহ বি এ পাশ করেন প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করে। এরপরে ১৯২৫ সালে "প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি" বিষয়ে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে এম এ পাশ করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এরপর আইন পড়া শুরু করেন এবং ১৯২৮ সালে বি এল পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে সপ্তম স্থান অধিকার করেন।
প্রথম জীবনে উচ্চতম ন্যায়ালয়ের আইনজীবী হিসেবে কাজ করেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন কলেজে অধ্যপনা করেছেন দীর্ঘ কুড়ি বছর। অত্যন্ত আত্মগম্ভীর কিন্তু রসবোধে পূর্ণ লেখক আজীবন ছিলেন কর্তব্যনিষ্ঠায় অবিচল এবং অত্যন্ত নিয়মানুবর্তি ব্যক্তিত্ব। তার প্রখ্যাত ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম প্রাক্তন ভারতীয় শিক্ষামন্ত্রী প্রতাপ চন্দ্র চন্দ্র এবং সাংবাদিক অরুণ বাগচী। অধ্যাপনা ছাড়াও আইনজ্ঞ হিসেবেও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন তিনি। আলিপুর কোর্ট, বিড়লা কোম্পানীর লিগ্যাল আডভাইসার, বেঙ্গল লাইব্রেরির অর্থ দপ্তরের কাউন্সিল মেম্বার, চেয়ারম্যান, লিকুইডেটার এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যট্রিকুলেশন পরীক্ষার ট্যাবুলেটর হিসেবেও দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন তিনি। কর্মক্ষেত্রে নেতাজী সুভাষচন্দ্র, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সংস্পর্শে আসেন।
ভ্রমণ এবং পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধূলা নিয়েও তার সবিশেষ উৎসাহ ছিল। তিনি বেঙ্গল লন টেনিস আসোশিয়েশনের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং নিজে একজন টেনিস খেলোয়াড় ছিলেন। এছাড়াও ১৯৩২ সালে রেফারি ট্রেনিং নিয়ে পাশ করেন আই এফ এ থেকে এবং পরবর্তীকালে রেফারি আসোশিয়েশনের সদস্য ছিলেন তিনি। এছাড়াও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোয়িং ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। তিনি ভারতের প্রথম পর্বতারোহণ সংস্থা 'হিমালয়ান অ্যাসোসিয়েশন' এর প্রতিষ্ঠাতা। দার্জিলিঙের "হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট" এবং 'হিমালয়ান ক্লাব'-এর আজীবন সদস্য ছিলেন তিনি। খেলাধূলার পাশাপাশি সঙ্গীতেও তার দক্ষতা ছিল।
উমাপ্রসাদ ছিলেন এক অক্লান্ত পরিব্রাজক। যৌবনের প্রারম্ভে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে মাতৃদেবীকে নিয়ে প্রথম হিমালয় দর্শনে যান। তারপর অকৃতদার এই পরিব্রাজক দীর্ঘদিন হিমালয়ের পথে পথে ঘুরেছেন- পরনে গেরুয়া ফতুয়া আর লুঙ্গি, কাঁধে ঝোলা নিয়ে। পরে ঘুরে বেড়িয়েছেন গহন জঙ্গলে,রুক্ষ মরুভূমিতে, নৌকার যাত্রী হয়ে ভ্রমণ করেছেন সমুদ্রে। চিত্রাঙ্কন এবং চিত্রগ্রহণে তার গভীর জ্ঞান ছিল। অগণিত স্থিরচিত্র ছাড়াও ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে কৈলাশ-মানস সরোবর ভ্রমণের তিনি একটি চলচ্চিত্র তুলেছিলেন। ১৯২৮ থেকে ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তোলা তার ছবির অ্যালবাম 'আলোকচিত্রে হিমালয়' ওই সময়ের হিমালয়ের ভৌগোলিক বৈশিষ্টের এক অমূল্য দলিল। তার ছবির প্রদর্শনীতে শুধু হিমালয় নয়, সৌরাষ্ট্রের গিরনার বা এলাহাবাদের কুম্ভমেলার মতো বিষয় স্থান পেত।
উমাপ্রসাদ সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। তারই উদ্যোগে তাঁদের বাড়ি থেকে প্রকাশিত 'বঙ্গবাণী' পত্রিকায় শরৎচন্দ্রের "পথের দাবী" ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়। (২য় বর্ষের ফাল্গুন ১৩২৯ থেকে ৫ম বর্ষের বৈশাখ ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ সংখ্যায়) পুস্তকাকারেও বইটি তিনি প্রকাশ করেন (১৩৩৩ বঙ্গাব্দে) তাঁদের বাসগৃহ ৭৭, রসা রোড (বর্তমানে আশুতোষ মুখার্জি রোড) থেকে। সরকার বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। পরে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহৃত হলে দ্বিতীয় সংস্করণ (১৩৪৬ ব) ও তৃতীয় সংস্করণ (১৩৫৪ ব) প্রকাশ করেন। ওই সংস্করণের প্রচ্ছদপটে ও ভিতরে দু-খানি ছবি এঁকেছেনশিল্পী নন্দলাল বসু। তিনি ছিলেন শরৎচন্দ্রের একান্ত স্নেহভাজন ও আস্থাভাজন। শুধু তাই নয়, তিনি ছিলেন শরৎ রচনার 'ভাণ্ডারী', তার কাগজপত্র, পাণ্ডুলিপি এমনকি উইলের রক্ষক পর্যন্ত। শরৎচন্দ্রের মৃত্যুর পর তার উইল নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে - বিশেষকরে হিরণ্ময়ী দেবী শরৎচন্দ্রের স্ত্রী নন বলে ঘোষণা করা হচ্ছিল। যদিও উইলে তার নাম স্ত্রী হিসেবেই লেখা হয়েছে। উমাপ্রসাদ এই প্রসঙ্গের প্রতিবাদ করে হিরণ্ময়ী দেবীকে শরৎচন্দ্র যে স্বীকৃতি দিয়ে গিয়েছিলেন তার প্রমাণ করেন। পরিব্রাজক হিসাবে উমাপ্রসাদের নিজের দেখা নিজের বিষয়কে নিয়ে সহজ ভাষায় যে সমস্ত বই লিখেছেন সেগুলি বিশিষ্ট সাহিত্য হয়ে উঠেছে। হিমালয় ও ভারতের গিরিপথ ও গিরিশৃঙ্গ বিষয়ে লেখা বইয়ের সংখ্যা বেশি।
প্রকাশিত বই-এর তালিকা
গঙ্গাবতরণ ১৩৬২
কালিন্দী খাল ১৩৬১
হিমালয়ের পথে পথে ১৩৬১
সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি ১৩৬১
আফ্রিদি মুলুকে ১৩৮৫