হাতিয়ার ঢাল দো
প্রকাশ : 2021-12-16 13:41:32১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
শিরোনামীয় শব্দগুলোর সাথে আমি ততটা পরিচিত নই। এ শব্দের সাথে আমার পরিচয়ের প্রয়োজনও নেই। ১৯৭১ সালের ১৪/১৫ ডিসেম্বর আমরা তখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে। আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ সারা দেশে বিজয় অর্জন করে ঢাকার দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনী চারদিক থেকে ঢাকা শহরকে ঘিরে ফেলেছে। “জয় বাংলা” শ্লোগানে তখন মাঠ-ঘাট, পথ-প্রান্তর মুখরিত, আকাশ বাতাস প্রকম্পিত ও সাগর-নদী, খালবিল উত্তাল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দিশেহারা। কী করবে বুঝতে পারছিল না। রেডিও থেকে বার বার বুলেটিন হচ্ছিল হানাদারদের আত্মসমর্পন করার জন্য। কিন্তু হানাদাররা বাংলা বুঝতে পারছিল না। সে অবস্থায় বুলেটিন কয়েকবার উর্দুতে হয়েছিল “হাতিয়ার ঢাল দো”। এ আহ্বান বুঝতে পেরে অস্ত্র সমর্পন করে তারা বন্দি শিবিরের পথে হাঁটছিল। তাদের দোসর সাদা পোষাকধারী দেশীয় বেঈমান রাজাকার, আলবদর ও আলসামসরা একুল ওকুল সবকুল হারিয়ে পলায়নরত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথী হতে চাচ্ছিল। হানাদার মিলিটারি রাজাকারদের লাথি মেরে মেরে গাড়ি থেকে ফেলে দিচ্ছিলো। গালি দিচ্ছিল বেঈমান গাদ্দার বলে। বলেছিল, তোদের জন্যই আজকে আমাদের এ অবস্থা। বাংলার উৎফুল্ল জনতা তা দেখে দেখে রাজাকারদের গায়ে থুথু ছিটাতো। বাংলার মানুষের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস, দীর্ঘ দিনের দুঃখ বেদনা ও ব নার ইতিহাস। ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ করে আমরা বিরাট সাফল্য পেয়েছি, মাতৃভূমিকে স্বাধীন করেছি। পাকিস্তানের শোষণ, নির্যাতন, অত্যাচার থেকে মুক্তি পেয়েছি।
১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে ভাস্কো-ডা-গামা কালিকট বন্দরে অবতরণের মাধ্যমে পাক-ভারত উপমহাদেশসহ বাংলাদেশে বিদেশি বেনিয়াদের আনাগোনা শুরু হয়। একের পর এক পর্তুগিজ, ফরাসি, ইংরেজসহ নানা জাতি বণিকের ভনিতায় যুদ্ধ কৌশল অবলম্বন করতো। প্রচুর বাধার মুখে অনেকে টিকতে না পারলে ও ইংরেজরা এ দেশ দখল করে নেয় কতিপয় দেশীয় বেঈমানের বিশ্বাসঘাতকতায়। ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে তারা মসনদে বসে। বেনিয়া ইংরেজদের বিরুদ্ধে এ দেশবাসীকে সংগ্রাম করতে হয় প্রায় দুইশ বছর। বাংলার মানুষ বিপুল রক্ত ঝরিয়ে ১৯৪৭ সালে দেশকে ইংরেজ মুক্ত করলেও পড়ে যায় পাকিস্তানের খপ্পরে। এ যেন ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত ঊনুনে পড়ে যাওয়া। ধর্মের দোহাই দিয়ে তারা বাংলাদেশকে শোষণ ও ব নার ক্ষেত্রে পরিণত করে। চলে তাদের নির্যাতনের স্টিমরোলার। দীর্ঘ ২৩ বছরের নির্যাতনে পিষ্ঠ হয়ে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের আহবানে সাতকোটি বাঙালি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়, যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যুদ্ধ চলে সর্বাত্মক, দেশের অভ্যন্তরে, বনে বাদারে, জলে স্থলে। যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠে প্রতিটি বাঙালির অন্তরে। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে প্রাণ হারায় বাংলা মায়ের ত্রিশ লক্ষ সন্তান। নির্যাতিত ও বে-ইজ্জতি হতে হয় তিন লক্ষ মা বোনকে। সে বছর ১৩ ডিসেম্বর হতে মুক্তি বাহিনী ও মিত্রবাহিনীর তীব্র আক্রমণে শত্রু বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টার মধ্যে আত্মসর্মপন করার জন্য তারা সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে যায়। যে হানাদার সেনাপতি নিয়াজী নিজের নাম দিয়েছিল “টাইগার নিয়াজী”। যুদ্ধের শুরুতে আস্ফালন দিয়ে বলেছিল ‘মায়ের দুধ খেয়ে বড় হয়েছি - বোতলের দুধ নয়,একবিন্দুও ছাড় দিবনা, পাকিস্তানের অখন্ডতার জন্য জীবন দিতে তৈরি আছি’। কিন্তু স্বঘোষিত বাঘ নামধারী সেনাপতি নিয়াজি জানতো না বাঘের শক্তি থাকে শরীরে। এ শক্তির জোরে সবকিছু করা গেলে হিটলার মুসোলিনীরা এখনো পৃথিবীতে শক্তি দিয়ে সবকিছুই করতে পারতো। বাংলার মানুষ লড়ে যাচ্ছিল নৈতিক শক্তি নিয়ে। তারা যুদ্ধ করেছিল নিজেদের মাতৃভুমির মুক্তির জন্য,নিজেদের বাড়িঘরে জোর করে থাকা বিদেশি লুটেরা তাড়াতে। একটি মহান আদর্শ বুকে ধারণ করে। তাই বাঘ নাম নিয়ে শিয়ালের মতো লেজ গুটিয়ে মাথা নত করে আত্মসর্মপন করতে বাধ্য হয় আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। তাদের ভাষায় তারা “হাতিয়ার ঢাল দো”,অর্থাৎ অস্ত্র ফেলে বন্দি শিবিরে চলে যেতে বাধ্য হয়।
১৬ ডিসেম্বর অবসান হয় বাঙালির পরাধীনতার। আমরা পাই লাল সবুজের আমাদের প্রাণের পতাকা। স্বাধীন দেশের মুক্ত মাটিতে যেদিন প্রথম হেঁটেছিলাম আনন্দের সে মুহূর্তের কথা মনে হলে আজও শিহরণ জাগে। এখন তা বর্ণনা করার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। ১৯৭১ ছিল বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জীবনের সব চেয়ে কঠিন ও চরম পরীক্ষা। বাংলার ইতিহাসে এর চেয়ে বড় পরীক্ষা কখনো তাদের দিতে হয়নি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ আমাদের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে সে বছরের ১৬ ডিসেম্বর কাক্সিক্ষত বিজয় অর্জনের মাধ্যমে সে পরীক্ষা সমাপ্ত হয়েছিল। যুদ্ধ করে এ পরীক্ষায় আমরা উত্তীর্ণ হয়েছি। এ যুদ্ধে স্বাধীনতা, মহান বিজয় ও বিজয় দিবস আমাদের আরাধ্য সাধনার মূল্যবান প্রাপ্তি। এ দেশের উন্নয়ন ও কল্যাণে আমরা হবো নিবেদিত। বাংলাদেশ আমাদের প্রাণের চেয়েও প্রিয় দেশ। যে দেশ হবে সকল শোষণ, নির্যাতনহীন দেশ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বিজয় দিবসে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
লেখকঃ সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার(টিইও)