সয়াবিন তেলের সংকট: রমজানে বাজার অস্থির হওয়ার শঙ্কা

প্রকাশ : 2024-12-08 10:57:08১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

সয়াবিন তেলের সংকট: রমজানে বাজার অস্থির হওয়ার শঙ্কা

সয়াবিন তেলের চলমান সংকট আসন্ন রমজান মাসে বাজার অস্থির করে তুলতে পারে বলে শঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বলা হচ্ছে, বাজার থেকে হঠাৎ করেই সয়াবিন তেল উধাও হয়ে গেছে। কোনও কোনও ব্যবসায়ী সয়াবিন তেল বিক্রির ক্ষেত্রে ক্রেতাকে অন্য পণ্য কেনার শর্ত জুড়ে দিচ্ছেন। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রমজানকে সামনে রেখে এখনই অনুসন্ধান করে সয়াবিন তেলের সংকট মোকাবিলায় সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশ কিছুদিন ধরে বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট চলছে। চাহিদা অনুযায়ী, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা সরবরাহ পাচ্ছেন না। ১০০ লিটার সয়াবিন তেলের চাহিদার বিপরীতে মিল থেকে পাওয়া যাচ্ছে ১০ থেকে ২০ লিটার। ব্যবসায়ীরা অভিযোগ তুলেছেন, মিল মালিকরা নাকি সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন। ফলে বাজারে তেলের সংকট বেড়েই চলছে। সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, এভাবে চলতে থাকলে আসন্ন রমজানে ভোজ্যতেলের সংকট সমগ্র বাজারকে অস্থির করে তুলতে পারে।

জানা গেছে, বিশ্ববাজারে বেড়েছে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম। সেই দামের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমন্বয় করতে না পারার কারণেই মূলত দেশে ভোজ্যতেল নিয়ে এমন ঘটনা ঘটেছে। এমন পরিস্থিতিতে সয়াবিনের দাম সমন্বয় না করা হলে সঠিক দাম পাওয়া যাবে না বলে উৎকণ্ঠায় আছেন ভোজ্যতেলের আমদানিকারকরা। লোকসানের কবলে পড়ার আশঙ্কায় আমদানিকারকদের অনেকে সয়াবিন তেল আমদানির এলসি খোলেননি। এতে করে আমদানি কমে যাওয়ায় সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যদিও আমদানিকারকরা তা অস্বীকার করে বলছেন, দেশে ভোজ্যতেলের কোনও সংকট নেই, সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে।

এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে সয়াবিন তেলের সরবরাহ ও দাম স্বাভাবিক রাখতে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করছে। এর অংশ হিসেবে ভাজ্যতেলের দাম সহনীয় রাখতে উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) প্রত্যাহার করা হয়েছে। আমদানিতেও কর কমিয়েছে সরকার, বাজারেও তদারকি বাড়ানো হয়েছে। অপরদিকে টিসিবির মাধ্যমে বাজারে সয়াবিন তেলের সরবরাহ ঠিক রাখারও চেষ্টা চলছে। প্রতি সপ্তাহেই সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির সভায় টিসিবির জন্য সয়াবিন তেল আমদানির প্রস্তাব অনুমোদন করা হচ্ছে।

ভোজ্য তেলের বড় ব্যবসায়ীরা বলছেন, নানা কারণে দেশে সয়াবিন তেলের আমদানি যে দিন দিন কমছে— তা হয়তো বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। তাদের অভিযোগ, সরকারের তদারকি সংস্থাগুলো এখন আমদানি সংক্রান্ত যেসব তথ্য দিচ্ছে, মূলত সেগুলো গত সাত-আট মাস আগের পুরোনো তথ্য। এতে দেশে সয়াবিন তেল পর্যাপ্ত মজুত থাকার ‘ভুল’ মেসেজ যাচ্ছে। এর সঙ্গে বাস্তবের কোনও মিল নেই।

রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সয়াবিন তেলের বিদ্যমান সংকট দেখিয়ে এক সপ্তাহের ব্যবধানে খোলা সয়াবিন ও পাম অয়েল লিটারপ্রতি ৫ টাকা বেড়েছে। বর্তমানে খোলা পাম তেল ১৬০ থেকে ১৬২ এবং সয়াবিন তেল ১৭০ থেকে ১৭৫ টাকায় প্রতি লিটার বিক্রি হচ্ছে। আর বোতল জাত সয়াবিন অনেক দোকানে পাওয়াই যাচ্ছে না। কিছু কিছু দোকানে এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল মিললেও তা বিক্রি হচ্ছে ১৬৭ থেকে ১৭০ টাকায়। স্থানভেদে একই সয়াবিন তেল ১৭৫ থেকে ১৮০ টাকা দরেও বিক্রি হচ্ছে।

আমদানিকারকরা জানিয়েছেন, বিশ্ব মন্দা কাটিয়ে উঠতে না পেরে দেশের কয়েকটি গ্রুপ ভোজ্যতেলের বাজার থেকে সরে গেছে। ২০০৮ ও ২০১২ সালের বিশ্ব বাজারের অস্থিরতার ধাক্কা পড়েছে ভোজ্যতেলের বড় আমদানিকারক সিটি ও মেঘনা শিল্প গ্রুপের ওপর। তবে তাদের আরও ব্যবসা থাকায় ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। এ ক্ষেত্রে দেশের ব্যাংকগুলোও তাদের সহযোগিতা করেছে। চলতি বছর সয়াবিন ও পাম তেল আমদানির ক্ষেত্রে এসব আমদানিকারক সতর্ক অবস্থায় রয়েছেন।

এসব কোম্পানির একাধিক প্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে সয়াবিন তেলের এই সংকট। সংকটের শুরু থেকে ঋণপত্র (এলসি) খোলার হার ও আমদানি পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে কিনা, সেদিকে সরকারের বড় নজরদারির দরকার ছিল। সেই সঙ্গে বিশ্ববাজার পর্যবেক্ষণ করে ব্যবসায়ীদের অভয় দেওয়াও যেতো, যাতে তারা আমদানি স্বাভাবিক রাখেন। প্রয়োজনে বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে ভোজ্যতেল আমদানি করিয়ে সরকারি সংস্থা সংগ্রহ করতে পারতো। উদাহরণ হিসেবে তারা অতীতে দেশে পেঁয়াজ সংকটের সময় সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ সহায়তার করার কারণে বাজার স্বাভাবিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা গিয়েছিল।

তারা জানান, একাধিক কারণে বর্তমানে ভোজ্যতেলের বাজার অস্থির। দেশে ডলার সংকট এখনও চলমান রয়েছে। আমদানিকারকরা আগের মতো ভোজ্যতেল আমদানি করছেন না। বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দামও আগের চেয়ে বেড়েছে। এসব কারণে ভোজ্যতেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী। দেশের ইতিহাসে পাম অয়েলের দাম এবারের মতো আর বাড়েনি। মূলত ইন্দোনেশিয়ায় উৎপাদন সংকট, বায়োডিজেলে পাম অয়েল ব্যবহারের পরিমাণ ৫ শতাংশ বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির বুকিং রেকর্ড পরিমাণে বেড়ে গেছে।

জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবীর ভুইয়া বলেন, রমজানকে কেন্দ্র করে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট অনৈতিক মুনাফার আশায় নানা ধরনের ফন্দি আটছে। রমজানের সময় দাম না বাড়িয়ে রমজান শুরুর আগেই যদি স্বার্থটি হাসিল করা যায়, তাতে মন্দ কী? এখন থেকেই কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে নজর দিতে হবে।

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, নিত্যপণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে সরকারিভাবে কেনাকাটার যেসব প্রস্তাব আমাদের কাছে আসছে—আমরা সহজেই তা অনুমোদন করে দিচ্ছি। টিসিবিকে কার্যকর রাখতে সয়াবিন তেল কেনাকাটার প্রস্তাবও পাস হচ্ছে। এখানে কোনও সংকট আছে বলে আমি মনে করি না।

এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব মোহা. সেলিম উদ্দিন বলেন, বিষয়টি সরকারের নজরে আছে। এ জন্য বাজারে মনিটরিং চলছে। আমদানি প্রক্রিয়ায়ও স্বাভাবিক। কাজেই দ্রুতই সমস্যা কেটে যাবে। আশা করছি, রমজানে ভোজ্যতেলের কোনও সংকট হবে না।

উল্লেখ্য, ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের তথ্যমতে, দেশে বছরে আমদানিকৃত সয়াবিন তেলের চাহিদা ২২ লাখ টন। তবে গত ২০২৩-২৪ অর্থবছর আমদানি হয়েছিল ২৩ লাখ টন।

সৌজন্যে : বাংলা ট্রিবিউন

কা/আ