সড়ক নিরাপত্তা আইন ও নিরাপদ ড্রাইভিং
প্রকাশ : 2022-10-25 13:30:49১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
সড়ক দুর্ঘটনারোধে নিরাপদ ড্রাইভিং একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেশের উন্নয়ন- অগ্রগতির সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থাও উন্নত হচ্ছে। নতুন সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। এই সকল সড়কে নানা ধরনের যানবাহন চলাচল করছে। প্রতিনিয়ত সড়কগুলোতে যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে। যানবাহনের তুলনায় দেশে সড়কের পরিমাণ যথেষ্ট না হওয়ায় যানজটে প্রচুর সময় নষ্ট হয় এবং গাড়ি দুর্ঘটনায় অনেক মানুষ হতাহত হয়।
সড়ক দুর্ঘটনা একটি অন্যতম কারণ ড্রাইভাররা অনেক সময়ই নিরাপদ ড্রাইভিং না করে দ্রুত এক জায়গা থেকে অন্য যেতে চায়। নিরাপদ ড্রাইভিংয়ের জন্য অনেক ধরণের সচেতনতা দরকার। গাড়ি চালানোর সময় ব্রেক লাইট ও টার্ন লাইট একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, এই লাইট দেখে পেছনের গাড়ির ড্রাইভার বুঝতে পারে সামনের ড্রাইভার তার গতি কমাতে যাচ্ছে, গাড়ি কোনদিকে যাবে কিংবা লেন পরিবর্তন করবে কি না। গাড়ির সামনের হেড লাইট অন্ধকার রাস্তা আলোকিত করে, এই লাইট ব্যবহারের একটা সুনির্দিষ্ট নিয়ম আছে , বিপরীত থেকে গাড়ি আসতে থাকলে তীব্র আলোতে যেন তার চোখ ধাঁধিয়ে না যায় সেজন্য কখনোই হাই বিম অন করতে হয় না । একজন ড্রাইভার যখন গাড়ি চালায় তখন শুধু সামনে নয় , পেছনে এবং পাশে কোন যানবাহন আছে সেটি জানতে হয় । সেজন্য ড্রাইভারের সামনে রিয়ার ভিউ মিরর এবং দুই পাশে সাইডভিউ মিরর থাকে । ছোট আয়নাতে যেন অনেকটুকু জায়গা দেখা যায়, সেজন্য এই আয়না গুলো হয় অবতল। একজন দক্ষ ড্রাইভার যখন গাড়ি চালায় সে শুধু সামনের যানবাহন নয় পাশে এবং পেছনের যানবাহন নিয়েও সবসময় সজাগ থাকে ।
সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণগুলো হচ্ছে, চালকের অসতর্কতা, অসচেতনতা, বেপরোয়া বা অনিয়ন্ত্রিত গতিতে গাড়ি চালানো ইত্যাদি। এ ছাড়া চালকরা অনেক সময় ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত অবস্থায় গাড়ি চালায়। ফলে একসময় নিজের অজান্তেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে। তাই চালকদের এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। কোনোভাবেই অসুস্থ বা ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো যাবে না। প্রত্যেক মানুষেরই পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম প্রয়োজন। অন্যদিকে সড়ক দুর্ঘটনার আরো একটি অন্যতম কারণ চালকদের ওভারটেকিং প্রবণতা। সাধারণত রাস্তায় ধীরগতির গাড়িগুলোকে ওভারটেকিংয়ের প্রয়োজন পড়ে। এ সময় হর্ন বাজিয়ে সামনের গাড়িকে সংকেত দিতে হয়। কিন্তু অনেক সময় সংকেত না দিয়ে একজন আরেকজনকে ওভারটেক করার চেষ্টা করে, যার ফলে সামনের দিক থেকে আসা গাড়ি বের হতে না পেরে মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। সড়ক দুর্ঘটনার আরেকটি কারণ হলো ত্রুটিপূর্ণ সড়কব্যবস্থা। মহাসড়কগুলোয় বাঁক থাকার কারণে সামনের দিক থেকে আসা গাড়ি দেখতে না পেয়ে অনেক চালক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে থাকে। রাস্তার পাশে হাট-বাজার স্থাপন এবং ওভারব্রিজ না থাকাও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
আমরা সড়কে আর মৃত্যু দেখতে চাই না। এজন্য সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। অনিয়মকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। দেশের সড়ক-মহাসড়কে নিরাপদ যাত্রা নিশ্চিত করতে পারলে দুর্ঘটনার হার যেমন কমবে, তেমনি দেশে আহত ও পঙ্গু মানুষের সংখ্যা কমে আসবে। সড়ক দুর্ঘটনার মতো অভিশাপ থেকে দেশকে মুক্ত করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন সকলের সদিচ্ছা।
সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর লক্ষ্যে সরকার সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ প্রণয়ন ও গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের থেকে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে এই আইন ১নভেম্বর ২০১৯ তারিখ থেকে কার্যকর হয়েছে। কিন্তু আইনটি পুরোপুরি এখনও কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। এই আইন পাস হওয়ার চার বছর পূর্ণ হলেও তা বাস্তবায়নে বিধিমালা তৈরি হয়নি। ফলে এই আইনের বাস্তবায়ন ও সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার সম্ভব হচ্ছে না। তাই সড়ক পরিবহন বিধিমালার দ্রুত প্রণয়ন এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন করা জরুরী।
মহাসড়কে যত দুর্ঘটনা ঘটে, তার ৮০ শতাংশ ঘটে অতিরিক্ত গতির কারণে। মহাসড়কে একই মানের গাড়ি, কাজেই একটি গাড়ির আরেকটি ওভারটেক করার প্রয়োজন নেই বললেই চলে। অথচ আমরা দেখতে পাই, পেছনের গাড়ি সামনের গাড়িটিকে ওভারটেক না করা পর্যন্ত যেন স্বস্তি পায় না। আমাদের দেশের চালকদের এটা একটা ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এ ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ করা প্রয়োজন।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ২৫ জুন ২০১৮ তারিখে ছয়টি নির্দেশনা এবং পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আরও ১৭টি নির্দেশনা প্রদান করা হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, অদ্যাবধি এসব নির্দেশনার কার্যকর বাস্তবায়ন পরিলক্ষিত হয়নি। এই নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব। প্রধানমন্ত্রীর ছয়টি নির্দেশনা হচ্ছে, গাড়ির চালক ও তার সহকারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, লংড্রাইভের সময় বিকল্প চালক রাখা, যাতে পাঁচ ঘণ্টার বেশি কোনো চালককে একটানা দূরপাল্লায় গাড়ি চালাতে না হয়। নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর সড়কের পাশে সার্ভিস সেন্টার বা বিশ্রামাগার তৈরি করা। অনিয়মতান্ত্রিকভাবে রাস্তা পারাপার বন্ধ করা। সড়কে যাতে সবাই সিগন্যাল মেনে চলে, তা নিশ্চিত করা। পথচারী পারাপারে জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধার বিষয়টি নিশ্চিত করা। এছাড়া ১৬ আগস্ট ২০১৮ তারিখে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব নজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়নবিষয়ক এক সভায় সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ১৭টি নির্দেশনা প্রদান করা হয়।
নির্দেশনাগুলো হচ্ছে-
১. ঢাকা শহরে চলমান সব গণপরিবহন, শহরে চলাকালে সব সময় দরজা বন্ধ রাখা এবং বাস স্টপেজ ছাড়া যাত্রী ওঠা-নামা সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা নিশ্চিত করতে বিআরটিএ ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
২. একই সময়ের মধ্যে গণপরিবহনে (বিশেষত বাসে) দৃশ্যমান দুটি স্থানে চালক ও হেলপারের ছবিসহ নাম, চালকের লাইসেন্স নম্বর, মোবাইল নম্বর প্রদর্শন নিশ্চিত করা।
৩. সব মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীকে (সর্বোচ্চ দুজন আরোহী) বাধ্যতামূলক হেলমেট পরিধান এবং সিগন্যালসহ সব ট্রাফিক আইন মানতে বাধ্য করা।
৪. সব সড়কে বিশেষত মহাসড়কে চলমান সব পরিবহনে (বিশেষত দূরপাল্লার বাসে) চালক ও যাত্রীর সিটবেল্ট ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়া এবং পরিবহনসমূহকে সিটবেল্ট সংযোজনের নির্দেশনা দেওয়া এবং আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া।
৫. ঢাকা শহরের যেসব স্থানে ফুটওভার ব্রিজ বা আন্ডারপাস রয়েছে, সেসব স্থানের উভয় পাশে ১০০ মিটারের মধ্যে রাস্তা পারাপার সম্পূর্ণ বন্ধ করা। প্রয়োজনে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নাগরিকদের ধন্যবাদ কিংবা প্রশংসাসূচক সম্বোধনের ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
৬. ফুটওভার ব্রিজ বা আন্ডারপাসসমূহে প্রয়োজনীয় পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, আন্ডারপাসসমূহে প্রয়োজনীয় লাইট, সিসিটিভি স্থাপনাসমূহ ব্যবহার করা।
৭. ঢাকা শহরের সব সড়কে জেব্রা ক্রসিং ও রোড সাইন দৃশ্যমান করা, ফুটপাত হকারমুক্ত রাখা, অবৈধ পার্কিং ও স্থাপনা উচ্ছেদ করা, সব সড়কের নামফলক দৃশ্যমান স্থানে সংযোজনের নির্দেশ দেওয়া হয়।
৮. ট্রাফিক সপ্তাহে চলমান সব কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত যথাসম্ভব অব্যাহত রাখা।
৯. স্বয়ংক্রিয় বৈদ্যুতিক সিগন্যাল ব্যবস্থা চালু করার বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
১০. একই সময়ে ঢাকা শহরে রিমোট কন্ট্রোলড অটোমেটিক বৈদ্যুতিক সিগন্যালিং পদ্ধতি চালু করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
১১. ঢাকা শহরের সব সড়কের রোড ডিভাইডারের উচ্চতা বৃদ্ধি করে বা স্থানের ব্যবস্থাপনা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ।
১২. মহাখালী ফ্লাইওভার থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত (আপ ও ডাউনে) ন্যূনতম দুটি স্থানে স্থায়ী মোবাইলকোর্ট বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং প্রতিনিয়ত দৈবচয়নের ভিত্তিতে যানবাহনের ফিটনেস ও ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা করা। শহরের অন্য সব স্থানেও প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী অস্থায়ীভাবে অনুরূপ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
১৩. ঢাকা শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে সমন্বয় করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি বা শুরু হওয়ার সময় অপেক্ষাকৃত জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থী, স্কাউট ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরের (বিএনসিসি) সহযোগিতা নিয়ে শিক্ষার্থীদের রাস্তা পারাপারের উদ্যোগ নিতে হবে।
১৪. অবৈধ পরিবহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং ফিটনেস দেওয়ার প্রক্রিয়ায় অবশ্যই পরিবহন দেখে ফলপ্রসূ ব্যবস্থা নিতে হবে।
১৫. রুট পারমিট/ফিটনেস-বিহীন যানবাহনসমূহকে দ্রুত ধ্বংস করার সম্ভাব্যতা যাচাই করতে হবে।
১৬. লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে হবে। এক্ষেত্রে ‘লারনার’ দেওয়ার প্রাক্কালে ড্রাইভিং টেস্ট নেওয়া যেতে পারে এবং উত্তীর্ণদের দ্রুততম সময়ে লাইসেন্স দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
১৭. কর্মকর্তা-কর্মচারীর ঘাটতি থাকলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ঘাটতি পূরণের ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়।
উপরোক্ত নির্দেশনাগুলোসহ পরিবহন আইন, ২০১৮-এর কার্যকর বাস্তবায়ন এবং নিরাপদ ড্রাইভিং নিশ্চিত হলে সড়ক দুর্ঘটনা কমে আসবে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে চালক যাত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবার সচেতনতা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য।
লেখক: যুগ্মমহাসচিব, নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) কেন্দ্রীয় কমিটি।