সাকা হাফং অভিযান
প্রকাশ : 2022-02-03 12:51:33১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
আব্দুল কাইয়ুম খান মামুন
-----------------------------
প্রথম পর্ব
২৩ ডিসেম্বর ২০২১
সাকা, একটি পর্বত এর নাম। হয়তো অনেকে প্রথম শুনলেন। কারণ এইটা কোন পাঠ্যপুস্তকে লেখা নেই। আছে তাজিংডং এর কথা, আছে কেওকারাডং এর কথা। ছোটবেলা থেকে সবাই জেনে এসেছি যে তাজিংডং ই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বত। সরকারি ভাবে ইহাকে চার হাজার ফুট এর অধিক উচ্চতা দেখানো হয়েছে। অথচ এদেশে আছেই সর্বোচ্চ সাড়ে তিন হাজার ফুট এর পাহাড়। সার্ভেয়ার রা সম্ভবত নিজেদের স্টেপ কাউন্ট করে উচ্চতা মাপতে গিয়ে ভুল করেছিলেন।
দেশের সর্বোচ্চ পাহাড় চূড়া সামিট করা নিয়ে আমাদের মত পাহাড়ে যাওয়া মানুষজনের মধ্যে একটা ক্রেজিনেস কাজ করবেই। সবাই ই চায় সামিট করতে। কিন্তু সমস্যা হলো যাওয়া তো নিষিদ্ধ। কেন নিষিদ্ধ সঠিক উত্তর জানিনা। যারা নিষেধ করেছেন ওনাদের মতে ওখানে নাকি ছেলে ধরা আছে, হুটহাট ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু উপর মহল থেকে বলে দিলে আবার খাতির যত্ন করে দিয়ে না আসলেও অন্তত বাধা দেয়না আরকি।
সাকা সামিট এর শুরুটা করেছিলাম সেই ২০১৯ এর জুলাই মাসে। কিন্তু শেষ করলাম ২০২১ এর ডিসেম্বরে। আগেরবার ফ্ল্যাশ ফ্লাড এর কারণে রেমাক্রী খাল পার হতে পারিনি, পানি কমার মত অপেক্ষা করার সময় ও ছিলো না হাতে, তাই টিম এর অর্ধেক ফেরত এসেছিলাম। সেই অধরা শেষ পর্যন্ত ২০২১ এর ডিসেম্বরে ধরে আসলাম।
অনেক জল্পনা কল্পনা শেষে যখন তারিখ নির্ধারিত হলো, হঠাৎ ই দেখা গেলো সেই সময়ে ওই এলাকায় উপজেলা নির্বাচন হবে। ভোট এর আগে পরে সব যানবাহন বন্ধ থাকবে। তাই আগেরদিন কোনোভাবেই আমাদের ঢুকতে দিবেনা। তাই ভোট নেয়া হলো যে একদিন আগালে কে কে যেতে পারবে আর এক সপ্তাহ পিছালে কে কে যেতে পারবে। রাতে ঘুমানোর আগেও একসপ্তাহ পরের ডেট জয়ী ছিলো। ওই ডেট এ আমি কোনোভাবেই যেতে পারতাম না। কিন্তু সকালে উঠে দেখি এক দিন আগের ডেট জয়ী হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালন করা আরিফ ভাই আর পলাশ একদিন আগে যাওয়া কেই জয়ী ঘোষণা করেছেন। আহ, যাওয়া হচ্ছে তাহলে আমার।
অফিস শেষ করে দৌড়ে বাসায় গেলাম। খাওয়া আর একটু বিশ্রাম শেষে দেখি সাড়ে আটটা বাজে। গুগল ম্যাপে ঢুকলাম। ম্যাপ এর অবস্থা দেখে সাথে সাথে ফেসবুক এর ট্রাফিক এলার্ট পেজ এ ঢুকে দেখি আসলেই জ্যাম এর বাজে অবস্থা। অনেকেই পোষ্ট করেছে। দৌড়ে বাসা থেকে বের হলাম। আজ কোন রিকশা ও পেলাম না কাছাকাছি। অনেকদূর হেঁটে গিয়ে রিকশায় উঠলাম। জ্যাম এড়াতে রিকশাওয়ালা বিকল্প রাস্তায় গেলো, সেখানেও জ্যাম। এর মধ্যেই আতিক ভাই কল দিয়ে আমার অবস্থা জানতে চাইলেন। বললাম রিকশায়, আজমপুর এর কাছাকাছি জ্যামে আছি। উনি তার মাইক্রো চুলা টা সাথে নিয়েছেন। আমি কোন চা কফি নিয়েছি কিনা জানতে চাইলেন। বললাম, নিয়েছি। লাগলে আরো নিয়ে নিবো। এদিকে নাকি আমাদের আরেক সঙ্গী মাহবুব ভাই ও থাকেন, উনি রওয়ানা হয়েছেন আরো কিছু আগে। জানা থাকলে একসাথেই যাওয়া যেতো।
আজমপুর নেমে টং দোকানে গেলাম। থ্রি ইন ওয়ান কফি যা ছিলো সব কিনে নিলাম। উবারে হোন্ডার জন্য রিকোয়েষ্ট দিলাম। অন্তত ৪/৫ জন ক্যানসেল করলো। এরপরে একজন দয়াপরবশ হয়ে বললেন, ৫০ টাকা কমে এপ ছাড়া যাবেন। হাতে সময় কম থাকা আর রাস্তায় বিশাল জ্যাম থাকাতে প্রথমবারের মত এইভাবে রওয়ানা হলাম।
যেকোন কারণেই হোক কিভাবে যেনো সবার আগেই পৌঁছে গেলাম। পৌঁছে আমার লোকেশন গ্রুপের অন্য সবার সাথে শেয়ার দিলাম। আজ অবশ্য সবাই সায়েদাবাদ থেকে উঠবে না। কয়েকজন ফকিরাপুল থেকে উঠবে। বাস হানিফ/ শ্যামলী না, এস আলম। আস্তে আস্তে সাদি চয়ন, সাদিক, মাহবুব ভাই, শিফা, ইফতি চলে আসলো। এখান থেকে আমরা কজন ই উঠবো। বাস আসতেই উঠে পড়লাম। সেখানে আছেন আরিফ ভাই, আতিক ভাই, সিনথিয়া আপু, আবির। পলাশ সামনে থেকে উঠবে আর শালদা চট্টগ্রাম থেকে। বাস এমনিতেই লেট, এখানে আর দেরি না করে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে চলতে শুরু করলো। শুরু হলো আমাদের প্যাক প্যাকানি। গল্পের পরে গল্প চলছেই। বাস বেশ অনেকটা দূর যাওয়ার পরে জ্যামে পড়লো। আমরা সবাই গল্প করছি, হঠাৎ ই শুনি আমাদের পেছন ঠিক ধর ধর বলে উঠলো কেউ। পেছনে না তাকিয়েই বুঝলাম কি কাহিনী। ওখানে কিছু ছেলেপিলে বসা, কোন ট্যুরে যাচ্ছে হয়তো। এদের ই একজনের মোবাইল চুরি হয়েছে। বেচারার ট্যুর টাই শেষ।
যাই হোক খুব ভোরে আমরা বান্দরবন পৌঁছাই। তবে শহরের ভিতরে প্রবেশ করিনি। শহরের কিছুটা আগে একটি বাজারে নেমে যাই। এখান থেকেই একটি ভিন্ন পথে আমরা চাঁদের গাড়িতে করে যাবো। স্থানটি একটি বাজার। বাজারে অনেক গুলো দোকান, হোটেল আছে। তখন মাত্র সকাল ৬ টা বাজে। তেমন কোন দোকান খুলেনি। চাঁদের গাড়ি আসতে আসতে একটি স্থানে ব্যাগ রেখে সবাই যে যার মত ফ্রেশ হওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত।
ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি একটি হোটেলের সামনে দাড়িয়ে আমাদের কয়েকজন কি যেন খাচ্ছে। একটি ছোট বাটিতে ডাল আর প্লেটে তন্দুর রুটি। সবাই এক থালা থেকেই খাচ্ছে। আমিও শুরু করলাম। আহা ডাল টা তো সেই মজা। হোটেল থেকে রুটি বা ডাল দিতে না দিতেই শেষ করে ফেলছি। কিন্তু সেই এক বাটিতেই চলছে।
অবশেষে খাওয়া শেষ হলো। সাথে চা ও খেয়ে নিলাম। এরমধ্যেই গাড়ি চলে আসলো। সবাই ধূপুর ধাপুর উঠে পড়লাম। গাড়ি ছাড়ার পরে টের পেলাম ঠান্ডা কি জিনিষ। জ্যাকেটের হুডি তুলে দিলাম। এইটা মূলত উইন্ডব্রেকার, তাই ভালো কাজে দেয় এসব পরিস্থিতিতে। এরই মধ্যে আতিক ভাই এর হাসাহাসির পর্ব শুরু হয়ে গেলো। তখনো জানতাম না আতিক ভাই এর চাইতে সিনিয়র কেউ আছে হাসাহাসির দিক থেকে।
বেশ কিছুদূর চলার পরে একটি পাড়ায় ঢুকলাম। সেখানে রাস্তা ব্লক করে রাখা। খোজ নিয়ে জানা গেলো সামনে রাস্তায় কাজ চলছে। ভাবলাম কোনোভাবে সাইড কেটে হয়তো চলে যাওয়া যাবে। ব্লক সরিয়ে গাড়ি এগিয়ে চললো। কিছুটা পথ সামনে যাওয়ার পরেই দেখি রাস্তায় কিছু গাড়ি ও বিভিন্ন মালামাল রাখা, সামনে রাস্তায় কাজ করছে। পুরো রাস্তা জুড়ে কাজ, কোনো পাশ দিয়ে গাড়ি যাওয়ার কোনো উপায় নাই। রাস্তায় রড বাধা হচ্ছে, ঢালাই দেয়া হবে। এই দেখে তো আমাদের মাথা খারাপ। এখন উপায় দুইটা, গাড়িতে করে আবার পুরো পথ ব্যাক করা বা শুধু গাড়ি যেতে দিয়ে নিজেরা একটি নির্দিষ্ট স্থান পর্যন্ত হেঁটে যাওয়া। সবাই পরেরটাই প্রেফার করলো।
শুধুমাত্র আরিফ ভাই ছাড়া আমরা বাকি সবাই আমাদের ব্যাগগুলো গাড়িতে এমন ভাবে রেখে দিলাম যাতে বাহিরে থেকে বোঝা না যায়। তবে পলাশ তার ব্যাগ রেখে দিলেও সাথে সাদা রঙের একটি কাথা বুকে জড়িয়ে থুক্কু বগলদাবা করে হেঁটে চলেছে। এ এক রহস্য এই ট্যুরে। রাতে সিটে বসে এই কাথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়েছে। দেখেই মনে হচ্ছিলো অনেক আরামে ঘুমাচ্ছিলো। এখন আবার গাড়িতে না দিয়ে হাতে করে নিয়ে যাচ্ছে। যাইহোক ট্যুর তো মাত্র শুরু, বাকিটা পরে দেখা যাবে। আতিক ভাই এর টিম আছে, রহস্য বের করেই ছাড়বে ।
ড্রাইভার ভাইগ্না একটানে আমাদের গন্তব্যে চলে যাবে। আর আমরাও হাটা শুরু করলাম। পিচঢালা রাস্তা ধরে হেঁটে চলা। কখনো উঠে চলা, কখনো নেমে যাওয়া। সুন্দর রাস্তা, সাথে অনেক বেশি সুন্দর পাহাড়ি সৌন্দর্য। মনে পড়ে যাচ্ছিলো ২০১৯ এর জুলাই এর আমাদের কয়েকজন এর প্রথম সাকা অভিযান এর কথা। সেবার আমরা এগারোজন ছিলাম, যায় মধ্যে মাত্র ৬ জন সেই অভিযান শেষ করতে পেরেছিলো, আমি সহ মোট ৫ জন ফেরত এসেছিলাম। সেবার একটি নির্দিষ্ট দুরত্ব পর্যন্ত গাড়ি গিয়ে আমাদের নামিয়ে দেয়, কারণ তখন সেই রাস্তা ছিলো একদম মাটির, বৃষ্টির কারণে কাদা হয়ে যাওয়ায় আর আকাশে অনেক মেঘ থাকায় গাড়ি এর আগাতে সাহস করেনি। সেখান থেকেও আমাদের অনেকটা পথ হেঁটে যেতে হয়েছিলো।
সকালের ফুরফুরে বাতাসে গল্প গান করতে করতে আমরা এগিয়ে চলেছি। কখনো কোন এক স্থানে দাড়িয়ে ছবি তুলছি, কখনো আবার কোন বিষয় নিয়ে তুমুল হাসাহাসি হচ্ছে। ভাগ্য ভালো যে কিছু খাওয়ার প্ল্যান না থাকলেও কিভাবে যেনো সবার ই কিছুটা খাওয়া হয়েছিলো সকাল বেলা। আসলেই ডাল টা খুব ভালো ছিলো, তাই সবাই মোটামুটি দাড়িয়েই এক বাটি থেকেই খেয়ে নিয়েছে । সাকা হাফং সামিট করতে এসেছি, বিশ্বাস ই হচ্ছে না। সবাই যেভাবে হেঁটে চলেছি, সেসব ছবি ভিডিও দেখলে আসলেই কেউ বিশ্বাস করবে না, ভাববে কোন ভার্সিটি এর ক্যাম্পাসে এক দল পোলাপাইন সকালে হাঁটতে বেড়িয়েছে। একটা স্থানে একটু দাড়ালাম, সাদি এসে ছবি তুলতে শুরু করলো। বললাম, একটু ভাব নিয়ে নেই, তারপরে তুলো। আমি দাড়াতে না দাড়াতেই আবির আর শালদা এসে হাজির । পাশে এসে বসলো সাদিক। একে একে হয়ে গেলো পুরো গ্রুপ। রাস্তা দিয়ে যাওয়া একজন কে ধরে তুলে নিলাম পুরো গ্রুপ ছবি।
কিছুদূর যেতেই একটি কুকুরছানা আমাদের পিছু নিলো। একদমই ছোট্ট একটি বাচ্চা। আমরা তো বাচ্চাটার সাথে দুষ্টামি করতে করতে এগিয়ে চলেছি। কিন্তু হঠাৎ করে আমাদের পেছনে থাকা একজন লোক বললেন বাচ্চাটাকে এখানে রেখে যেতে, নয়তো আমাদের সাথে গিয়ে কোথাও আটকা পরে যাবে, মাকে পাবেনা, খাওয়ার কষ্ট পাবে। ওনার কথা শুনে মনে হলো, আসলেই তো। বাচ্চাটা আমাদের সাথে পুরো রাস্তা যেতে না পারলে তো বিপদ হয়ে যাবে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করার পরেও আমাদের পিছু ছাড়লো না। সে আমাদের সাথেই এগিয়ে চললো। কি আর করা, ছাড়াতে না পেরে বরং তার সাথে বিভিন্ন দুষ্টামি চলতে থাকলো। ইফতি তো আবার নাম ই দিয়ে দিলো - রু রু রু।
একটা সময় আমরা মূল রাস্তায় প্রবেশ করি। ভাবছিলাম গাড়ি বোধহয় চলে এসেছে। কিন্তু না, এখনো আসেনি। আমরা ওই স্থানে থাকা দোকান থেকে কলা, পেপে খেতে শুরু করলাম। ভালোই লাগলো সকাল সকাল। এরমধ্যেই দেখি কুকুর ছানা রু রু রু তার একজন সঙ্গী পেয়ে খেলা শুরু করে দিয়েছে । গাড়ি আসতে ২০/২৫ মিনিট সময় লাগলো। খুব দ্রুত সবাই উঠে পড়লাম। বান্দরবান থেকে থানচি যাওয়ার এই রাস্তা আমার সবসময়ের প্রিয়। এখানে সাধারণত দাড়িয়ে থেকেই সময় কাটিয়ে দেই। দুপাশের মেঘ দেখতে দেখতে যেতে ভালোই লাগে।
আমাদের গন্তব্য এখন সরাসরি থানচি। তবে বলিপাড়া থেকে এন্ট্রি করার কাজ করার পাশাপাশি খাওয়া টা সেরে নিবো। বলিপাড়া পৌঁছে এন্ট্রি করার কাজ করতে গিয়ে দেখা গেলো শিফা এর কাছে NID কার্ডের কপি নাই। অনলাইন থেকে নামিয়ে কপি করার সিস্টেম করা হলো। এখানে সবাই একবারে ট্রেকিং করার জন্য রেডি হয়ে নিলাম। এর মধ্যেই ভাত চলে আসলো। গরুর মাংস, আলু ভর্তা, সবজি আর ডাল দিয়ে ভাত খাবো। এমন টেবিলে বসলাম, দুজনেই কম মাংস খেলো, কি আর করা তাদের গুলো থেকে আমি কিছুটা ভাগ বসালাম।
খাওয়া শেষ হতেই আবার গাড়ি নিয়ে দৌড়। থানচি পৌঁছাতে তেমন সময় লাগলো না। আসলে একদিন আগে আসাতে কোথাও তেমন ভিড় দেখা যাচ্ছে না। থানচি পৌঁছে একটাই দুশ্চিন্তা - পুলিশ/ বিজিবি কেউ ধরে ফেললে গ্যাঞ্জাম হয়ে যাবে। অবশ্য "প্ল্যান বি" ও আছে আমাদের। থানচি ব্রিজ পার হয়ে বামে মর নিতেই দেখি রাস্তায় গাদি গাদি পুলিশ, বিজিবি, আর্মি। আমি সোজা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলাম, এমনকি গাড়ির কারো দিকেও তাকাই নাই। সবাই জাস্ট মূর্তির মতো বসে আছি। ভাইগ্না এক টানে ওই জায়গা পার হয়ে উপরে উঠতে শুরু করলো। আস্তে আস্ত মনে হচ্ছিলো এযাত্রা মনে হয় বেচেঁ গেলাম। সবাই হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। রাস্তার এই অংশ টুকু অনেক সুন্দর। একটানে অনেক দূর উপরে উঠতে থাকে, সাথে বিপরীত পাশের সৌন্দর্য ও আরো বেশি পরিলক্ষিত হয়। গত মাসেই যখন অফট্রেইলে যাচ্চিলাম তখন আরো অনেক বেশি সবুজ ছিলো। এক মাসেই সবুজ ভাব টা অনেক কমে গিয়েছে। সেই ২০১৯ সালের জুনেও এভাবে চুরি করেই পার হয়েছিলাম। কিন্তু তখন এই পিচঢালা, চওড়া সুন্দর রাস্তা ছিলোনা, ইটের সোলিং করা কাদাটে রাস্তা ছিলো।
কিছুদূর আগানোর পরেই গাড়ি এক জায়গায় থামলো। সামনে বসে থাকা পলাশ না বুঝলেও আমি ঠিকই বুঝে নিলাম ভাইগ্না দৌড় দিয়ে কই গেলো। একটু পরে তার হাতে নাস্তার প্যাকেট দেখেই বুঝলাম অনুমান ঠিক আছে। গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। নতুন করা এই রাস্তাটি দেখলে আমার মেঘালয় এর কথা মনে পড়ে। ওইখানে কার পাহাড়ি রাস্তাগুলো অনেক অনেক সুন্দর, অনেক চওড়া। রাস্তা গুলো এমন ভাবে করা যে খাড়া ঢাল এর পরিমাণ খুবই কম। আমাদের এই রাস্তা চওড়া হলেও খাড়া ঢাল এর পরিমাণ কমাতে পারেনি। তবু এর সুন্দর রাস্তার জন্য আর্মিকে মনে মনে ধন্যবাদ দেই। ২০১৯ এ এই রাস্তা পুরো মাটির রাস্তা ছিলো। তখন মাত্র রাস্তা কাটার কাজ চলতেছিল। সেবার একটি নির্দিষ্ট অংশ যাওয়ার পরে গাড়ি থেকে নেমে যেতে হয়েছিলো। সেখান থেকে হেঁটে প্রাতা পাড়া হয়ে সিম্প্তলমপিং পাড়া গিয়েছিলাম। প্রাতা পাড়া পৌঁছে আমাদের গাইড এর বাসার কাঠাল গাছ থেকে একটি সুমিষ্ট কাঠাল মুহূর্তের মধ্যে ভ্যানিশ করে দিয়েছিলাম। বৃষ্টির কারণে পুরো রাস্তা ই কাদাটে ছিলো। এমনই কাদা যে একেকটা জুতার নিচে লেগে থেকে ওজন বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিলো। তাই শেষ পর্যন্ত জুতা হাতে নিয়েই হেঁটেছিলাম।
আজ ও গাড়ি একটি নির্দিষ্ট স্থানে নামিয়ে দিয়ে যাবে আমাদের। সেখান থেকেই হেঁটে শেরকর পাড়া যেতে হবে। আমরা যখন সেই নির্দিষ্ট স্থানের কাছাকাছি, গাড়ি তখন একটি ঢাল বেয়ে উঠতেছিলো, তখন হঠাৎ গাড়ির গতি কমে গেলো, আমার বিপরীতে বসা আতিক ভাই সহ আরো কয়েকজন আস্তে আস্তে করে কেউ হায় হায় বললেন, কেউ বললেন শিট... কিছু বুঝে ওঠার আগেই গাড়ির পেছনে ওঠানামার স্থানে পা রেখে একজন আর্মি পারসন উঠে দাড়ালেন। তাকে দেখে মনের ভেতরে কি যে বয়ে যাচ্ছিলো। শুধু মনে হচ্ছিলো সাকা এর সাথে আমার কি এমন হয়েছে, এবার ও তাহলে ফেরত যেতে হচ্ছে। সবাই ই নিশ্চিত যে আমাদেরকে সামনের ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মনটা একদম খারাপ হয়ে গেলো। পেছনের দিকে কেউই তাকাচ্ছি না। হঠাৎ উনি জিজ্ঞাসা করলেন আমরা কোথায় যাচ্ছি। কি বলবো প্রথমে ভেবে পাচ্ছিলাম না, হঠাৎ করেই মনে হলো তাজিংডং এর কথা বলি। এর মধ্যে আতিক ভাই বলে দিলেন যে তাজিংডং যাচ্ছি। উনি আর কিছু বললেন না। একটু পরেই গাড়ি ঢাল শেষ করে উপরে উঠে আসলো, উনি গাড়ি থামাতে বললেন। গাড়ির গতি কমতেই নেমে গেলেন। গাড়ি আবারো টানতে শুরু করলো। ওই সময়ে আমাদের মনের অবস্থা যে কি ছিলো সেটা আসলে এখানে বর্ণনা করা সম্ভব না। সবাই দেহে প্রাণ ফিরে পেলাম।
একটু পরেই গাড়ি আমাদের নামিয়ে দিলো। এক মুহুর্ত দেরী না করে সবাই হাটা শুরু করলাম। তখন দুপুর প্রায় ২ টা বাজে। সবাই প্রায় দৌড়ে নীচে নেমে চলেছি। গত বছর একবার এই রুটে এসেছিলাম, উদ্দেশ্য ছিলো তাজিংডং ও দতং পাহাড় সামিট করা। তাই রাস্তা কিছুটা পরিচিত লাগতেছিলো। সামনে থেকেই এগিয়ে যাচ্ছিলাম। খুব দ্রুতই আমরা কাইতন পাড়া চলে আসলাম। মনে হচ্ছে গতবছরের তুলনায় অর্ধেকের ও কম সময় লেগেছে। এতক্ষণ শুধু নেমেই এসেছি। এবার উঠতে শুরু হবে। গত বছর একটি স্থানে বসে অনেকটা সময় বিশ্রাম নিয়েছিলাম, সেখানে এত দ্রুত পৌঁছে গেলাম যে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। বুঝলাম গ্রুপের সবাই ই কোন ক্লান্তি ছাড়া আরামসে হেঁটে চলেছে। গত বছরের ট্যুরে থাকা শালদা আর ইফতি কেও জিজ্ঞাসা করলাম, তাদেরও ভাষ্য একই। আমরা অনেক দ্রুত এসেছি।
পাহাড়ের এই অংশে এসে একটা নতুন জিনিষ পেলাম এই প্রথমবার। সারা পাহাড় জুড়ে ছোট ছোট সাদা ফুল ফুটে আছে। দূর থেকে সাদা চাদর এর মত মনে হচ্ছে। আমাদের হাঁটার ট্রেইল এর দুইপাশেই সব পাহাড় এভাবে সাদাটে চাদরে ঢেকে আছে। এতদিন ধরে পাহাড়ে আসছি, কিন্তু কখনো এমনটা পাইনি। গত বছর একটি পাহাড়ের উপরে থেকে অনেক সুন্দর সূর্যাস্ত দেখেছিলাম, কিন্তু টিম স্পিড দেখে মনে হচ্ছে আজ বিকাল ৪/৪:৩০ এর মধ্যেই পাড়াতে পৌঁছে যাবো। সূর্যাস্ত পাড়ায় গিয়ে দেখতে হবে। এখন যে পাহাড় ধরে উঠে চলেছি, এটাই শেষ উঠে চলা, এরপরে শুধুই নেমে যাবো, একদম পাড়া পর্যন্ত। এর মধ্যে আবার সাদিক ও শিফার জুতা কিছুটা আহত হয়েছে, তার চিকিৎসা দরকার। দেখা যাক, পাড়াতে গিয়ে একটা ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বেসর্বা আরিফ ভাই কোন না কোন ব্যবস্থা করেই দিবেন।
একটা সময় আমরা মাইকে গান এর শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। বুঝতে পারলাম পাড়ার কাছাকাছি আছি। সাড়ে চারটা এর সময়েই আমরা পাড়াতে প্রবেশ করি। দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম পাড়ার বিভিন্ন স্থানে নির্বাচনের পোষ্টার টানানো। মাইকে চালানো গান টা এখন একদম স্পষ্ট। সুন্দর একটি সুরে গানটি চলছে, যদিও গানের কথা কিছুই বুঝতে পারিনি। পাড়ার কারবারি এর বাসায় গেলাম, কিন্তু এবার সেখানে ওঠা যাচ্ছে না। ওনার ভাই এর বাসায় ওঠার জন্য বললেন। সেখানে গিয়ে ব্যাগ রেখে প্রথমেই গেলাম গোসল সারতে। এখানে অনেকগুলো পানির কল আছে, যেকোন টাতেই গোসল করা যাবে। তবে এখন সমস্যা হলো, দিনের আলোতে এভাবে খোলা স্থানে অল্প কাপড়ে গোসল করতে হবে।
গোসল করে এসে ব্যাগে থাকা হালকা কিছু খেয়ে নিলাম। একে একে সবাই ফ্রেশ হয়ে আসছে। এদিকে বাড়ির কর্তা দাদা কে রাতের খাবারের অর্ডার দিয়ে দেয়া হয়েছে। আলুভর্তা, মুরগি আর ডাল। ফ্রেশ হয়ে কেউ গল্প করছে, কেউ বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কেউবা জুতা ঠিক করছে। তবে গল্পের আসর এর সেই অবস্থা। আতিক ভাই এর সাথে আবির, ইফতি আর মাহবুব ভাই মিলে পুরাই একটা বোমা। একটু পরপর বোমা ফাটাতেই থাকে । কয়েকজন বললো কফি খাবে। আতিক ভাই তার ব্যাগ থেকে মাইক্রো চুলা বের করে পানি বসিয়ে দিলেন। আমরা রেডিমেড কফির প্যাকেট গুলো বের করলাম। যাদের নিজেদের মগ বা কাপ ছিলোনা তাদের জন্য দাদার থেকে কাপ চেয়ে নিলাম। পানি গরম হতেই একে একে সবাই কফি বানিয়ে নিতে শুরু করলাম। এরমধ্যে আবার আতিক ভাই, ভাবী আর আরিফ ভাই এর একই ধরনের মগ, তাই ওনারা চিয়ার্স করবেন। এত সুন্দর কফি বানানো, খাওয়া ভিডিও করতে হবে, করলাম। ইফতি, শালদা আর আমার মগ স্টিলের, দেখতে অনেকটা একই কিন্তু সাইজ এর ক্ষেত্রে ওদের গুলো আমারটার পাঁচ ভাগের এক ভাগ হবে আরকি। কই থেকে যে এসব জোগাড় করছে । কফি খাওয়া শেষে দেখা গেলো নুর উপুড় হয়ে শুয়ে কিছুটা ব্যায়াম করার চেষ্টা করছে, মনে হয় কোমর ধরে গিয়েছিলো। ইফতি তার পিঠের উপরে দাড়িয়ে, বসে ম্যাসাজ করে দিলো। সাথে মাহবুব ভাই ও কিছুটা সাহায্য করলেন।
এরপরে শুরু হলো গানের আসর। গানের গুরু একেকজন। ইফতি পুরাই বস, শালদা, মাহবুব ভাই, আতিক ভাই প্রায় বস আর আমরা বাকিরা গলা মিলানো বস । তবে আরিফ ভাই যেটা পারেন সেটার ক্ষেত্রে আবার ওনার গলার জোরের সাথে কেউ পারে না।
এর মধ্যেই দাদা বললেন খাবার রেডি, শুধু আলু ভর্তা বানানো বাকি। পলাশ বললো ভর্তা যেনো দাদা না বানান। আমরাই বানিয়ে নিবো। দাদা ভর্তা বানানোর সব কিছু দিলেন, ধনেপাতা সহ । পলাশ উঠে প্রথমে দেখলো ডাল এর কি অবস্থা। ভালোই রান্না করেছে, অনেক ঘন। কিন্তু বাগার দেয়া নেই। ও ডালে বাগার দিবে, আমি বললাম ভর্তার পেঁয়াজ, মরিচ ও একটু তেলে ভেজে নিতে। শিফা আর আমি হেল্প করলাম পলাশ কে, সে সুন্দর করে দুইটা কাজ ই করে ফেললো। এত কিছু করে শেষ পর্যন্ত ভর্তা আর ডাল এতই মজা হয়েছে যে মুরগি নামক বস্তুখানা না হলেও হতো। সবাই পেট ভরে খেয়ে নিলাম, অনেক অনেক তৃপ্তি পেলাম খেয়ে। খাওয়া শেষে ঘুমানোর আয়োজন করতে শুরু করলাম। এক রুমেই সবাই ঘুমাতে হবে। সেভাবেই বিছানা করে ফেললাম। ভাগ্য ভালো টিম এর আট জনই স্লিপিং ব্যাগ নিয়েছিলো, নয়তো কম্বল এর টান পড়তো। তাও ভালো প্রতিবারের ট্যুরের মত এবার খুব ভোরে উঠে বের হতে হবে না, আস্তে ধীরে বের হলেই হবে। তাই সবাই আরামসে ঘুমাতে পারবে। কিন্তু কথা হলো এত তাড়াতাড়ি ঘুমাবে কতজন? যাই হোক, আমিও শুয়ে পড়লাম। আগামী কাল সকালের পরে একদম পরেরদিন রাতে ঘুমানোর সুযোগ পাবো। তাই সময়টা কাজে লাগিয়ে নিতে হবে।
সিম্প্তলম্পিং পাড়া, ২০১৯ এর জুলাই মাসের স্মৃতি
বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে অনেকটা পথ হেঁটে এ পাড়ায় যখন পৌঁছাই তখন রাত ৭/৮ টা বাজে। কোনমতে ব্যাগ টা রেখে বৃষ্টির মধ্যেই গোসল করতে চলে যাই। এই পাড়াটা নতুন, আসার পথে পুরান পাড়াটাও অবশ্য দেখে এসেছিলাম। যদিও সেখানে দু একটা ঘরের ভাঙ্গা অংশ ছাড়া আর কিছু নাই। শুধু একটা স্কুল ঘর আছে। নতুন পাড়ায় নাকি আগের স্থানের চাইতে বেশি বাতাস। গোসল করার সময় সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম। বৃষ্টির কারণে ঠান্ডা, আর বাতাসের কারণে সেই ঠান্ডা অনেক বেশী অনুভূত হচ্ছিলো। কোনমতে গোসল করে ঘরে ঢুকলাম। আমরা যখন ফ্রেশ হয়ে গল্প আড্ডা দিচ্ছিলাম- আরিফ ভাই, শরীফ ভাই তখন আমাদের রাতের খাবার প্রস্তুত করতে ব্যস্ত।
বাইরে তখনো অবিরাম বৃষ্টি হচ্ছে। টিনের চালে সেই শব্দ কানে খুব বেশি সুমধুর লাগছে। এই ঘরের বারান্দায় বসার ব্যবস্থা আছে। অন্ধকারের মাঝে কিছু সময় সেখানে বসে ছিলাম। ওহ এখানে আবার সুন্দর নেটওয়ার্ক ও পাওয়া যায়। এমনকি গ্রামীনফোন এর নেট ও আছে। সবাই ই বাসায় কথা বলেও নিলো। যাইহোক, রান্না শেষে সবাই খেতে বসলাম। খিচুড়ি আর মুরগি। বৃষ্টির মধ্যে ঠান্ডা ঠান্ডায় একদম পারফেক্ট খাবার। তবে এমন টানা বৃষ্টির কারণে কিছুটা দুশ্চিন্তা কাজ করছে, আগামীকালও এমন বৃষ্টি থাকলে কিভাবে কি করবো আমরা। পরেরদিনের পরেরদিন দেখা যাবে ভেবে সবাই শুয়ে পড়লাম। বাতাসের কারণে একদম শীতকাল এর মোট ঠান্ডা। নিচে কম্বল বিছিয়ে, গায়ে ডাবল কম্বল দিয়ে শুয়ে পড়লাম।
(চলবে.....)