সম্পত্তিতে অধিকারবঞ্চিত হিন্দু নারীরা

প্রকাশ : 2022-10-19 11:59:02১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

সম্পত্তিতে অধিকারবঞ্চিত হিন্দু নারীরা

এবারের দুর্গোৎসব চলাকালে ৪ অক্টোবর ঢাকার মালিবাগের বাসিন্দা পার্থ সারথী মজুমদার তার কন্যাশিশুর হাত ধরে প্ল্যাকার্ডে- ‘দেবীরূপে পূজা নয়, চাই নারীরূপে হিন্দু নারীর সম্পত্তির অধিকার’ দাবি নিয়ে দাঁড়িয়েছেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে। তার দাবি পূরণ করতে হলে রাষ্ট্রকে প্রণয়ন করতে হবে হিন্দু নারীর সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার আইন। সময়ের সঙ্গে সমাজ ও সভ্যতার প্রগতিমুখী পরিবর্তন হলেও বাংলাদেশে হিন্দু উত্তরাধিকার সংস্কারে সরকার কেন প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিচ্ছে না তা এক বিরাট প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। অথচ বর্তমান সরকার নারীর মর্যাদা ও অধিকার রক্ষায় তথা ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী এবং অনেক ক্ষেত্রে তা দৃশ্যমানও বটে। হিন্দু দায়ভাগ মতবাদে ৩ শ্রেণির উত্তরাধিকারী ২৩৩ জনের মধ্যে বিধবা, কন্যা, মাতা, পিতার মাতা ও পিতার পিতার মাতা মাত্র এই ৫ জন নারী সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী হন। তাও জীবনস্বত্বে। ব্রিটিশ প্রণীত ঞযব ঐরহফঁ ড়িসবহ’ং জরমযঃ ঃড় চৎড়ঢ়বৎঃু অপঃ, ১৯৩৭ বিধবাদের অংশ সুনির্দিষ্ট করে দিলেও তাও কেবলমাত্র জীবনস্বত্বের অধিকারী হিসেবে গণ্য। আইনি প্রক্রিয়ায় সীমিত ক্ষেত্র ছাড়া এই সম্পত্তি হস্তান্তরের কোনো সুযোগ নেই। গত শতকের আশির দশক থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের একাংশ হিন্দু আইন সংস্কারে উদ্যোগ নেন। বিচারপতি দেবেশচন্দ্র ভট্টাচার্য এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। বেসামরিক প্রতিষ্ঠান ‘স্টেপস টুওয়ার্ডস ডেভেলপমেন্ট’-এর প্রযোজনায় ১৯৯৬ সালে হিন্দু নারীর সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার বিষয়ে এক ডকুমেন্টারি বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিল। ওই ডকুমেন্টারিতে প্রান্তিক হিন্দু নারীদের পক্ষ থেকে উত্তরাধিকারের দাবিটি উঠে এসেছে। সাবেক মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দও ওই ডকুমেন্টারিতে উত্তরাধিকার আইন সংস্কারের পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন। সাম্প্রতিক সময়ে এ দাবির পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে। একসময় যারা সময়োপযোগী নয় মনে করে দ্বিধা-দ্ব›েদ্ব ছিলেন তাদের অনেকেও সংস্কারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। ৬ এপ্রিল ২০১৯ সিরডাপ মিলনায়তনে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ কর্তৃক একাদশ জাতীয় সংসদে নির্বাচিত সংখ্যালঘু সংসদ সদস্যদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত নারী নেতাদের পক্ষ থেকে হিন্দু আইন সংস্কারের দাবিটি উত্থাপিত হলে উপস্থিত নারী সংসদ সদস্যরা উচ্চকণ্ঠে তা সমর্থন করেন। উপস্থিত সব পুরুষ সংসদ সদস্য উত্থাপিত দাবির বিপক্ষে কোনো বক্তব্য রাখেননি। ২৬ আগস্ট ২০২১ বাংলাদেশ মহিলা ঐক্য পরিষদ কর্তৃক ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির মেলাঙ্গনে ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘু নারীর উত্তরাধিকার- প্রেক্ষাপট ২০২১’ বিষয়ে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে বিচারপতি, সংসদ সদস্য, অবসরপ্রাপ্ত সচিবসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতিনিধিত্বকারী শতাধিক নারী আলোচনায় অংশ নিয়ে দ্রুত হিন্দু উত্তরাধিকার আইন প্রণয়নের দাবি তোলেন। একই সালের ৪ মার্চ ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’-এর নেতৃত্বে নাগরিক উদ্যোগ কর্তৃক প্রণীত ‘খসড়া হিন্দু উত্তরাধিকার আইন ২০২১’-এর ওপর এক ওয়েবিনারের আয়োজন করা হয়। সারাদেশের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কয়েকশ নেতা-নেত্রী ওই ওয়েবিনারে অংশগ্রহণ করে। ১৬ জুলাই ‘ফাউন্ডেশন ফর ল’ এন্ড ডেভেলপমেন্ট’, আইনে সংখ্যালঘু নারীদের অধিকার ও সমতা বিষয়ে ওয়েবিনারের আয়োজন করে। এসব উদ্যোগে আলোচকদের বৃহৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সংস্কারের পক্ষে মত দেন। ৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে ‘বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ’-এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ, প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য এমপিসহ উপস্থিত আলোচকরা সংস্কারের পক্ষে মত দেন। 

উল্লেখ্য, ৩০ মার্চ ২০২১ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন কর্তৃক আয়োজিত ভার্চুয়াল গোলটেবিল বৈঠকেও প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য হিন্দু নারীদের মা-বাবা, স্বামী, সন্তান কারো সম্পত্তির অধিকারী না হওয়ার মতো অমানবিক বিষয় দূর করার পক্ষে মত ব্যক্ত করেন। ওই বৈঠকে তিনি দশম সংসদে বিষয়টি উত্থাপনের কথা তুলে ধরার পাশাপাশি এ বিষয়ে বিল আনার প্রস্তুতি নেয়ার কথাও উল্লেখ করেন। গত ১০ সেপ্টেম্বর জাতীয় জাদুঘরের বেগম সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে মহিলা ঐক্য পরিষদ আয়োজিত এক সেমিনারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল এমপিসহ বিশিষ্ট আলোচকদের উপস্থিতিতে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার হিন্দু আইন সংস্কারের পক্ষে তার অবস্থান ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে দ্রুত স্মারকলিপি দেয়ার জন্য আয়োজকদের প্রতি আহ্বান জানান। সেমিনারে উপস্থিত আলোচকরাও হিন্দু আইন সংস্কারের অপরিহার্যতা বিষয়ে সহমত পোষণ করেন। লেখার কলেবর বৃদ্ধি পাবে বিধায় উপরোল্লিখিত কয়েকটি সেমিনারে অংশগ্রহণকারী হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বকারী অনেক বিশিষ্টজনের নাম অনুল্লেখ রয়ে গেল।

হিন্দু আইন সংস্কারে যারা বিরোধিতা করছেন তারা মূলত ধর্মের দোহাই দিয়ে এবং বিশেষ করে ধর্মান্তকরণের ভীতি থেকে বিরোধিতা করছেন বলে প্রতীয়মান। ব্রিটিশ আমলে অন্তত ডজনখানেক আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, যেখানে কোনো না কোনোভাবে হিন্দু ধর্মীয় প্রথাতে পরিবর্তন হয়েছে। স্বাধীন ভারতে ১৯৪৭ পরবর্তী একাধিকবার হিন্দু আইনের সংস্কার হয়েছে। এর ফলে বিধবা বিবাহ প্রচলন, অমানবিক সতীদাহ প্রথা বিলোপ, বহুবিবাহ নিষিদ্ধকরণ, অসবর্ণে বিবাহ প্রচলন, রেজিস্ট্রেশন বিধান, নারী-পুরুষের সম্পত্তিতে সমান অধিকার নিশ্চিতকরণ ইত্যাদি কার্যকর হয়েছে। বাংলাদেশ আমলেও প্রণীত ঞযব উড়ৎিু অপঃ, ১৯৮০ বাতিল করে সময়ের চাহিদানুযায়ী বর্তমান সরকার কর্তৃক ঞযব উড়ৎিু অপঃ, ২০১৮ নতুনভাবে প্রণয়ন করা হয়, যা সনাতনী সম্প্রদায়ের জন্যও প্রযোজ্য। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ নেপাল, মরিশাসেও ইতোমধ্যে হিন্দু আইনের সংস্কার করা হয়েছে। এমনকি ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তানেও হিন্দু আইনের সংস্কার করা হচ্ছে। ওইসব দেশের হিন্দু সম্প্রদায় ব্রিটিশ আমল ও পরবর্তী আমলে প্রণীত আইনগুলো গ্রহণ করেছে। তাতে ধর্মের কোনো ক্ষতি হয়েছে বলে মনে হয় না। সনাতন ধর্মের আদি উৎস বেদ। বৈদিক যুগে ঋষিদের পাশাপাশি ঋষিকা যেমন ছিল, তেমনি নারীরা বিভিন্নভাবে সম্মানের জায়গায় আসীন ছিলেন। এমনকি কন্যা সন্তানের জন্ম পরিবারের কাছে ছিল আনন্দের বিষয়। বর্তমানে প্রচলিত হিন্দু আইন বৈদিক যুগ তথা বেদ থেকে উৎসারিত তা বলা যাবে না। ধর্মান্তকরণের বিষয়টি সামনে এনে বিরোধীপক্ষের বিরোধিতা কতটুকু যৌক্তিক তা বিবেচনায় নেয়ার দরকার। এটি সত্য যে ব্রিটিশ প্রণীত ঞযব ঈধংঃ উরংধনরষরঃরবং জবসড়াধষ অপঃ, ১৮৫০-এর আওতায় ধর্মান্তরিত হলেও সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার হারাত না, স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সরকার ঞযব ইধহমষধফবংয খধংি জবারংরড়হ ধহফ উবপষধৎধঃরড়হ অপঃ, ১৯৭৩-এর মাধ্যমে এ আইনটিকে গ্রহণ (ধফধঢ়ঃ) করেনি। ব্রিটিশ প্রণীত আইনটি বাতিল হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে যে কোনো ধর্মের লোক ধর্মান্তরিত হলে সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারিত্ব হারাবেন। রহস্যজনক কারণে এই বিষয়টি আলোচনায় আসে না বলে সাধারণ জনগণ বিভ্রান্তির শিকার হন।

অধ্যাপক এম শাহ আলম নেতৃত্বাধীন আইন কমিশন মাঠ পর্যায়ে গবেষণাপ্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ২০১২ সালে হিন্দু আইন সংস্কারের সুপারিশ করেন। ইতোমধ্যে ঐচ্ছিক রেখে ২০১২ সালে হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন কার্যকর হয়েছে। এতে হিন্দু সম্প্রদায় বিশেষ করে যারা বিদেশগামী তারা এ আইনের সুফল ভোগ করছেন। আইনটিকে বাধ্যতামূলক করার জন্য ২০১৭ সালেই হিন্দু নিবন্ধক সমিতির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল। মজার বিষয় হচ্ছে যারা এক সময় নিবন্ধন আইন প্রণয়নের বিরোধিতা করেছিলেন এবং বর্তমানেও উত্তরাধিকার আইন সংস্কারের বিরোধিতা করছেন তাদের কেউ কেউ হিন্দু নিবন্ধক সমিতিতে উচ্চতর পদে দায়িত্ব পালন করেছেন বা করছেন। তবে আশার কথা এদের কেউ কেউ ঘরোয়া আলোচনায় আপাতত স্বামীর সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার দেয়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচক মত প্রকাশ করছেন। কারো কারো অভিমত উত্তরাধিকার আইন প্রণয়নের আগে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা হোক, যা ছিল বর্তমান সরকারের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন-প্রাক রাজনৈতিক অঙ্গীকার।

একটি বিষয় চালু রয়েছে কোনো কোনো পর্যায় থেকে নাকি বলা হয়ে থাকে হিন্দু সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিষয়টি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক বা পারিবারিক যে কোনো পর্যায়ে সব মানুষ কখনো কোনো বিষয়ে কি এক হতে পেরেছে বা হয়েছে। ঈশ্বরচন্দ্রের বিধবা বিবাহের আন্দোলন বা রামমোহন রায়ের সতীদাহ প্রথা বিলুপ্তির আন্দোলন তৎকালীন সময়ে হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বিরোধিতা করেছিল। তারপরও যৌক্তিক বিবেচনায় ব্রিটিশ সরকার আইন প্রণয়ন করেছে। ফলে জীবন্ত নারীকে পুড়িয়ে হত্যা করার মতো অপরাধ থেকে হিন্দু সমাজ মুক্ত হতে পেরেছে। সমাজের কাছে অভিশপ্ত অল্পবয়সি বিধবারা পুনর্বিবাহের মাধ্যমে সামাজিক গøানি থেকে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণাপত্র বা সিডও (ঈঊউঅড) সনদ বা ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাগুলোর অন্যতম লক্ষ্য লিঙ্গ সমতা বা কাউকে পেছনে না রাখার বিষয়, সর্বোপরি বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮(২) অনুচ্ছেদের আওতায় সবক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্য বিলোপ ও সমঅধিকারের নিশ্চিত করার বিধান রাখা হয়েছে। মানবাধিকারের সুরক্ষায় তথা হিন্দু নারীর ক্ষমতায়নে হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের সংস্কার সময়ের দাবি। হিন্দু নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক অবস্থা বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ইতোপূর্বে ২৬ এপ্রিল, ২০১৮ সালে হিন্দু ধর্মীয় নেতাদের হিন্দু উত্তরাধিকার আইন প্রণয়নে উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাই সরকারের এ আমলেই হিন্দু উত্তরাধিকার আইনটি প্রণীত হবে- এ আশা ও আস্থা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ওপর হিন্দু নারীরা রাখতেই পারে। পার্থ সারথী মজুমদারকেও শিশু কন্যার হাত ধরে পুনরায় প্রেস ক্লাবের সামনে দাঁড়াতে হবে না।

মিলন কান্তি দত্ত : সমাজকর্মী ও কলাম লেখক।