সত্যজিৎ রায়-এর শ্যুটিং-এ একদিন
প্রকাশ : 2022-05-02 08:41:39১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
কেশব মুখোপাধ্যায়
---------------------------
সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক এবং উত্তমকুমার-এর শ্যুটিং দেখার ইচ্ছে কৈশোর পেরিয়ে ছিল যুবক হয়ে ওঠার পর । সত্যজিৎ রায় ও উত্তমকুমার-এর ক্ষেত্রে সেই ইচ্ছে পূরণ হলেও ঋত্বিক ঘটক-কে কোনো দিন চোখের দেখাও দেখা হয়নি । যদিও ঋত্বিক ঘটক মৃত্যুর আগে বেশ কিছুদিন ছিলেন আমার বাড়ি থেকে সামান্য কয়েক মিনিটের হাঁটা পথের দূরত্বে । তিনি যে সেখানে থাকতেন, তা জেনে ছিলাম ঋত্বিক ঘটকের মৃত্যুর পর । আমার পরিচিত দু-একটি ছেলে তাঁর দেখাশোনা করতেন।
যাইহোক দিন তারিখ স্মরণ নেই । সম্ভবত ১৯৭৩ অথবা ১৯৭৪ । একদিন আমাদের আড্ডায়, এক যুবক এসে জানালো পরদিন সত্যজিৎ রায়-এর শ্যুটিং-এ ভিড়ের দৃশ্যের জন্য বেশ কিছু যুবক দরকার । জনপিছু পাঁচ/দশ টাকা পাওয়া যাবে । তখন কলেজের ছাত্র, বেকার। ছবির নাম "জন-অরন্য"। শংকর-এর ওই উপন্যাসটি কয়েক মাস আগেই পড়েছি।
পরদিন সকাল দশটায় আমরা ১৪/১৫ জন শ্যুটিং স্পট ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে হাজির হয়ে দেখলাম, সেখানে আরও ২৫ / ৩০ জন যুবক ও কয়েকজন যুবতী হাজির রয়েছে ।
দক্ষিণ কলকাতার 'বসুশ্রী' সিনেমা হলের বিপরীত দিকে অবস্থিত স্কুল,কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বই বিক্রির দোকান 'ব্যানার্জি বুক সিন্ডিকেট' -এর আদলে ( পাশের বিস্কুট-চানাচুরের ছোট্ট দোকানটি-সহ) স্টুডিও-র ভিতর খোলা আকাশের নিচে সেট তৈরি করা হয়েছে । দীর্ঘদেহী সত্যজিৎ রায় তৈরি সেটের সামনে দাঁড়িয়ে দেখছেন, কিছু নির্দেশ দিচ্ছেন । পাশে ক্যামেরাম্যান সৌমেন্দু রায়, ওই ছবির সহকারি পরিচালক সুহাসিনী মুলে ও অন্যান্যরা । সুহাসিনী মুলে ইতোপূর্বে বনফুল-এর কাহিনী অবলম্বনে মৃণাল সেন পরিচালিত 'ভূবন সোম' ছবির প্রধান নারী চরিত্রে অভিনয় করে ছিলেন। বিপরীতে ছিলেন উৎপল দত্ত ।
স্টুডিও-র ভিতর খোলা জায়গায় তৈরি করা সেটের মুখোমুখি ১৪/১৫ ফুট লম্বা লাইন পেতে, লাইনের প্রায় শেষ প্রান্তে চাকা দেওয়া কাঠের পাটাতনের ওপর লম্বা ঠ্যাংয়ের টুল, তার ওপর বসানো হয়েছে ক্যামেরা । আমাদের কী করতে হবে তা একজন বুঝিয়ে দিলেন । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বি-এ পরীক্ষার ফলের (Result) গ্যাজেট প্রকাশিত হয়েছে, ওই দোকান থেকে গ্যাজেট কেনার জন্য লাইন-হড়োহুড়ি এবং কেউ কেউ গ্যাজেট কিনে এনে পঁচিশ পয়সার বিনিময়ে রোল নাম্বার ধরে রেজাল্ট বলে দিচ্ছে । ছবির নায়ক সোমনাথ ও তার বন্ধুও এসেছে রেজাল্ট জানার জন্য । এই ছিল সেদিনের শ্যুটিংয়ের মূল কাঠামো । আমাদের সবার হাতে পঁচিশ পয়সার একটি করে কয়েন দেওয়া হয়েছে, রোল নাম্বার বলে সেই পয়সা দিয়ে রেজাল্ট জানার জন্য ।
শ্যুটিং শুরুর আগে সৌমেন্দু রায় আলো মাপার ছোট যন্ত্রটি হাতে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে ধরে, তার দিকে তাকিয়ে প্রাকৃতিক আলোর উজ্জ্বলতা মাপ বলার পর, সত্যজিৎ রায়ের নির্দেশ মতো লম্বা স্ট্যান্ডের ওপর দুই ধারে বসানো দুটি ফোকাস লাইটের সামনে নেট বা জাল জাতীয় কিছু দিয়ে কৃত্রিম আলোর উজ্জ্বলতা ও তীব্রতা কমিয়ে দেওয়া হলো ।
এরপর সত্যজিৎ রায় ট্রলির ওপর উঠে, ক্যামেরার পিছনে দাঁড়িয়ে, ক্যামেরা ও নিজের কাঁধ পর্যন্ত মোটা কলো কাপড়ে ঢেকে একবার দেখে, নিচে নেমে শেষ পর্যায়ে (ফাইনালি) আমাদের (একস্ট্রাদের) এবং ছবির নায়ক এবং তার বন্ধুকে পজিশন-সহ সব বুঝিয়ে দিয়ে আবার ক্যামেরার পিছনে গিয়ে কালো কাপড়ে ক্যামেরা ও নিজেকে আগের মতো ঢেকে নিলেন । এবং লাইট-সাউন্ড-ক্যামেরা-এ্যকশন বলার সঙ্গে সঙ্গে, সত্যজিৎ রায়-সহ ক্যামেরা ট্রলির ওপর দুই লাইনের উপর দিয়ে সামনের দিকে এগোতে শুরু করলো।
ছবিতে কয়েকটি ভাগে ওই দৃশ্যটির স্থায়িত্ব ছিল সামান্য, মিনিট দু-তিন । কিন্তু দৃশ্যগুলি গ্রহণ করতে সময় লেগেছিল (যতদূর মনে পড়ে ) পাঁচ/ ছয় ঘন্টার ওপর । প্রথম শটেই সত্যজিৎ রায় কালো কাপড়ে ঢাকা থেকে মুখ বাইরে এনে, 'না, কেউ পিছন ফিরে ক্যামেরার দিকে তাকাবেন না ।আপনাদের মুভমেন্ট থাকবে সামনে, দোকানের দিকে।' বলে নিচে নেমে এসে নিজের শরীর দুলিয়ে, হাত নেড়ে বুঝিয়ে দিলেন । কিন্তু তারপরেও কেউ আড়চোখে ক্যামেরার দিকে তাকালো, কেউ মাত্রারিক্ত হুটোপটি করে বসল, কেউ অন্য কিছু । মাঝে তুমুল বৃষ্টির জন্য খোলা আকাশের নিচে দৃশ্য গ্রহণ বা শ্যুটিং বেশ কিছু সময় বন্ধ থাকলো । একবাব বিদ্যুৎ সংযোগ থেকে প্ল্যাগ খুলে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হওয়ায়, কালো কাপড়ে ঢাকা ক্যামেরা থেকে মুখ বাইরে এনে ভারী গলায় বললেন, ' ... এভাবে শ্যুটিং হয় ! কানেকশনটা দাও ...' ।
আর একবার ক্যামেরা বন্ধ করে ট্রলি থেকে নিচে নেমে এসে তিনটি মেয়েকে ডেকে নিজে হেঁটে পজিশন দেখিয়ে দিয়ে বললেন, 'তোমরা তিনজন পর পর ক্যামেরার দিকে না তাকিয়ে, ওই রকম (ক্যামেরাকে বাঁ-দিকে রেখে) সাধারণভাবে হেঁটে যাবে।' কিন্তু শুধু কয়েক পা হেঁটে যেতেও মেয়ে তিনটি দু-বার ভুল করেছিল।
বৃষ্টির পর ঝলমলে রোদ উঠেছে, কিন্তু খোলা জায়গায় শ্যুটিং স্পটে ইঞ্চি দেড়েক জল জমে যায়। ঢালুর দিকে সেই জলের ওপর ভেসে যাচ্ছে জলীয় বাষ্প ও বাতাসে তৈরি অর্ধ-গোলাকৃত ছোট ছোট প্রাকৃতিক বল। তার ওপর প্রতিফলিত হচ্ছে সপ্ত রংয়ের আভা । সত্যজিৎ রায় একটা মোড়ার ওপর বসে সেই দিকে চোখ রেখে ওই দৃশ্যটি কাউকে ক্যামেরা বন্দি করতে বলে, পাশে দাঁড়ানো সৌমেন্দু রায়, সুহাসিনী মুলে এবং আন্যদের বললেন, 'যেন শতশত কাঁকড়া হেঁটে যাচ্ছ । শ্যুটিং করতে গিয়ে (একটি জায়গার নাম বলে ) দেখে ছিলাম এই রকম ভাবে হাজার হাজার কাঁকড়া হেঁটে যাচ্ছে. . .'। বৃষ্টির মধ্যেই একবার হাঁক পেড়ে বললেন, 'তোমরা যারা ইতিমধ্যে ক্যামেরার মধ্যে এসে গেছ, তারা কেউ যেন চলে যেও না।'
দু-একবার ভিড়ের দৃশ্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে, পরে ক্যামেরা ও শ্যুটিং জোনের বাইরে বেরিয়ে এসে ছিলাম দুটি কারণে । প্রথমত সেদিন ইন্দ্রপুরী স্টুডিও-তে আমার যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল শ্যুটিংয়ে অংশ নিতে নয়, বরং সত্যজিৎ রায়ের শ্যুটিং বা দৃশ্য গ্রহণের পদ্ধতি সামনে বা পাশে দাঁড়িয়ে দেখার আগ্রহে। দ্বিতীয়ত অন্যদের থেকে দৈহিক উচ্চতা বেশি হওয়ার কারণে, আমার পিছনের দৃশ্য ক্যামেরাতে আড়াল হয়ে যাওয়া । সেদিন-ই প্রথম বুঝে ছিলাম চিত্রগৃহে গিয়ে ছবি দেখা, আর সিনেমার শ্যুটিং বা দৃশ্য গ্রহণ এবং ছবি তৈরির মধ্যে কতোটা তফাৎ।
শ্যুটিং পর্ব সমাপ্ত হওয়ার পর, সত্যজিৎ রায় আবার একটি মোড়ায় গিয়ে বসার কিছু পরে, তাঁর স্বাক্ষর নেওয়ার জন্য সঙ্গে নিয়ে যাওয়া কাগজ ও পেন তাঁর দিকে এগিয়ে দিতেই , তিনি মোড়ায় বসেই আমার দিখে চোখ তুলে, আমার হাত থেকে কাগজ-কলম নিয়ে তাতে স্বাক্ষর শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে বললাম, 'ইন্দ্রপুরী স্টুডিও লিখে দিন'। তিনি আবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে, নিজের স্বাক্ষরের নিচে ইন্দ্রপুরী স্টুডিও, কলকাতা এবং তারিখ লিখে, কাগজটি আমাকে ফেরত দিয়ে স্নেহসুলভ দৃষ্টি ও ইশৎ স্মিতহাস্যে চোখ তুলে ভারী গলায় বললেন, 'ঠিক আছে ?'