শহীদ আসাদ ও বাংলাদেশ
প্রকাশ : 2025-01-20 11:43:16১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
একজন মানুষের আত্মত্যাগ একটি জাতিকে কতটুকু দিতে পারে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক শহীদ আসাদ তার উজ্জ্বল প্রমাণ। তাঁর আত্মত্যাগ বাঙালি জাতির পরাধীনতার গ্লানি মুছে দিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে যে কথা নিঃসন্দেহে বলতে হবে। আসাদ ছিলেন বাঙালিকে জাগিয়ে তোলার অন্যতম অগ্রদূত। তাঁর আত্ম দানের টগবগে রক্তস্রোতে ভেসে এ দেশের মানুষ ঝাপিয়ে পড়েছিলো বেনিয়া পাকিস্তানীদের রুখতে। তাদের শোষণ বঞ্চনা থেকে মুক্তি দিতে।
বাংলার মানুষের জন্য আসাদের ছিলো সীমাহীন দরদ আর অকৃত্রিম ভালোবাসা। তিনি অনুভব করতেন বাংলার সবুজ শ্যামল বনানী, উদার আকাশ, নির্মল বাতাস, স্নিগ্ধ আলো,নদীর পাল তোলা নৌকা, মাঠের সোনালি ফসল এবং সহজ সরল মানুষের জীবন। অপার নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য, অবারিত বর্ণিল সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা ও প্রাচুর্যে ভরা দেশের পরাধীনতা তাঁকে আঘাত করতো।
প্রায় দুইশত বছর ইংরেজ শোষণ শাসন আর পাকিস্তানের জুলুম নির্যাতনের যাঁতাকলে পিষ্ট বাঙালির দুর্দশা শহীদ আসাদের মনে গভীর বেদনার ক্ষতে পরিণত হয়েছিলো। ১৯৬৯ সালে তাঁর আত্মাহুতি ছিলো বাঙালি মুক্তির জন্য।
পাকিস্তানের দুঃশাসন ও তাদের কথিত লৌহ মানব আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদ। শোষকদের অবিচার, অত্যাচার, শোষণ ও দুঃশাসনে বাংলার মানুষ হয়ে উঠেছিলো ওষ্ঠাগত। নিজেদের অধিকার আদায়ে তারা ঘর ছেড়ে নেমে এসেছিলো রাজপথে। মিছিল, মিটিং ও শ্লোগানে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল কেঁপে উঠে হয়েছিলো মুক্তি পাগল। ২০ জানুয়ারি-১৯৬৯ সাল ঢাকার বটবলায় মিছিলের অগ্ৰভাগে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছিলেন আসাদ আর তখনি আইয়ুব খানের খুনি বাহিনী তাঁর বুকে সরাসরি গুলি করে। বাংলা মায়ের এ বীর শহীদ হন। আসাদ শহীদ হওয়ার সংবাদ দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলায়। এ সংবাদে মানুষ অগ্নি দুগ্ধ হয়ে উঠে। তাঁরা শপথ নেয় বজ্র কঠিন।
বাংলা হয়ে পড়ে রণক্ষেত্র। সংগ্ৰামী মানুষ তাদের স্বাধীকার আদায়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো সর্বত্র। আইয়ুব খা ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি। বিদায় নিতে হয়। বাঙালিরা মাত্র আড়াই বছরে সংগ্ৰাম করে, ৭১' সালে সশস্ত্র যুদ্ধে বেঈমানদের চিরতরে বিদায় করে বাংলাদেশ স্বাধীন করে।
ওই সময় আসাদের রক্তের তেজস্ক্রিয়তায় পাকিস্তানীরা ভয়ে আতংকিত হয়ে পড়ে। সুভাষ বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের ভয়ে যেমন ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে যেতে তড়িঘড়ি করেছিলো, ব্রিটিশদের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিলো। ঠিক তেমনই হয়েছিলো ধর্মের ধ্বজাধারী পাকিস্তানীদের আসাদের ভয়ে । আজ আমাদের দেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। এ দেশের মাটিতে এখনো আসাদের রক্তের ঘ্রাণ পাওয়া যায়। এ ঘ্নাণ শেষ হবে না কোনোদিন।
শহীদ আসাদ এমন একটি নাম যে নামটি বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাঙালির সংগ্ৰাম ও বাংলাদেশের ইতিহাস উদঘাটন করলে নরসিংদীর সন্তান শহীদ আসাদ প্রসঙ্গে কথা বলতেই হয় যেমনটি আসে বাংলা সাহিত্য আলোচনায় নরসিংদীর আরেক সন্তান কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ ও স্বাধীনতার কথায় কবি শামসুর রাহমানের প্রসঙ্গ।
আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন বর্ণ বাদেরে করাল গ্ৰাস থেকে তাঁর দেশকে মুক্ত করতে জীবন দিয়ে পৃথিবীর বুকে অমর হয়ে আছেন। মার্টিন লুথার কিং একই কারণে দাসত্বের অবসান ঘটাতে জীবন উৎসর্গ করে ইতিহাস সৃষ্টি করে জীবন্ত রয়েছেন। তাঁদের আরেক প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি সমাজে "সিভিল রাইটস, প্রতিষ্ঠায় বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন, নেনশন ম্যান্ডেলা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সারা জীবন সংগ্ৰাম করে নিগ্রহদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। এমন আরো অনেকের মত শহীদ আসাদ ও ৬৯-এ গণঅভ্যুত্থানে জীবন বিসর্জন দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার পথ তরান্বিত করে উজ্জ্বল হয়ে আছেন। মাত্র ২৭ বছরের (১৯৪২-১৯৬৯) সময়ে জ্ঞান হবার পর থেকেই তিনি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার চিন্তা করতেন । ব্যক্তিগত স্বাদ আহ্লাদ,রুপ রস গন্ধ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। জীবনের শুরু থেকেই নিজ এলাকার জনসাধারণকে বিভিন্ন ভাবে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করতেন। তাঁর দৃঢ় অঙ্গীকার ছিলো এ দেশের মানুষকে অত্যাচারী বেনিয়াদের হাত থেকে যে কোন মূল্যে উদ্ধার করতে হবে। জীবন দিয়ে তিনি সে ইচ্ছার মূল্য পরিশোধ করেছেন।
আসাদ জন্ম গ্ৰহণ করেছিলেন ১০ জুন/১৯৪২ এবং শহীদ হয়েছেন ২০ জানুয়ারি ১৯৬৯ সালে। দেশব্যাপী প্রতি বছর ২০ জানুয়ারি মৃত্যু দিবস যথাযথ ভাবে পালিত হয়ে আসছে। তাঁকে নিয়ে বেশি বেশি ভাবতে হবে আমাদের বর্তমান প্রজন্মেকে। আশা করি এ প্রজন্মই আসাদকে নিয়ে যাবে অসীম থেকে আরো অসীম উচ্চতায়। আসাদ বেঁচে থাকবেন বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায়।
লেখকঃ কলামিস্ট, লেখক ও সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার