যুদ্ধ বন্ধে ভূমিকা রাখুন, বিশ্বনেতাদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী

শান্তি ও অগ্রগতি নিশ্চিতে বিশ্বনেতাদের যুদ্ধ, সংঘাত ও অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করে পারস্পরিক শ্রদ্ধা পুনরুদ্ধারের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সরকারপ্রধান বলেছেন, ‘মানব সংযোগ শান্তি ও অগ্রগতির লাইফলাইন। আমাদের অবশ্যই যুদ্ধ, সংঘাত ও অস্ত্র প্রতিযোগিতার অবসান ঘটাতে হবে।’

বেলজিয়ামের ব্রাসেলসের জিজিএফ কনফারেন্স হলে আয়োজিত ‘গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরামের’ সম্মেলনের পূর্ণাঙ্গ উদ্বোধনী অধিবেশনে বক্তব্যকালে বিশ্বনেতাদের এই আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।

নিজ বক্তব্যে গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরাম-২০২৩ এর অধিবেশনের সর্বাত্মক সাফল্য কামনা করেন প্রধানমন্ত্রী। সেই সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি ও টেকসই উন্নয়নের জন্য এই সম্মেলন একটি মহান সংযোগ হিসেবে কাজ করবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ছাড়াও গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যতের সংকট মোকাবিলায় ভালো প্রস্তুতি রাখার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমাদের ভবিষ্যতের সংকটের জন্য আরও ভালোভাবে প্রস্তুত হতে হবে। আমাদের অবশ্যই পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বিভিন্ন দেশের মধ্যে বোঝাপড়ার প্রতি বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে।’

সম্মেলনে বাংলাদেশের মসৃণ এলডিসি উত্তরণে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অব্যাহত বাণিজ্য অগ্রাধিকারও চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ইইউকে বাংলাদেশের জন্য একটি বিশ্বস্ত বাণিজ্য, উন্নয়ন ও মানবিক অংশীদার হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের মসৃণ এলডিসি উত্তরণে ইইউ’র অব্যাহত বাণিজ্য অগ্রাধিকার চাই।’

সরকারপ্রধান জানান, বাংলাদেশে, বিশেষ করে ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ এবং দেশজুড়ে হাই-টেক পার্ক নির্মাণে বৃহত্তর বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। তাই ইইউভুক্ত দেশগুলোকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সুতরাং, আমি ইইউ বিনিয়োগকারীদের আমাদের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং হাই-টেক পার্কের সুবিধাগুলো অন্বেষণের আমন্ত্রণ জানাই।’

এছাড়াও দেশের শালীন কাজ ও সার্কুলার অর্থনীতিতে আরও কাজ করার সুযোগ রয়েছে বলেও ইইউভুক্ত দেশগুলোকে জানান প্রধানমন্ত্রী। একই সময় সবুজ হাইড্রোজেন উন্নয়নে বাংলাদেশ ইইউ’র সঙ্গে যোগ দিতে ইচ্ছুক বলেও জানান তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবহারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দক্ষতা থেকে উপকৃত হতে পারি। আমাদের কৃষি উৎপাদন সংরক্ষণের জন্য আমাদের কোল্ড চেইন নেটওয়ার্কগুলোতে বিনিয়োগের প্রয়োজন।’

বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যালস ও চিকিৎসা সরঞ্জাম শিল্প উৎপাদন বহুমুখীকরণে ইইউ’র প্রচেষ্টাকে সহায়তা করতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের আগামী দিনের ইনস্টিটিউটগুলোর জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে অংশীদার খুঁজছি।’

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের গতিশীল তরুণ জনগোষ্ঠী ইইউ’র দক্ষতা ও প্রতিভা অংশীদারিত্ব কর্মসূচিতে যোগ দিতে প্রস্তুত। আমরা বিশ্বাস করি গ্লোবাল গেটওয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’র জন্য আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়নে সহায়তা করবে।’

জলবায়ু পরিবর্তন, নিরাপত্তা এবং মানুষের গতিশীলতার ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ সহযোগিতা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের অভিন্ন মূল্যবোধ ও অঙ্গীকার ইইউ’র সাথে আমাদের সম্পৃক্ততার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।’ এ সময় বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিপক্ষীয় অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা চুক্তিতে আলোচনা শুরু করেছে বলেও জানান তিনি।

নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারে গৃহীত কার্যক্রমের কথা তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমরা নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগের জন্য ৩৫০ মিলিয়ন-ইউরো ঋণের জন্য ইআইবি’র সাথে একটি যুগান্তকারী চুক্তি স্বাক্ষর করেছি।’

বাংলাদেশ-ইইউ সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকীর প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘আমি আমাদের কৌশলগত সম্পৃক্ততা আরও জোরদার করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করছি।’

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। কারণ, আমাদের ৭০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি ১৫ বছরেরও কম সময়ে ৪৬৫ বিলিয়নে উন্নীত হয়েছে। 

সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমরা আমাদের লাখ লাখ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে এনেছি। চরম দারিদ্র্য ২০০৬ সালের ২৫.১ শতাংশ থেকে ৫.৬ শতাংশে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ ২০২৬ সালে জাতিসংঘের এলডিসি মর্যাদা থেকে উন্নীত হতে চলেছে।’

সরকারের নানা উদ্যোগের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ খাদ্য নিরাপত্তা, সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তি, কমিউনিটি ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন, বিনা খরচে আবাসন, গ্রামীণ যোগাযোগ, দুর্যোগ স্থিতিস্থাপকতা, জলবায়ু অভিযোজন, শতভাগ বিদ্যুৎ কভারেজ, দেশজুড়ে ইন্টারনেট সংযোগ, শিল্প প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিতে পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হচ্ছে। আমরা জলবায়ু ঝুঁকি সহনশীলতা ও সমৃদ্ধির দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

এ সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে একটি আঞ্চলিক সেতবন্ধু নির্মাতা হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ ১৭০ মিলিয়ন জনসংখ্যা নিয়ে কৌশলগতভাবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে অবস্থিত। দেশটির এ অঞ্চলের ৩ বিলিয়ন গ্রাহকের একটি বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশের সড়ক, রেল ও বন্দর অবকাঠামো আঞ্চলিক অর্থনৈতিক করিডরের অংশ হিসেবে নির্মিত হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশের নিজস্ব সম্পদে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ করেছি। আমরা নেপাল, ভুটান ও উত্তর-পূর্ব ভারতের স্থল-সংযুক্ত অঞ্চলগুলোকে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশের প্রস্তাব দিয়েছি। আমাদের বিমানবন্দরগুলো পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে প্রবেশদ্বার হিসাবে কাজ করতে পারে।

সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমাদের ইন্দো-প্যাসিফিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বাংলাদেশ ও ইইউ’র মধ্যে সংযোগ একটি সাধারণ বন্ধনমূলক উপাদান। আমরা পরিবহন নেটওয়ার্ক, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, সবুজ জ্বালানি, ডিজিটাল রূপান্তর, গবেষণা ও উদ্ভাবনের ওপর গ্লোবাল গেটওয়ের ফোকাসের প্রশংসা করি।’

 

ই