মাশা আমিনির মৃত্যুর পর ইরানে নৈতিকতা-পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন 

প্রকাশ : 2022-09-23 10:56:06১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

মাশা আমিনির মৃত্যুর পর ইরানে নৈতিকতা-পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন 

ইরানের নৈতিকতা রক্ষার দায়িত্বে থাকা পুলিশ বাহিনীর হেফাজতে ২২ বছর বয়সী মাশা আমিনির মৃত্যুর পর বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছেন ইরানের নারীরা।

গাশ্ত-ই এরশাদ (আক্ষরিক অনুবাদ-নির্দেশ টহলদার) নামের এই বিশেষ পুলিশ বাহিনীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মানুষ যাতে ইসলামী আদর্শ ও নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয় সেটা নিশ্চিত করার এবং কেউ অনৈতিক পোশাক পরেছে মনে হলে তাকে আটক করার।

ইরানে প্রচলিত শরিয়া আইন অনুযায়ী নারীদের হিজাব পরা বা চাদর দিয়ে মাথা ঢাকা বাধ্যতামূলক। এছাড়াও নারীদের শরীর সম্পূর্ণ ঢেকে রাখতে পা পর্যন্ত লম্বা ও ঢিলা পোশাক পরার বিধান দেশটিতে রয়েছে।

তেহরানে ১৩ই সেপ্টেম্বর এই নৈতিকতা রক্ষা পুলিশ যখন আমিনিকে গ্রেফতার করে তখন তার পোশাক নৈতিকতাবিরোধী ছিল বলে অভিযোগ করা হয়। একটি আটক কেন্দ্রে তাকে নিয়ে যাবার অল্পক্ষণ পরই মাশা আমিনি অজ্ঞান হয়ে যান এবং কোমায় চলে যান। তিন দিন পর তিনি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন।

অফিসাররা তার মাথায় লাঠির বাড়ি মেরেছে এবং তাদের একটি গাড়িতে মিজ আমিনির মাথা ঠুকে দিয়েছে এমন অভিযোগ পুলিশ বাহিনী থেকে অস্বীকার করা হয়।

গাশ্ত-ই এরশাদ নামে বিশেষ এই নজরদারি পুলিশ বাহিনীর একজন অফিসার নাম পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমে দেয়া একটি একান্ত সাক্ষাৎকারে ওই বাহিনীতে তার কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন।

‘তারা আমাদের বলে যে নারীদের রক্ষা করার লক্ষ্যে আমরা পুলিশের এই নৈতিকতা রক্ষা বাহিনীতে কাজ করছি,’ তিনি বলেন। ‘কারণ নারীরা যদি ঠিকমত পোশাক-আশাক না পরে, ওই নারীদের ক্ষতি করবে।’

তিনি বলেন, তারা ছয় জনের দলে কাজ করেন। দলে থাকেন চারজন পুরুষ এবং দুজন নারী পুলিশ। যেসব এলাকায় মানুষ পায়ে হেঁটে বেশি চলাচলা করে এবং যেসব এলাকায় মানুষের ভিড় বেশি হয়, সেসব এলাকার ওপর তারা বেশি নজর রাখেন।

যারা হিজাব ঠিকমত পরে না বা ইসলামী রীতি মেনে সাজপোশাক করে না, ইরানি কর্তৃপক্ষ তাদের হিজাব ঠিকমত না পরার বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পরপরই। ওই বিপ্লবের একটা বড় লক্ষ্য ছিল নারীদের খোলামেলা সাজপোশাক বন্ধ করা।

যদিও সে সময় ইরানের অনেক নারীই ইসলামী রীতি অনুযায়ী পোশাক পরতেন, কিন্তু পশ্চিমাপন্থী শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলাভিকে ক্ষমতাচ্যুত করার আন্দোলনের আগে তেহরানের রাস্তায় নারীদের খাটো স্কার্ট পরে এবং মাথা না ঢেকে চলাফেরা করতে দেখা যেত।

ইরান ইসলামী প্রজাতন্ত্রে পরিণত হবার কয়েক মাসের মধ্যেই শাহ-এর শাসনামলে পাশ্চাত্যের অনুকরণ করে নারীদের তথাকথিত অধিকার সুরক্ষিত করে যেসব আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল সেগুলো তুলে নেবার প্রক্রিয়া শুরু হয়।

বিপ্লবের ঠিক পরে পরেই, রাস্তায় রাস্তায় পুরুষ ও নারীরা উপহারের মোড়কে মুড়ে নারীদের হিজাব বিলি করত ইরানের সরকার।বিপ্লবের নেতা, আয়াতুল্লাহ রুহুল্লা খোমেনি ১৯৭৯ সালের ৭ই মার্চ ডিক্রি বা নির্দেশনামা জারি করেন যে সব নারীকে তাদের কর্মক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে হিজাব পরতে হবে।

এরপর ১৯৮১ সালে নারী ও কিশোরীদের ইসলামি রীতি অনুযায়ী আব্রু রক্ষা করার উপযোগী পোশাক পরা আইনত বাধ্যতামূলক করা হয়। এর অর্থ হলো নারীদের চাদর পরতে হবে অর্থাৎ তাদের পা অবধি পুরো শরীর ঢাকা ঢিলা পোশাক পরতে হবে এবং তার সাথে পারলে নিচে ছোট একটা স্কার্ফ পরতে হবে। অথবা পুরোদস্তুর হিজাব এবং তার সাথে লম্বা হাতা ওভারকোট দিয়ে শরীর ঢাকতে হবে।

পার্লামেন্ট ১৯৮৩ সালে সিদ্ধান্ত নিল যেসব নারী প্রকাশ্যে মাথা ঢাকবে না, তাদের শাস্তি হিসাবে ৭৪ বার বেত্রাঘাত করা হবে। আরও সম্প্রতি এই সাজার সঙ্গে আরও যোগ হয়েছে ৬০ দিন পর্যন্ত কারাবাস।তবে এরপরেও তখন থেকেই এই আইন পুরোপুরি কার্যকর করতে কর্তৃপক্ষকে বেগ পেতে হয়েছে।

নৈতিকতা রক্ষার দায়িত্বে থাকা ইরানের বিশেষ পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে জনগণ প্রায়ই অভিযোগ করে যে তারা খুবই কঠোর আচরণ করে থাকে, নারীদের প্রায়ই আটক করে এবং তাদের মুক্তি দেয় একমাত্র যখন আটক নারী পরিবারের কোনো সদস্য এসে নিশ্চয়তা দেয় যে ওই নারী ভবিষ্যতে পোশাকের নিয়মবিধি লঙ্ঘন করবে না।

গত বছর প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত ধর্মীয় নেতা ইব্রাহিম রাইসি ১৫ই আগস্ট একটি নির্দেশে স্বাক্ষর করেন যেখানে নতুন তালিকাভুক্ত বিধিনিষেধ বহালের ঘোষণা দেয়া হয়। এতে বলা হয় নারীরা কী ধরনের পোশাক পরে প্রকাশ্যে বেরুচ্ছে তা পর্যবেক্ষণের জন্য ক্যামেরা বসানো হবে।

মাশা আমিনির মৃত্যুর পরের দিনগুলোতে নারীদের দেশটির বিভিন্ন প্রান্তে পথে নেমে বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে, কাউকে কাউকে দেখা গেছে তাদের মাথা থেকে স্কার্ফ খুলে প্রতিবাদ করছে।