মাদারীপুরে ৬ শতাধিক কৃষকের জমিতে সরকারি পেয়াজের বীজ গজায়নি

প্রকাশ : 2025-01-19 17:26:03১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

মাদারীপুরে ৬ শতাধিক কৃষকের জমিতে সরকারি পেয়াজের বীজ গজায়নি

মাদারীপুর সদর উপজেলার পেয়ারপুর ইউনিয়নের বলাইকান্দি গ্রামের কৃষক মোশারফ বেপারী । ৩৩ শতাংশ জমিতে রোপন করেছিলেন সরকারি ভাবে দেওয়া এক কেজি পেয়াজের দানা। সরকারিভাবে বিনামূল্যে পেয়াজের বীজ পেলেও চাষাবাদ করতে খরচ হয়েছে আরো ৪০ হাজার টাকা। কিন্তু দুই মাসের মাথায় বীজ থেকে কলির বদলে গজিয়েছে জমিতে ঘাস ও আগাছ। তাই বাধ্য হয়ে লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে নতুন করে চাষাবাদ করতে শুরু করেছেন তিনি। পেয়াজ চাষী বাচ্চু হোসেন বলেন, ‘সরকারি ভাবে যখন কৃষি অফিসের স্যারেরা পেয়াজের দানা আমাকে দেয়। তখন আমি বার বার তাদের বলেছিলাম, পেয়াজের দানা ভাল হবে কি না? স্যারেরা বলেছিল তখন, পেয়াজের দানা খুব ভাল হবে। ফলনও ভাল হবে। তাদের কথায় বিশ^াস করে আমি সরকারি ভাবে দেওয়া এক কেজি পেয়াজের দানা আমি রোপন করেছি। কিন্তু দুই মাস হয়ে আসলেও আমার জমিতে কোন পেয়াজের কলি গজায়নি। গজিয়েছে ঘাস ও আগাছা। এখন নতুন করে বদলা কামলা দিয়ে জমি পরিস্কার করছি। সরকারের কাছে আমার ক্ষতিপূরণ চাই। পেয়াজের জন্য যে ৪০ হাজার খরচ করেছি। তার ক্ষতিপূরণ চাই।

একই গ্রামের আরেক পেয়াজ চাষী বাচ্চু বেপারী। তিনি বলেন, ‘আমি বিশ শতাংশ জমিতে সরকারি পেয়াজের বীজ রোপন করেছিলাম। কিন্তু পুরা জমিই এখন ঘাসে ভরা। আমার জমিটি চকের মধ্যে খানে থাকায় অন্যর জমির উপর দিয়ে কোন ট্রাক্টর নিয়ে নতুন করে যে চাষাবাদ করব, সেই পরিস্থিতিও নেই। এই বছর আমার জমিটা ফসল বিহিন কেটে গেল। আমি ধার দেনা করে পেয়াজের চাষাবাদ করেছিলাম। এখন দেনা পরিশোধ করবো কিভাবে সেই চিন্তায় ঘুম আসে না।

এওজ গ্রামের অপর পেয়াজ চাষী মতিউর সরদার অসকরনী বলেন,‘ আমি ৪০ থেকে ৫০ টাকা খরচ করে কয়েক দফা জমি চাষ করে সরকারি পেয়াজের দানা রোপন করেছিলাম। আমার পুরা টাকাই পানিতে চলে গেছে। একটি দানাও গজায়নি। পুরা জমি খালি পড়ে আছে। সেখানে এতদিন ছিল জঙ্গল। গত সপ্তাহে জমিতে নতুন বদলা নিয়ে পরিস্কার করেছি। এখন নতুন কোন ফসল চাষাবাদ করা যায় কি না সে চেষ্টা করছি। কিন্তু সরকারি পেয়াজের দানা রোপন এমন লোকসান গুনতে হবে, আগে বুঝতে পারলে কোনদিন সরকারি পেয়াজের দানা চাষ করতাম না। আমি সরকারের দাবী করছি, আমার যে ক্ষতি হইছে সেই ক্ষতিপূরণ সরকার আমাকে যেন দেয়। তাতে আমি লোকসনা কিছুটা কাটিয়ে উঠতে পারব। - মাদারীপুর জেলার ৫ টি উপজেলার পেয়াজ চাষীদের একই ধরনের কথা।

মাদারীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, গেল নভেম্বরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও কন্ট্রাক গ্রোস কৃষকদের মাধ্যমে কেনা হয় ৭ কোটি টাকার বারি-১, বারি-৪ ও তাহেরপুরী পেয়াজের বীজ। যা বৃহত্তর ফরিদপুরের ৫ জেলার ১০৮২০ জন চাষির মাঝে দেয়া হয় বিনামূল্যে। এর মধ্যে মাদারীপুর জেলার ৬’শ কৃষককে দেওয়া এই বীজ। কিন্তু দুইমাস পেরিয়ে গেলেও পেয়াজের কলি নয়, জমিতে গজিয়েছে ঘাস আর লতাপাতা। চাষিদের অভিযোগ, ঠিকাদারের মাধ্যমে নিন্মমানের বীজ সংগ্রহ করে বিতরণ করায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আরো অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় কয়েকজন কন্ট্রাক গ্রোস চাষী ও বিএডিসির কর্মকর্তাদের যোগসাজশে কোন ধরনের ল্যাব টেষ্ট ছাড়াই পেয়াজের নি¤œ মানের বীজ সরবরাহ করা হয়। এরজন্য মূলত বীজ গজায়নি।

ফরিদপুর অঞ্চলের কন্ট্রাক গ্রোস কৃষক নূরে আলম বলেন, ‘কন্ট্রাক গ্রোস পেয়াজের বীজের বিষয়ে আমি কিছু জানি না। সব কিছু জানে স্যারেরা। তারাই ভাল বলতে পারবে কিভাবে বীজ সংগ্রহ করা হয়েছে।’

এই বিষয়ে মাদারীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সন্তোষ চন্দ্র চন্দ বলেন, ‘বাংলা কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে যে পেয়াজের দানা দেওয়া হয়েছিল, তা আমরা ৬ শতাধিক কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে প্রদান করি। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেছে, ৫২৭ জন কৃষকের জমিতে কোন পেয়াজ গজায়নি। পরবর্তীতে প্রণোদনা হিসেবে আমাদের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে আধা কেজি করে ৫২৭ জন কৃষককে বিনামূল্যে পেয়াজ দানা প্রদান করি। তবে কেন বিএডিসি’র বীজ কৃষকের জমিতে গজায়নি, সেটি বিএডিসি কর্তৃপক্ষ ভাল বলতে পারবে। আমরা শুধু তাদের বীজ এনে কৃষকদের প্রদান করেছি।

এরইমধ্যে ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের প্রধান কার্যলয়। তবে নিম্নমানের বীজ প্রদানের বিষয়ে ফরিদপুর অঞ্চলের বিএডিসি’র সহকারী পরিচালক সায়েম মল্লিক দায়সারা উত্তর দিয়ে বলেন, ঢাকা থেকে আমাদের যে বীজ সরবরা করা হয়েছে আমরা সেই বীজ কৃষকদের প্রদানের জন্য বিভিন্ন জেলায় পাঠিয়েছি। কেন গজায়নি এটা ভাল বলতে পারবে ঢাকার প্রধান কার্যালয়।

তবে উন্নত মানের বীজ সংগ্রহ করা হয়েছে দাবী করে বীজ সরবরাহকারী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান গোল্ডেন এন্টারপ্রাইজের প্রধান রফিকুল ইসলাম মুক্তা বলেন, আমরা যখন বীজ সংগ্রহ করি তখন আমাদের কাছ থেকে বিএডিসি’র কর্মকর্তা বীজের স্যাম্পল সংগ্রহ করে ল্যাব টেষ্টে পাঠান। পরবর্তীতে ল্যাব টেষ্টে আমাদের বীজ ভাল এই রকম সনদ প্রদান করেন বিএডিসির কর্মকর্তারা। পরবর্তীতে আমরা সরকারকে বীজ সরবরাহ করি। এখন বীজ থেকে কেন চারা গজায়নি এটা ভাল বলতে পারবে বিএডিসির কর্মকর্তারা।

মাদারীপুর অর্থনীতি সমিতির সভাপতি রিপনচন্দ্র মল্লিক বলেন, এই প্রকল্পটি সরাসরি কৃষকের স্বার্থরক্ষার জন্য সরকার গ্রহণ করেছিল। কিন্তু এই প্রকল্পে নি¤œমানের বীজ সরবরাহ করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের একটি সিন্ডিকেট অর্থের অপব্যহার করার বিষয়টি অনুমান করা যাচেছ। তাই এই প্রকল্পের প্রকৃত অনিয়মগুলো তদন্ত করে বের করে দোষীদের শাস্তিার আওতায় নিয়ে আসা জরুরী।’

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গোল্ডেন এন্টারপ্রাইজ ও স্থানীয় কন্ট্রাক গ্রোস কৃষকের নামের মাধ্যমে ৭ কোটি ২০ লাখ টাকায় কেনা হয় বারি-১, বারি-০৪ ও তাহেরপুরি জাতের এই পেয়াজের বীজ। ফলন না হওয়ায় লোকসানের মুখে মাদারীপুরের চাষিরা। এই ঘটনায় জড়িতদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও ক্ষতিপূরণের দাবী করছে কৃষকেরা। সেই সাথে যারা এই প্রকল্পের অর্থ খরচের অপব্যবহার করেছে তাদের বিচার দাবী করছেন তারা।