ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মহান বিপ্লবী নেত্রী মাতঙ্গিনী হাজরা
প্রকাশ : 2022-11-17 11:08:12১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
মাতঙ্গিনী হাজরা (১৯ অক্টোবর ১৮৭০–২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৪২) ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী এক মহান বিপ্লবী নেত্রী। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৯ সেপ্টেম্বর তদনীন্তন মেদিনীপুর জেলার তমলুক থানার সামনে ব্রিটিশ ভারতীয় পুলিশের গুলিতে তিনি শহিদ হয়েছিলেন। তিনি 'গান্ধীবুড়ি' নামে পরিচিত ছিলেন।
মাতঙ্গিনী হাজরার প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায়না। শুধু এটুকুই জানা যায় যে, ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে তমলুকের অদূরে হোগলা নামে একটি ছোটো গ্রামে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে তার জন্ম হয়েছিল। দারিদ্র্যের কারণে বাল্যকালে প্রথাগত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন মাতঙ্গিনী। অতি অল্প বয়সেই তার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। তাঁর স্বামীর নাম ত্রিলোচন হাজরা। তিনি মাত্র আঠারো বছর বয়সেই নিঃসন্তান অবস্থায় বিধবা হয়েছিলেন।
মেদিনীপুর জেলার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল নারীদের এই আন্দোলনে যোগদান। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে প্রত্যক্ষভাবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন মাতঙ্গিনী হাজরা। মতাদর্শগতভাবে তিনি ছিলেন একজন গান্ধীবাদী। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে মাতঙ্গিনী আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দেন। সেই সময়ে তিনি লবণ আইন অমান্য করে কারাবরণ করেছিলেন। অল্পকাল পরেই অবশ্য তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু চৌকিদারি কর মকুবের দাবিতে প্রতিবাদ চালিয়ে গেলে আবার তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। এই সময় তিনি বহরমপুরের কারাগারে ছ-মাস বন্দি ছিলেন। তিনি হিজলি বন্দি নিবাসেও বন্দি ছিলেন কিছুদিন। মুক্তিলাভের পর তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সক্রিয় সদস্যপদ লাভ করেন এবং নিজের হাতে চরকা কেটে খাদি কাপড় বানাতেও শুরু করেন। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে মাতঙ্গিনী শ্রীরামপুরে মহকুমা কংগ্রেস অধিবেশনে যোগ দিয়ে পুলিশের লাঠিচার্জের সময় আহত হন।
তিনি সর্বদা মানবতাবাদী উদ্দেশ্য সাধনে নিয়োজিত থেকেছেন। তাঁর অঞ্চলে যখন মহামারী আকারে বসন্ত-রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে, তখন তিনি আক্রান্ত পুরুষ, নারী ও শিশুদের সেবা করেছেন। ১৯৩০-এর দশকে কারাবাস ও পুলিশের লাঠিচার্জের ফলে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। কিন্তু জেল থেকে মুক্তির পরেই তিনি সমাজের সেবায় আবার নিয়োজিত হন, বিশেষত অস্পৃশ্যদের সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে তাঁর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় কংগ্রেস সদস্যেরা মেদিনীপুর জেলার সকল থানা ও অন্যান্য সরকারি কার্যালয় দখল করে নেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল জেলা থেকে ব্রিটিশ শাসন উচ্ছেদ করে এখানে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। প্রধানত মহিলা স্বেচ্ছাসেবকসহ ছয় হাজার সমর্থক তমলুক থানা দখলের উদ্দেশ্যে একটি মিছিল বের করে। এই মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ৭৩ বছর বয়সী মাতঙ্গিনী হাজরা। শহরের উপকণ্ঠে মিছিল পৌঁছালে ব্রিটিশ রাজপুলিশ ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৪৪ ধারা জারি করে সমাবেশ ভেঙে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু সেই আদেশ অমান্য করে মাতঙ্গিনী অগ্রসর হলে তাঁকে গুলি করা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও মাতঙ্গিনী এগিয়ে চলেন এবং পুলিশের কাছে আবেদন করেন জনতার ওপর গুলি না-চালাতে।
তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের মুখপত্র বিপ্লবী পত্রিকার বর্ণনা অনুযায়ী, ফৌজদারি আদালত ভবনের উত্তর দিক থেকে মাতঙ্গিনী একটি মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। পুলিশ গুলি চালালে তিনি অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকদের পিছনে রেখে নিজেই এগিয়ে যান। পুলিশ তিনবার তাঁকে গুলি করে। গুলি লাগে তার কপালে ও দুই হাতে। তবুও তিনি এগিয়ে যেতে থাকেন।
এরপরেও বারংবার তার ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়। কংগ্রেসের পতাকাটি মুঠোর মধ্যে শক্ত করে উঁচিয়ে ধরে বন্দেমাতরম ধ্বনি উচ্চারণ করতে করতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার স্বদেশের জন্য মাতঙ্গিনী হাজরার মৃত্যুবরণের দৃষ্টান্তটিকে সামনে রেখে মানুষকে বিপ্লবের পথে উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিল। উল্লেখ্য, এই সমান্তরাল সরকারটি ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সফলভাবে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়। পরে গান্ধীজির অনুরোধে এই সরকার ভেঙে দেওয়া হয়েছিল।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত স্বাধীনতা অর্জন করলে অসংখ্য স্কুল, পাড়া ও রাস্তার নাম মাতঙ্গিনী হাজরার নামে উৎসর্গ করা হয়। কলকাতায় দীর্ঘ বিস্তৃত হাজরা রোড তাঁর নামেই নামাঙ্কিত হয়েছে। স্বাধীন ভারতে কলকাতা শহরে প্রথম যে নারীমূর্তিটি স্থাপন করা হয়েছিল, সেটি ছিল মাতঙ্গিনী হাজরার মূর্তি। ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার ময়দানে এই মূর্তিটি স্থাপিত হয়।
তমলুকে ঠিক যে জায়গাটিতে তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন, সেই জায়গাটিতেও তার একটি মূর্তি আছে। ২০০২ খ্রিস্টাব্দে ভারত ছাড়ো আন্দোলন ও তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার গঠনের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ভারতের ডাকবিভাগ মাতঙ্গিনী হাজরার ছবি দেওয়া পাঁচ টাকার ডাকটিকিট চালু করে। ২০১৫ সালে তমলুক শহরে মহিলাদের জন্য শহীদ মাতঙ্গিনী গভর্নমেন্ট কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয় এই মহান স্বাধীনতা সংগ্রামীকে শ্রদ্ধা জানিয়ে।